নেবুলা হল ধুলা, হাইড্রোজেন, হিলিয়াম ও আয়নিত গ্যাসের আন্তঃমহাকাশীয় মেঘ। আসলে যেকোনো মহাকাশীয় বস্তুর ছড়িয়ে যাওয়া অবস্থাকেই নেবুলা বলা যায়। বস্তু বলতে তা একটি নক্ষত্র, এমনকি একটি গ্যালাক্সীও হতে পারে। যেমন বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে যখন বিজ্ঞানীরা গ্যালাক্সিগুলির আসল ধর্ম জানতেন না তখন এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সীকে এন্ড্রোমিডা নেবুলাও বলা হত।
বেশীরভাগ নেবুলাই বিশাল আকারের হয়ে থাকে, এদের বিস্তৃতি মিলিয়ন আলোকবর্ষও হতে পারে। সায়েন্স ফিকশনগুলিতে দেখানো হয় মহাকাশযান বিপদ থেকে বাঁচতে নেবুলার আড়ালে আশ্রয় নেয়।বাস্তবে নেবুলা অনেক বড় হয় কিন্তু পৃথিবী থেকে দুরত্ব ব্যাপক হবার কারণে একে ছোট দেখায়। যেমন দ্য গ্রেট ওরায়ন নেবুলা রাতের আকাশে সবচেয়ে উজ্জ্বল নেবুলা যা চাঁদকে যত বড় দেখায় তার দ্বিগুণ দেখায়। এটি খালি চোখে দেখা গেলেও ইতিহাসের শুরুর দিকের জ্যোতির্বিদেরা তা পর্যবেক্ষণ করতে পারেননি। নেবুলা তার চারপাশের মহাকশের চেয়ে ঘনত্বে বেশী হলেও তা পৃথিবীতে তৈরি যেকোনো বায়ুশূন্য জায়গার চেয়েও কম ঘনত্বের। পৃথিবীর সমান আকারের একটি নেবুলার ভর মাত্র কয়েক কেজি হতে পারে। কাছাকাছি উজ্জ্বল ও উত্তপ্ত নক্ষত্র থাকার কারণে অনেক নেবুলা পৃথিবী থেকে দৃশ্যমান। যেসব নেবুলার কাছাকাছি এমন নক্ষত্র থাকেনা তাদের উচ্চমানের টেলিস্কোপ ছাড়া শনাক্ত করা খুব কঠিন কারণ তারা খুবই কম ঘনত্বের। সাধারণত নেবুলাতেই নতুন তারার জন্ম হয়, যেমন ঈগল নেবুলার “পিলারস অব ক্রিয়েশন।“ এসব এলাকায় গ্যাস, ধুলা এবং অন্যান্য বস্তু একত্রিত হয়ে একটি ঘন এলাকার সৃষ্টি করে যা পড়ে আরও বস্তুকে আকৃষ্ট করে এবং একসময় এতটাই ঘনত্ব অর্জন করে যে তা একটি নক্ষত্রে পরিণত হয়। নক্ষত্র তৈরি হবার ঐ ঘন অঞ্চলের বাকী বস্তুগুলি দিয়ে গ্রহ ও অন্যান্য গ্রহের মত জ্যোতিষ্কের সৃষ্টি হয়।
বিগ ব্যাং তত্ত্ব মহাবিশ্বের উৎপত্তি সম্পর্কে প্রদত্ত একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব। মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব নামেও পরিচিত। বিগ ব্যাং তত্ত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো কোন ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার পরিবর্তে একটি বিশেষ মুহূর্তে মহাবিশ্বের উদ্ভব। বিগ ব্যাং তত্ত্ব বলে আজ থেকে প্রায় ১৩.৭৫ বিলিয়ন বছর পূর্বে এই মহাবিশ্ব একটি অতি ঘন এবং উত্তপ্ত অবস্থা থেকে সৃষ্টি হয়েছিল।
ধারণা অনুযায়ী, প্রায় ১৩৭০ কোটি বছর আগে অতি উত্তপ্ত এবং প্রায় অসীম ঘনত্বের এক পুঞ্জীভূত অবস্থা থেকে এক বিশাল বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে উদ্ভব ঘটেছে আমাদের এই চিরচেনা মহাবিশ্বের। বিগ ব্যাং নিয়ে দেখুন থিংকের ভিডিও আসলেই কি ঘটেছিলো মহাবিষ্ফোরণ?
অবশ্য আজকে আমরা মহাবিশ্বকে যেভাবে দেখি, মহাবিশ্বের ঊষালগ্নে এর প্রকৃতি কিন্তু একদমই এরকম ছিল না, ছিল অনেকটাই আলাদা। আজকে আমরা যে চারটি মৌলিক বলের কথা শুনতে পাই–সবল নিউক্লীয় বল, দুর্বল নিউক্লীয় বল, তাড়িতচৌম্বক বল এবং মাধ্যাকর্ষণ বল–বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, এই চারটি বল ‘সুপার ফোর্স’ বা অতিবল হিসেবে একসাথে মিশে ছিল। ওরকম ভাবেই ছিল তারা মহাবিস্ফোরণের ঊষালগ্ন থেকে শুরু করে ১০-৪৩ সেকেন্ড পর্যন্ত। প্রথম এক সেকেন্ড পর্যন্ত মহাবিশ্ব ছিল যেন জ্বলন্ত এক নিউক্লীয় চুল্লি। তাপমাত্রা ছিল একশ কোটি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের চেয়েও বেশি। সেসময় কোন চেনাজানা কণা ছিল না, চারদিক পূর্ণ ছিল কেবল প্লাজমার ধোঁয়াশায়। এক সেকেন্ড পরে কোয়ার্ক, ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রনের মত মৌলিক কণিকাগুলি তৈরি হয়। তিন সেকেন্ড পরে প্রোটন আর নিউট্রন মিলে তৈরি হল নিউক্লিয়াস, এর পরে যথাক্রমে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, লিথিয়াম। কিন্তু মহাবিশ্বের উদ্ভবের প্রায় কয়েক লক্ষ বছর পর্যন্ত আমরা যাকে জড়পদার্থ বা ম্যাটার বলি সেরকম কিছুই তৈরি হয়নি। তখন আসলে রঞ্জন রশ্মি, আর বেতার তরঙ্গের মত লম্বা দৈর্ঘ্যের অতি তেজি রশ্মিগুলোই বরং পদার্থের উপর রাজত্ব করছিল। প্রায় চার লক্ষ বছর পরে তাপমাত্রা খানিকটা কমে তিন হাজার ডিগ্রি কেলভিনে নেমে আসার পরই কেবল প্লাজমা থেকে স্থায়ী অণু গঠিত হবার মত পরিবেশ তৈরি হতে পেরেছে। এসময় মহাবিশ্বের কুয়াশার চাদর ধীরে ধীরে সরে গিয়ে ক্রমশ স্বচ্ছ হয়ে আসে, পথ তৈরি হয় ফোটন কণা চলাচলের। আর তার পরই কেবল তেজস্ক্রিয় রশ্মিসমূহের উপর জড়-পদার্থের আধিপত্য শুরু হয়েছে।
এর পর আরও প্রায় একশ কোটি বছর লেগেছে গ্যালাক্সি জাতীয় কিছু তৈরি হতে। আর আমাদের যে গ্যালাক্সি, যাকে আমরা আকাশগঙ্গা নামে ডাকি, সেখানে সূর্যের সৃষ্টি হয়েছে আজ থেকে প্রায় পাঁচশত কোটি বছর আগে। আর সূর্যের চারপাশে ঘূর্ণ্যমহাবিশ্ব সংক্রান্ত যে কোন বিজ্ঞানের বই খুললেই আমরা দেখি সেটা অবধারিতভাবে শুরু হয় বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ দিয়ে। সেই যে ১৯২৯ সালে এডউইন হাবল তাঁর বিখ্যাত টেলিস্কোপের সাহায্যে আকাশের গ্যালাক্সিগুলোর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন গ্যালাক্সিগুলো একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, তা দেখেই কিন্তু এক ধরনের ধারণা পাওয়া যায়, দূর অতীতে নিশ্চয় তারা খুব কাছাকাছি ছিল, খুব ঘন সন্নিবদ্ধ অবস্থায় গাঁটবন্দি হয়ে। আর সেই গাঁট-পাকানো অবস্থা থেকেই সবকিছু চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে আকস্মিক এক বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে। এটাই সেই বিখ্যাত ‘বিগ ব্যাং’-এর ধারণা। এমান গ্যাসের চাকতি থেকে প্রায় ৪৫০-৪৬০ কোটি বছরের মধ্যে তৈরি হয়েছিল পৃথিবী সহ অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহগুলো।