মঞ্চ কাঁপিয়ে দৃঢ় কন্ঠে একজন ব্যক্তি হাজার হাজার মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন! কখনো শ্রোতারা তার কথার সাথে একাত্মতা পোষণ করে তার জয়ধ্বনি দিচ্ছে, আবার কখনো শ্রোতারা খুশি হয়ে হাততালি দিচ্ছে, আবার কখনো-বা শ্রোতারা বক্তার কথার সাথে দ্বিমত পোষণ করছে! সাধারণ অর্থে বক্তার এই বক্তব্য দেওয়াটাই পাবলিক স্পিকিং! বর্তমান সময়ে পাবলিক স্পিকিং খুবই জনপ্রিয় এবং প্রয়োজনীয় একটি স্কিল।
কেন শিখবেন পাবলিক স্পিকিং?
এখন একবিংশ শতাব্দী। প্রতিযোগিতার যুগ। এখন প্রতিটা পদে পদে টিকে থাকার জন্য তুমুল প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে! তবে এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য একাডেমিক পড়াশোনার বাইরেও কিছু সফট স্কিল অর্জন করা প্রয়োজন। পাবলিক স্পিকিং তার তারমধ্যে অন্যতম। নিজেকে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য, নিজের দেশ ও জাতিকে সারাবিশ্বের সামনে সুন্দরভাবে উপস্থাপনের জন্য পাবলিক স্পিকিংয়ের স্কিল খুবই প্রয়োজনীয়। বিশেষ করে যারা নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন করতে চায়, নিজেকে একজন নেতা হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তাদের জন্য পাবলিক স্পিকিং স্কিল অর্জন করা বলতে গেলে বাধ্যতামূলক! পৃথিবীর যত বিখ্যাত নেতা ছিলেন সবাই ছিলেন পাবলিক স্পিকিংয়ে দক্ষ। মার্টিন লুথার কিং, আব্রাহাম লিঙ্কন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রত্যেকেই ছিলেন পাবলিক স্পিকিংয়ে দক্ষ! স্টিভ জবস, বিল গেটস, জ্যাক মা-র কয়েক মিনিটের কথা শোনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোটি কোটি টাকা খরচ করে! আবার তাদের ভিডিয়োগুলোতেও মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ কাউন্ট হয়।
পৃথিবীর অন্যতম ধনী ব্যাক্তি ওয়ারেন বাফেট বলেছেন,
“You can improve your value by 50% just by learning communication skills and public speaking.”
নিজেকে একুশ শতাব্দীর একজন দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে হলে যেসব সফট স্কিল অর্জন করা প্রয়োজন, তার মধ্যে এই পাবলিক স্পিকিং অন্যতম!
কীভাবে পাবলিক স্পিকিং স্কিল ডেভেলপ করবেন?
আমাদের প্রায়ই নানারকম কাজে মঞ্চে কথা বলার প্রয়োজন হয়, আবার অনেক সময় প্রেজেন্টেশন দেওয়ার প্রয়োজন হয়। পাবলিক স্পিকিংয়ে অভ্যস্ত না থাকায় এসব ক্ষেত্রে অনেকেরই হাত-পা কাঁপে, গলা শুকিয়ে যায়, কথা জড়িয়ে যায় এবং সবশেষে পুরো প্রেজেন্টেশনটাই পণ্ড হয়ে যায়। তাই পাবলিক স্পিকিংয়ের স্কিল অর্জন করা জরুরি।
পাবলিক স্পিকিং মূলত একটি আর্ট, আর যিনি স্পিকার তিনি একজন আর্টিস্ট। একেকজনের উপস্থাপনা কৌশল একেকরকম হলেও একটি সুন্দর উপস্থাপনার জন্য কয়েকটি সাধারণ ধাপ অবলম্বন করা জরুরি!
প্রথমেই আপনাকে ঠিক করে নিতে হবে যে আপনি কোন বিষয়ে বক্তব্য দিবেন। যে বিষয়ে বক্তব্য দিবেন সেটি সম্পর্কে যতটা সম্ভব তথ্য যোগাড় করতে হবে। তারপর আপনার বক্তব্যের মূলভাবটি একটি কাগজে লিখে ফেলবেন। তারপর সে অনুযায়ী একটি স্ক্রিপ্ট বানিয়ে ফেলবেন। তবে, স্ক্রিপ্ট বানানোর ক্ষেত্রে কিছু কিছু বিষয়ে সতর্কতা অর্জন করতে হবে। যেমন- আপনার শ্রোতাদের বয়স কেমন? শ্রোতার বয়সের উপর নির্ভর করে স্ক্রিপ্ট সাজাতে হবে, কেননা ছোটোদের অনুষ্ঠানে বড়োদের কথা আর বড়োদের অনুষ্ঠানে ছোটোদের কথা বললে পুরো বক্তব্যটাই মাটি হয়ে যাবে।
এরপর শ্রোতাদের জ্ঞানের পরিধি সম্পর্কে জানতে হবে এবং তার সাথে মিল রেখে একটি ভারসাম্যমূলক স্ক্রিপ্ট তৈরি করতে হবে। আপনি বক্তৃতার জন্য ঠিক কতটুকু সনয় পাবেন, সে অনুযায়ী আপনার বক্তব্য সাজাবেন। কেননা, সময়ের তুলনার বক্তব্য বড়ো হয়ে গেলে আপনি শেষ করতে পারবেন না। স্ক্রিপ্ট সাজানো হয়ে গেলে বারবার অনুশীলন করতে হবে। বিশেষত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অনুশীলন করলে ভালো হবে। বারবার অনুশীলনের মাধ্যমেই আপনি সুন্দর একটি উপস্থাপনা উপহার দিতে পারেন।
একটি ভালো বক্তৃতার জন্য পূর্ব মুহূর্তের প্রস্তুতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এরজন্য নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বক্তৃতাস্থলে পৌছাতে হবে। শ্রোতার উপস্থিতি, অন্যান্য বক্তা, বক্তৃতা কখন দিতে হবে সেটা ভালো করে জেনে নেওয়া জরুরি। এরপর বক্তৃতা দেওয়ার পূর্বে একবার নিরিবিলিতে যেয়ে পুরো বক্তব্যটি ঝালিয়ে নিতে হবে, এতে করে আপনার আত্মবিশ্বাস অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে। বক্তৃতা শুরুর পূর্বে যন্ত্রপাতিগুলো চেক করে নিতে হবে যে, কোনো টেকনিক্যাল ফল্ট আছে কি-না। বক্তব্যের মাঝখানে কোনো কারণে মাইক্রোফোন কিংবা স্পিকার নষ্ট হয়ে গেলে বক্তব্যের আমেজ নষ্ট হয়ে যায়। সবকিছু চেক করে নিয়ে বক্তব্য শুরু করতে হবে!
বক্তব্য কীভাবে শুরু হচ্ছে এবং কীভাবে শেষ হচ্ছে, তার উপরে বক্তব্যের সার্থকতা অনেকাংশে নির্ভর করে। বক্তব্যের শুরু যদি সুন্দর এবং আকর্ষণীয় হয়, তবে শ্রোতারা সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে বক্তব্য শুনতে থাকেন। অন্যথায় তাদের মনোযোগের বিপর্যয় ঘটে! বক্তব্যের শুরু আকর্ষণীয় করার জন্য শুরুতে বক্তব্য রিলেটেড কোনো কৌতুক কিংবা মজার কথা বলা যেতে পারে! তবে তা বলতে হবে শ্রোতাদের সেন্স অফ হিউমার বুঝে।
বক্তব্য দেওয়ার সময় বডি ল্যাঙ্গুয়েজের দিকে খেয়াল রাখাও জরুরি। আপনি কী বলছেন, সেটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, আপনি কীভাবে বলছেন সেটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাই বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ঠিক রাখতে হবে।
বক্তব্যের মধ্যে যদি কোনো ছবি/ভিডিয়ো/পরিসংখ্যান উপস্থাপন করা সম্ভব হয়, তবে তা দর্শকের মনোযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করবে। বক্তব্যের পুরোটা সময় দর্শকের মনোযোগ ধরে রাখতে হবে, তাছাড়া বক্তব্যের গুণগত মান কমে যাবে।
বক্তার কথা বলার ভঙ্গি ঠিক রাখতে হবে। শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলার চেষ্টা করতে হবে এবং আঞ্চলিকতা পরিহার করে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে হবে। যতদূর সম্ভব জড়তা দূর করতে হবে। বক্তব্যের মাঝে ছোটো গল্প/কবিতা/কৌতুক বলে দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করা যেতে পারে!
বক্তব্য যদি একটি মঞ্চে হয়ে থাকে তবে, মঞ্চে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থেকে বক্তব্য দিলে শ্রোতারা মনোযোগ হারায়। তাই পুরো মঞ্চে হেঁটে হেঁটে বক্তৃতা দিলে তা দর্শকের মনোযোগ ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে। আবার যে-কোনো একদিকে তাকিয়ে বক্তব্য দেওয়া মোটেই উচিত নয়! বক্তব্য দেওয়ার সময় সকল দর্শকের দিতেই তাকাতে হবে।
বক্তব্যের শুরুটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, শেষটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাইলে বক্তব্যের শেষটা সুন্দর হওয়া জরুরি। সেক্ষেত্রে পুরো বক্তব্যের সারাংশ তুলে ধরে এর উপকারিতা/ক্ষতির দিক আলোচনা করে বক্তব্য শেষ করা উত্তম। বক্তব্য শেষ হলেই মঞ্চ ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত নয়। শ্রোতাদের রেসপন্সের জন্যও অপেক্ষা করা উচিত। শ্রোতারা করতালি দিয়ে অভিবাদন জানালে তাদেরকে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানানো উত্তম! আবার কেউ কোনো প্রশ্ন করলে তার উত্তর দেওয়াও উচিত।
একজন আদর্শ পাবলিক স্পিকার হওয়ার জন্য নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস আনাটা খুবই জরুরি! সকল বিষয়ে নেতিবাচক ধারণা থেকে দূরে থাকতে হবে। বর্তমানকালের এই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের সাথে টিকে থাকার জন্য বিভিন্ন সফট স্কিল অর্জন করা অত্যন্ত জরুরি!
- হায়াত মোহাম্মাদ ইমরান