"বিশ্বাসে মেলে বস্তু, তর্কে বহুদূর" আসলেই বিশ্বাসে বস্তু মেলে কি-না কিংবা তর্ক আমাদের বহুদূর নিয়ে যায় কি-না তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই! তবে এই বিতর্ক কতটুকু গ্রহণযোগ্য কিংবা যৌক্তিক তা নিয়েও বিতর্ক করা যায়!
স্কুল-কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বিতর্ক শব্দটির সাথে পরিচিত হননি, এমন মানুষের সংখ্যা একেবারেই হাতেগোণা। জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই রয়েছে বিতর্কের চর্চা। ধারণা করা হয় গ্রিকদের মাধ্যমেই বিতর্কের সূচনা হয়েছিল। আজ প্রায় দু'হাজার বছর পরেও বিতর্কের অপ্রয়োজনীয়তা কিন্তু মোটেই ম্লান হয়নি। তবে অনেকেই বিতর্ককে বাঁকা চোখে দেখে থাকে। কেউ বিতর্ক করে, অনেকেই দর্শক হিসেবে উপভোগ করে আবার কেউবা বিতার্কিকদের 'ঝগড়াটে' উপাধি দেয়! তবে বিতর্ক আর ঝগড়ার মূল পার্থক্য বোঝাটা জরুরি বিষয়। বিতর্ক এবং ঝগড়া, উভয়ই তর্ক। তবে সহজ কথা বিতর্ক হচ্ছে যৌক্তিক তর্ক আর ঝগড়ায় কোনো যুক্তি থাকে না। এটাই অনেকের বোধগম্য হয় না।
স্কুল-কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমরা অনেকেই কো-কারিকুলার এক্টিভিটি হিসেবে বিতর্ক করে থাকি, তবে এটা কি শুধুই একটি সহশিক্ষামূলক কার্যক্রম? না-কি তার চাইতেও বেশি কিছু? বিতর্ক করে আমাদের লাভ কী? আমরা কেন বিতর্ক শিখব?
বিতর্ক আমাদের যুক্তিবাদী চিন্তা-চেতনার বিকাশ ঘটায়। আগেই বলেছিলাম, বিতর্ক হচ্ছে মূলত যৌক্তিক তর্ক, যেখানে সম্পূর্ন আলোচনা হবে যুক্তির উপর ভিত্তি করে। ফলে বিতর্ক চর্চা আমাদের যুক্তিবাদী চিন্তাকে দৃঢ় করে। যুক্তি দ্বারাই একজন বিতার্কিক তার বক্তব্যকে আর দশজন সাধারণ মানুষ থেকে আলাদা করতে পারে! তাই নিজেকে একজন যুক্তিবাদী মানুষ হিসেবে তৈরির জন্য বিতর্কের চর্চা জরুরি।
বিতর্ক চর্চার মাধ্যমে আপনি একজন ভালো বক্তা হয়ে উঠতে পারেন। আচ্ছা, মানুষ কখন আপনার কথা শুনবে? কখন আপনাকে পাত্তা দিবে? যখন আপনি আপনার কথা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হবেন! বিতর্ক চর্চার মাধ্যমে আপনি আপনার বক্তব্যের ভিত আরোও মজবুত করতে সক্ষম হবেন। আপনার উপস্থাপনা কৌশল অন্যান্য দশজনের চাইতে আলাদা এবং সুন্দর হবে। তাহলে মানুষ কেন আপনার কথা শুনবে না?
বিতর্কের ধরন এবং বিষয়ের ওপর নির্ভর করে সাধারণত একজন বক্তার ৫-৭ মিনিট সময় থাকে, সেই সময়ের মধ্যেই তাকে তার বক্তব্য গুছিয়ে উপস্থাপন করতে হয়। বিতর্ক চর্চার মাধ্যমে আপনার সময়ানুবর্তিতার গুণটি বৃদ্ধি পাবে। ফলে আপনি সহজেই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আপনার কথাকে উপস্থাপন করতে সক্ষম হবেন, বাস্তবন জীবনে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ধরুন, আপনাকে ক্লাসে একটি প্রেজেন্টেশন দিতে দেওয়া হলো, যার জন্য নির্ধারিত সময় ৫ মিনিট। আপনি যদি ৩ মিনিট শুধুই ভূমিকাই বর্ণনা করেন, তবে মূল বক্তব্য আর উপসংহার ঠিকঠাকমতো হবে না। আবার আপনি যদি ৫ মিনিটের মধ্যে ৩ মিনিটেই আপনার সম্পূর্ন বক্তব্য শেষ করে ফেলেন,তবে সেটিও দৃষ্টিকটূ দেখায়!
বাংলাদেশে বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় বিতর্ক প্রচলিত রয়েছে। বিতর্ক চর্চার মাধ্যমে আপনি নিজের ভাষাজ্ঞান এবং ভাষার দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারবেন। কেননা, বিতর্কে প্রমিত ভাষা ব্যবহার করা আবশ্যক। আপনি যখন নিয়মিত একটা ভাষা চর্চা করবেন, তবে সেই ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে আপনাকে কে ঠেকায়?
বিতর্ক আপনার বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবতে শেখায়। ধরা যাক আপনার বিতর্কের বিষয় হচ্ছে, 'আইনের সঠিক প্রয়োগই পারে সহিংস উগ্রবাদ দমন করতে।' ধরে নিলাম, আপনি এর বিপক্ষে বিতর্ক করবেন, তাহলে শুধুমাত্র এর বিপক্ষে যুক্তি নিয়ে ভাবলেই কি হবে? তা কিন্তু নয়। আপনাকে পক্ষে এবং বিপক্ষে উভয় ধরনের যুক্তি নিয়ে ভাবতে হবে এবং পক্ষের যুক্তিগুলো খণ্ডন করতে হবে, তবেই তো আপনি সফল হবেন!
বর্তমান সময়ে একজন মানুষ আরেকজনের মতামতকে সম্মান করতে চায় না, বরং ভিন্নমত দমন করে নিজের মতামত অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে। বিতর্ক মানুষকে এই খারাপ প্রবণতা থেকে বের হতে সাহায্য করে।
আপনি যখন কোনো বিষয়ে বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন, তখন সেই বিষয়ে আপনার অগাধ জ্ঞান থাকা খুবই জরুরি! তাই বিতর্কের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য আপনার কঠোর পড়াশোনার প্রয়োজন হয়, যা আপনার জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করবে।
আপনি যখন একজন নিয়নিত বিতার্কিক হয়ে উঠবেন, তখন আপনি বিভিন্ন স্থানের বিভিন্ন বিতার্কিকের সাথে পরিচিত হবেন, ফলে আপনার সোশ্যাল নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি পাবে! যা আপনার ভবিষ্যত কর্মজীবনেও সাহায্য করবে।
পরিশেষে, একজন বিতার্কিক কখনোই শুধুমাত্র বিতর্কের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকেন না। ছড়িয়ে পড়েন উপস্থাপনা, আবৃত্তি, উপস্থিত বক্তৃতা-সহ বিভিন্ন সহশিক্ষামূলক কার্যক্রমে। ফলে খুব দ্রুতই তার ঘর কেস্ট-ট্রফিতে ভরে ওঠে! এইজন্যে হলেও বিতর্ক শেখা উচিত!
একুশ শতকের প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকার হাতিয়ার হিসেবে বিতর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অবহেলা না করে এ বিষয়ে আমাদের মনোযোগ দেওয়া উচিত।
-হায়াত মোহাম্মাদ ইমরান আরাফাত