ছোটোবেলায় কেউ যখন আমাকে জিজ্ঞেস করত যে, "বাবা, তুমি বড়ো হয়ে কী হতে চাও?" আমি বলতাম, "আমি বড়ো হয়ে নেতা হব। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হব।" তখন সবাই হাসাহাসি করত। তবে বড়ো হওয়ার সাথে সাথে ছোটোবেলার সেই ইচ্ছে টা ফিকে হয়ে গিয়েছে।
নেতৃত্ব দিতে কে-ই বা অপছন্দ করে? আমরা অনেকেই নেতা হতে চাই, কিন্তু একটি দলের নেতা হয়ে সেই দলকে সঠিক দিকনির্দেশনার সাথে পরিচালনা করার দক্ষতা সবার মধ্যে থাকে না। খুব কম মানুষই হয়ে উঠতে পারেন একজন আদর্শ নেতা। এজন্য প্রাচীনকালে মনে করা হত যে, যারা নেতা তারা জন্ম থেকেই এই গুণ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তবে যুগ পাল্টিয়েছে, মানুষের চিন্তাধারাও পাল্টিয়েছে। এখন সবাই বুঝতে শিখেছে যে কেউই নেতা হিসেবে জন্মগ্রহণ করে না, বরং নিজের প্রবল পরিশ্রমের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি হয়ে উঠতে পারেন একজন আদর্শ নেতা। "Leaders are born, not made" ধারণাটি পরিবর্তিত হয়ে "Leaders are made, not born" ধারণার প্রতিষ্ঠা হয়েছে।
"Before you are a leader, success is all about growing yourself. When you become a leader, success is all about growing others."
- Jack Welch, American Business Executive
অনেকেই নিজেকে নেতা হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলেও কীভাবে নেতৃত্বের গুণাবলিগুলো অর্জন করতে হবে, সে ব্যাপারে ধারণা না থাকায় অনেকেই নিজের ইচ্ছা পূরণে ব্যর্থ হন। কীভাবে নিজেকে গড়ে তুলবেন একজন আদর্শ নেতা হিসেবে? কীভাবে নিজেকে আর দশজন সাধারণ মানুষের তুলনায় আলাদা হিসেবে সমাজে উপস্থাপন করবেন? কীভাবে নেতৃত্বের গুণাবলিগুলো নিজের মধ্যে পরিচর্যা করে নিজেকে আদর্শ নেতা হিসেবে গড়ে তুলবেন? আজকের লেখা সে বিষয়েই।
১. আত্মবিশ্বাস
একজন নেতার যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটি হচ্ছে আত্মবিশ্বাস। আপনার নিজেরই যদি আত্মবিশ্বাসের অভাব থাকে, তবে আপনি মোটেই একটি পুরো দলকে নেতৃত্ব দিতে পারবেন না, দলকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারবেন না। যেহেতু, দলের কার্যপ্রণালি আপনার মুখাপেক্ষী। আপনি যখন সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সহিত একটি দলকে পরিচালনা করতে সক্ষম হবেন, তখন সেই দলের বাকি সদস্যরাও ঠিকমত নিজেদের কাজ সম্পাদন করতে সক্ষম হবে। তাই একজন আদর্শ নেতা হওয়ার জন্য নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
২. উৎসাহ
পূর্ণ উদ্যমে কাজ করার উৎসাহ থাকতে হবে। আপনি যদি উৎসাহ ছাড়াই শুধুমাত্র 'করতে হবে' বলেই করেন, তাহলে সেটি আপনার নেতৃত্বের অযোগ্যতা। তাই একজন লিডার হিসেবে আপনার কাজগুলো উৎসাহের সাথে করতে হবে। এছাড়াও দলের অন্যান্যদেরও উৎসাহ প্রদান করতে হবে। আপনি যখন লিডার হিসেবে আপনার অধীনে থাকা অন্যান্যদের উৎসাহ দিবেন, তখন তাদের উৎসাহ শতগুণে বৃদ্ধি পাবে। তাই নিজের উৎসাহ থাকা এবং অন্যকে উৎসাহ দিতে পারাটা একজন লিডার হিসেবে খুবই জরুরি।
৩. দলের সাথে সরাসরি যুক্ত থাকা
একজন আদর্শ নেতার অন্যতম গুণ হচ্ছে দলের সাথে সরাসরি যুক্ত থাকা। ধরুন, আপনার দল একটি প্রজেক্টে কাজ করছে যেটি মাঠ পর্যায়ের। অথচ আপনি তাদের দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন ঘরে বসেই! তাহলে ব্যাপারটা খুবই বাজে হবে। এখানে দুইটি বিষয় ঘটবে। প্রথমত, আপনার দল সুষ্ঠুভাবে কাজ সম্পাদন করতে ব্যর্থ হবে। দ্বিতীয়ত, দল আপনার ওপর বিরক্ত হবে এবং আপনার ওপর তাদের আস্থা হারাবে। অর্থাৎ, দলের সাথে সরাসরি যুক্ত থেকে কাজ করাটা জরুরি।
৪. অন্যকে বুঝতে পারা
একজন নেতাকে বিভিন্ন ধরনের মানুষের সাথে কাজ করতে হয়। যেমন: সহকর্মী, উচ্চ পদে থাকা কেউ,নিম্ন পদে থাকা কেউ, দলের সাধারণ সদস্য ইত্যাদি। মানুষকে বুঝতে পারা একজন লিডারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্কিল। সহকর্মী কিংবা আপনার উচ্চপদে থাকা কেউ কিংবা আপনার নিম্নপদে থাকা কেউ আপনার সম্পর্কে কী ভাবছে কিংবা আপনার কাছে তারা কী প্রত্যাশা করছেন, এগুলো আপনাকে বুঝতে হবে। তবে, এখানে নিজের দলের সদস্যদেরকে বোঝাটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন। দলের সদস্যদের দূর্বলতা, তাদের প্রতিভার জায়গাটা বুঝলে দলকে পরিচালনা করা আপনার জন্য অনেক সহজ হবে।
৫. নতুন কিছু শেখার মানসিকতা
একজন লিডার হিসেবে আপনি নানা ধরনের মানুষের সাথে মিশবেন। সবাই এক রকম হয় না। কারো না কারো থেকে কিছু না কিছু অবশ্যই শেখার থাকে। এই সু্যোগটাকে কাজে লাগিয়ে আপনি অনেক কিছুই শিখে ফেলতে পারেন, যা আপনার ভবিষ্যত জীবনে কাজে লাগবে। কিন্তু আপনি যদি 'মুই কী হনু রে' টাইপের ধ্যানধারণা নিয়ে সবকিছুকে ইগনোর করেন, তাহলে তো সমস্যা!
৬. না বলে, করে দেখান
দলের সদস্যরা যখন আপনার কাছে কোনো কিছু শিখতে চাইবে, তখন শুধু তাদেরকে সে বিষয়ে মুখের কথার নির্দেশনা না দিয়ে প্র্যাকটিকালি করে দেখান। এতে করে যেমন আপনার নিজের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পাবে, ঠিক তেমনই দলের কাছে আপনার মর্যাদাও বৃদ্ধি পাবে, আদর্শ নেতা হিসেবে যেটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
৭. একটি বিষয়কে বিভিন্ন ভাবে দেখা
একজন আদর্শ নেতা কখনো একটি বিষয়ে একপাক্ষিক দৃষ্টিতে দেখেন না। কেননা, এতে করে তিনি ভুল সিদ্ধান্তও নিতে পারেন! এজন্য একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে সেটিকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে এবং উত্তম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
৮. অন্যদের কাছ থেকে ফিডব্যাক নিন
একজন আদর্শ নেতা হওয়ার জন্য শুধু যে পরিশ্রমের সাথে কাজ করে যেতে হবে, এমন না। আপনার কাজের ফিডব্যাকও নিতে হবে, তাছাড়া আপনি বুঝতে পারবেন না যে আপনি ঠিক পথে আছেন না-কি ভুল পথে! এক্ষেত্রে আপনি আপনার দল এবং কাজ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কাছে ফিডব্যাক নিতে পারেন।
রাতারাতি কখনো আপনি একজন নেতা হয়ে উঠতে পারেন না। এজন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদী কর্মপরিকল্পনা ও কঠোর পরিশ্রম! তবে সবাই নেতা হবে এমন না। সবাই যদি নেতা হওয়ার অসুস্থ্য প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে তবে, তা আমাদের সমাজের জন্য হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে!
- হায়াত মোহাম্মাদ ইমরান আরাফাত