পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার শব্দটি খুবই নতুন এবং গত শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে এই শব্দের ব্যবহার শুরু হয়। কিন্তু অনেক আগে থেকেই এই সমস্যা বা রোগটি নিয়ে মানুষ গবেষণা করে আসছে। শারীরতত্ত্ববিদ JC Prichard ১৮৩৫ সালে ব্যক্তিত্ত্বের এই সমস্যাকে “moral insanity” বলে অভিহিত করেন। এরপর মনোরোগবিদ Emil Kraepelin ১৮৯৬ সালে “psychopathic personality” শব্দটি ব্যবহার করেন। তিনি ব্যক্তিত্ত্বের কয়েকটি ধরণ উল্লেখ করেন যা পরবর্তীকালে ১৯২৩ সালে একটি আমেরিকান জার্নালে Diagnostic and Statistical Manual of Mental Disorders 5th Revision (DSM-5) নামক শিরোনামে প্রকাশিত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীতে মোট জনসংখ্যার ১০ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে ব্যক্তিত্বের সমস্যা বা ‘পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার’ রয়েছে।
ব্যক্তিত্বের সমস্যাগুলোকে প্রথমত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলোকে বলা হয় ‘ক্লাস্টার’। ক্লাস্টার ‘এ’ তে রয়েছে- প্যারানয়েড, সিজয়েড ও সিজোটাইপাল ধরনের ব্যক্তিত্বের সমস্যা। ক্লাস্টার ‘বি’ তে রয়েছে- অ্যান্টিসোশ্যাল, বর্ডারলাইন, হিস্ট্রিয়োনিক ও নার্সিসিস্টিক ধরনের ব্যক্তিত্বের সমস্যা এবং ক্লাস্টার ‘সি’ তে আছে- অবসেসিভ-কমপালসিভ, এভয়ডেন্ট ও ডিপেনডেন্ট ধরনের ব্যক্তিত্বের সমস্যা। ব্যক্তিত্বের এই সমস্যাগুলোর যেমন বিভিন্ন ক্যাটাগরি আছে তেমনি সমাধানেরও উপায় আছে।
প্যারানয়েড পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার:
এরা সাধারণত অহেতুক সন্দেহপ্রবণ, সহজে কাউকে বিশ্বাস করতে চায় না, পরশ্রীকাতর, অনুভূতিপ্রবণ, প্রায়ই বিরক্ত-অসন্তুষ্ট থাকে। এরা নিজেকে সব সময় অন্যদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে থাকে। এই পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারের ভুক্তভোগীরা অন্যদের সাহচর্য এড়ানোর চেষ্টা করে। এটি সাধারণত নারীর তুলনায় পুরুষের মধ্যে বেশি দেখা যায়।
সিজয়েড পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার:
এদের আবেগ থাকে কম, একা থাকতে পছন্দ করে, আনন্দের অনুভূতি কম থাকে, তবে এদের অন্তর্দৃষ্টি অন্যদের চেয়ে বেশি থাকে। এরা খুব কম সময়ই ধারণা করে তাদের সমস্যা আছে। নিজেদের নিয়ে সব সময় খুব কনফিডেন্ট থাকে। কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে অন্যের হস্তক্ষেপ পছন্দ করেনা। সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্কের ব্যাপারে সবসময় উদাসীন থাকে।
সিজোটাইপাল পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার:
এ ধরনের ব্যক্তিত্বের মানুষ সামাজিকতা এড়িয়ে চলে, সামাজিক উদ্বিগ্নতায় ভোগে। অনেক সময় এরা মনে করে, এরা অন্যদের মনের কথা বুঝতে পারে। মাঝেমধ্যে মনে করে, অন্যরা সব সময় তাকে নিয়ে সমালোচনা করছে। তাদের কথোপকথনে অসামঞ্জস্যতা থাকতে পারে। নিজেদের অন্যের সামনে উপস্থাপন করার সময় এরা প্রায় সময়ই উপযুক্ত শব্দ খুঁজে পান না। এরা বেশ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে থাকে।
অ্যান্টিসোশ্যাল পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার:
এই ডিসঅর্ডার সাধারণত আঠারো বছরের আগে হয় না। এই ডিসঅর্ডারের দরুণ মানুষের আচরণ হয় নির্মম। অন্যের প্রতি এদের কোনো অনুভূতি থাকে না। এরা দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়, হঠাত করে রেগে যায়, মেজাজ হয় খিটখিটে। অপরাধ করলেও এদের মধ্যে কোনো অপরাধবোধ বা অনুতাপ থাকে না এবং এরা পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব এড়িয়ে চলতে পছন্দ করে। ছোট থেকে বড় নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে এরা জড়িয়ে যেতে থাকে অনবরত।
বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার:
এরা অস্তিত্বের সংকটে ভোগে, কারও সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক বজায় রাখতে পারে না। এদের আবেগের বহিঃপ্রকাশ কেমন হবে, তা আগে থেকে ধারণা করা যায় না। এরা হঠকারী আচরণ করে, নিজের ক্ষতি নিজে করে ফেলতে পারে এবং হাত-পা ধারালো অস্ত্র বা ব্লেড দিয়ে কাটে, দেয়ালে মাথা ঠুকে ইত্যাদি। খারাপ কোনো ঘটনা ঘটলে সেজন্য নিজেকে দায়ী করে।
হিস্ট্রিয়োনিক পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার:
অন্যকে প্রভাবিত করার একটি দারুণ ক্ষমতা এদের আছে; সেটি ইতিবাচক বা নেতিবাচক উভয় ক্ষেত্রেই হতে পারে। তবে এ ধরনের মানুষের অনুভূতিগুলো খুব একটা গভীর নয়। শারীরিক সৌন্দর্যকে এরা বেশি গুরুত্ব দেয়। অন্যের মনোযোগ পেতে এরা ভালোবাসে। খুব সহজেই অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়। যে কোনো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিজেকে রাখার জন্য এরা যেকোনো কিছু করতে পারে।
নার্সিসিস্টিক পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার:
নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে, গ্রিক দেবী নার্সিসিসের মতো এরা নিজেকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। নিজেকে এরা অনেক বড় মনে করে এবং অন্যদের চেয়ে আলাদা ভাবে। নিজেদের ক্ষমতা সম্পর্কে এরা অনেক উচ্চ ধারণা পোষণ করে। এরা অন্যের প্রশংসা চায়। কিছুটা স্বার্থপর ও হিংসুটে স্বভাবের হয়ে থাকে। অন্যের মতামতের মূল্য এদের কাছে কম। নার্সিসিজম এখনকার জেনারেশনের মাঝে খুবই কমন একটা ব্যাপার, কিন্তু তারপরেও এটি কিন্তু একটি পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার!
এভয়ডেন্ট পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার:
এরা সব সময় টেনশনে ভোগে। সমাজের অন্যদের চেয়ে এরা নিজেকে ছোট মনে করে। হীনমন্যতা থাকে এদের মধ্যে। সব সময় ভাবে, অন্যরা তাদের প্রত্যাখ্যান করবে। সামাজিক কর্মকাণ্ডে এরা সাধারণত নিজেকে যুক্ত করে না এবং যেকোন নতুন কাজে যুক্ত হবার ঝুঁকি নিতে ভয় পায়। অনেকের মধ্যে থাকলেও এরা নিজেদের একা ভাবে। নিজের দায়িত্ব নিতে এরা সব সময় ভয় পায়।
অবসেসিভ-কম্পালসিভ পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার:
নিয়মনীতি কঠোরভাবে মেনে চলতে চায় এ ধরনের ব্যক্তিত্বের সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা। সবকিছুর মধ্যে পারফেকশন খুঁজে বেড়ায় এবং স্বভাবটা হয়ে যায় খুঁতখুঁতে। এরা অপেক্ষাকৃত দৃঢ়চেতা হয়, বেশি কাজ করতে পছন্দ করে। সতর্ক থাকা অন্যকে সন্দেহ করা এদের আরেক বৈশিষ্ট্য। সে চায় অন্যেরা তার নির্দেশনা অনুযায়ী চলুক। নিজের চিন্তাভাবনা ও যুক্তি সঠিক না হলেও তাতে অটল থাকে। নিজের এবং অন্যদের জন্য কাল্পনিক ও অপূরণযোগ্য নীতি ও সময়সীমা নির্ধারণ করে।
বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার
লক্ষণ এবং শনাক্তকরণ
বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের লক্ষণগুলো বিভিন্নভাবে প্রকাশ পেয়ে থাকে। তবে চিকিৎসা এবং শনাক্তকরণের সুবিধার জন্য বিশেষজ্ঞরা এর লক্ষণগুলোকে নয়টি প্রধান ভাগে ভাগ করে থাকেন। কারো মাঝে বিপিডি শনাক্ত করার জন্য তার মধ্যে এই নয়টি লক্ষণের অন্তত ৫টি থাকতে হবে এবং লক্ষণগুলো দীর্ঘস্থায়ী হতে হবে। এই নয়টি লক্ষণ জানা যাক এবার।
১. নিঃসঙ্গ হয়ে যাওয়ার ভয়
২. অস্থিতিশীল সম্পর্ক
৩. নিজেকে নিয়ে অস্পষ্ট ধারণা
৪. অতিরিক্ত আবেগপ্রবণতা এবং স্ব-ধ্বংসাত্মক আচরণ
৫. আত্মহত্যার প্রবণতা ও নিজের ক্ষতি করা
৬. আবেগীয় ভারসাম্যহীনতা
৭. প্রতিনিয়ত শূন্যতা অনুভব করা
৮. ধ্বংসাত্মক রাগ
৯. সন্দেহপ্রবণতা এবং বাস্তবতা থেকে দূরে থাকা
কারণ:
কেউ কেউ মনে করেন মস্তিষ্কে যে সমস্ত রাসায়নিক পদার্থ মেজাজকে কনট্রোল করে তার কোন হেরফের হলে এধরনের বর্ডার লাইন পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার দেখা দিতে পারে। আবার অনেক সময় দেখা যায় এটি বংশগত।
শৈশবে কোন মানসিক আঘাত থেকেও এটা হতে পারে। যেমন অবহেলা, বাবা-মা’র মৃত্যু, কোন কিছুর অমর্যাদাকর কিংবা চরম অপব্যবহার ইত্যাদি। ফলে তারা বড় হয়েও সেগুলো ভুলতে পারে না, সর্বদা উদবিগ্ন থাকে, মানসিক চাপে থাকে।
All credit : 10MS SCHOOL , ROAR MEDIA