মস্তিষ্ক থেকেই রাগের নির্দেশ আসে। কিন্তু সে আদেশকে নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের শরীর এবং সমাজও। রাগ ও অ্যাংগার এই শব্দ দু’টির সঙ্গে আমরা পরিচিত। কিন্তু এটা কি কখনো ভেবে দেখেছি, মস্তিষ্কের কোন জায়গাটায় কোনো রাসায়নিক বা শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন ঘটে গেলে মানুষ রেগে যেতে পারে? এর পেছনের বিজ্ঞানটা কি এখনো মানুষের আয়ত্তে এসেছে, যাতে করে অঙ্ক কষে বলে দেওয়া যায় এই মানুষটি এতটা রাগী। নাকি আমাদের আচরণ বা ব্যবহার কিংবা কোনো মানসিক অবস্থার বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে এই রাগ বিষয়টি। রাগ আসলে কী?
রাগের সঙ্গে বিজ্ঞান যেমন জড়িয়ে। তেমনই সেই বিজ্ঞানের পিছনেও রয়েছে কিছু সামাজিক কারণ। কাজেই বিষয়টা সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা যেতে পারে। রাগের উদ্রেগ হওয়ার একটা বড় কারণ বাইরের হুমকি কিংবা কাজের জায়গায় হুমকি। যেমন ধরা যাক, কেউ বন্দুক দেখিয়ে আক্রমণ করবে বলে ভয় দেখাল কিংবা ঘাড়ের কাছে বন্দুক এনে ঠেকাল। তখন তো একটা ভয় অনুভব করব। সেখান থেকে রাগের উদ্রেক হতে পারে। মস্তিষ্কের অ্যামিগডালা অংশ থেকে এটি সক্রিয় হয়। রাগের জৈবিক কারণ বলা যেতে পারে এটাকে। এই রাগের আবেগটি নিয়ন্ত্রিত হয় মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল কর্টেক্স থেকে।
দ্বিতীয়ত হতাশা। আমরা কোনো কাজ করার পর তার পুরস্কার চাই। সেই পুরস্কার না পেলে একধরনের হতাশা তৈরি হয় আমাদের মনে। এটাই মানব প্রকৃতি। যেমন কোনো ছাত্র বেশি খাটল, কিন্তু তার পরিশ্রমের দাম পেল না। কিংবা অফিসে বা সৃজনশীল ক্ষেত্রে কেউ ভালো কিছু করল, কিন্তু কোনো প্রশংসা পেল না। এই হতাশা থেকে রাগের উৎপত্তি হয়।
মানবিক আচরণ, প্রত্যাশা এবং তার পরিপূরণ পরস্পর সম্পর্কিত। ধরা যাক, স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে একটা চাহিদা পূরণের ফাঁক থেকে যাচ্ছে। অথবা অন্যেরা চাইছে, কেউ একটা তাদের কথা মেনে কিছু করুক। মা হয়তো চাইছে, ছেলে পড়াশোনা করুক। এইগুলো হচ্ছে রাগ সৃষ্টির সামাজিক-¯œায়ুতান্ত্রিক-জৈবিক কারণ।
আমাদের মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোব নানা অসুখের কারণে কাজ করা বন্ধ করে দেয়। সেটা কখনো স্ট্রোক, মৃগিরোগ বা ডিমেনশিয়ার কারণে হতে পারে। এক্ষেত্রে ফ্রন্টাল লোব ঠিক মতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আবার মানসিক সমস্যা যেমন, স্কিৎজোফ্রেনিয়া, এডিএইচডি কিংবা সাবস্ট্যান্স ইউজের ফলেও ফ্রন্টাল লোব কাজ করতে পারে না। বিশেষ করে নেশা-করা বা সাবস্ট্যান্স ইউজের ফলে তো ফ্রন্টাল লোবের ডোপামিন কমে যায়। যার ফলে রাগের উদ্রেক হতে পারে।
এছাড়া আছে পিটিএসডি (পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেট ডিজঅর্ডার) আগের কোনো ঘটনা বারবার মনে পড়তে থাকলে, তার থেকে থ্রেট অনুভব করলেও মানুষের রাগ হতে পারে। বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারের ক্ষেত্রেও রাগ একটা বড় জায়গা। যারা আবার অপরাধ-মনস্ক হয়, তারাও নিজেদের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
বন্ধুরা, বেশ কিছু এমন মেন্টাল কন্ডিশন বা মানসিক পরিস্থিতি আছে, যার সঙ্গে রাগ জড়িত। অর্থাৎ আমাদের যদি সেই ধরনের মানসিক অসুখের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, আমরা রেগে যেতে পারি। অনেক ক্ষেত্রেই সেটা হয়। বেশ কয়েকটি এমন রোগ রয়েছে, যার সঙ্গে রাগ চলে আসে। যেমন ধরা যাক, স্কিৎজোফ্রেনিয়া। এই ধরনের রোগীদের ক্ষেত্রে দেখা যায় তারা খুব রেগে যাচ্ছেন। কিংবা এপিলেপ্সি বা মৃগিরোগ। সবসময়ই যে মৃগি রোগীরা জ্ঞান হারান তা কিন্তু নয়, এমন অনেক সময় আসে যখন তাঁরা খুব রেগে যান। বাইপোলার ডিসঅর্ডারের ক্ষেত্রেও এটা দেখা গেছে। এ রকম আরো কয়েকটি ক্ষেত্রে রাগের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। তাহলে কি রোগের সঙ্গে রাগের সম্পর্ক আছে? তা হয়তো আছে, কিন্তু সেটা নিশ্চিত হতে গেলে আমাদের ঠিকমতো রোগনির্ণয় করতে হবে। ডায়াগনোসিস ঠিকমতো হলে, সেই অনুয়ায়ী চিকিৎসারও ব্যবস্থা করতে হবে।
বন্ধুরা, উসকানিমূলক এবং অ-উসকানিমূলক আচরণকে মনস্তত্তে¡ খুবই গুরুত্ব দিয়ে বিচার করার চেষ্টা করা হয়। রাগও এই দু’ধরনের আচরণগত ধরনের মধ্যে পড়ে। অর্থাৎ আমরা যে ব্যবহারটা যে সময় করার কথা, তখন কতটা করছি। কেউ হয়তো প্রচÐ রেগে যাচ্ছে। অথচ তার কিন্তু তেমন কোনো মানসিক পরিস্থিতি নেই। আবার কেউ রেগে যাচ্ছে মানসিক অসুস্থতার কারণে। যেমন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হচ্ছে। কেউ কারো ওপরে চিৎকার করছে। তার মধ্যেও উসকানিমূলক এবং অ-উসকানিমূলক দিক থাকতে পারে। সেটা বিচার করার জন্য ডায়াগনোসিস প্রয়োজন। হয়তো দেখা যেতে পারে, কারো পারিবারিক ইতিহাস রয়েছে রেগে যাওয়ার। অনেকেই বলেন, রাগী বংশের লোক। বলেন, এটা জেনেটিক। কিন্তু রাগ বা অ্যাংগার বিষয়গুলো হচ্ছে অনেকটাই শেখা আচরণ। তার সঙ্গে জিনের সম্পর্ক তেমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। উসকানিমূলক আচরণের ক্ষেত্রে সমস্যার কিছু নেই। যদি তা অ-উসকানিমূলক হয়, অর্থাৎ সেটা কোথাও রয়ে গেছে মনের মধ্যে ধিকধিক করে জ্বলা আগুনের মতো, তাহলে কিন্তু কোনো মানসিক রোগের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।
লিম্বিক লোবের কারসাজি : রাগ এবং রাগের সঙ্গে জড়িত বিজ্ঞানের সঙ্গে নিশ্চিতভাবেই আমাদের মস্তিষ্কের সম্পর্ক আছে। মস্তিষ্কের লিম্বিক লোব থেকে ফ্রন্টাল লোবের দিকে যখন আমাদের নির্দেশগুলো আসতে থাকে, তখন যদি ব্রেকফেল হয়, তাহলে যে অবস্থা হবে, রাগও সেরকম। শুধু রাগ নয়, আবেগগত ভারসাম্যহীনতা, তা সে যে কোনো রকমের হোক, এই ব্রেকফেলের কারণেই হয়। কাজেই ওই অংশেই হয়তো লুকিয়ে রয়েছে রাগের রহস্য। তবে একটা বিষয় অনেকেই ভুল জানেন, তা হলো বেশি রাগী বা কম রাগী মাপার যন্ত্র এখনো আবিষ্কার হয়নি। অর্থাৎ যেমন করে আমরা বুদ্ধ্যঙ্ক বা ইন্টেলিজেন্স কোশেন্ট দিয়ে বুদ্ধিমত্তা পরিমাপ করতে পারি, তেমন করে রাগ মাপা সম্ভব নয়। হ্যাঁ, অবশ্যই তার কম-বেশি তারতম্যের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে তো বটেই। লিম্বিক লোব আমাদের কর্টেক্সের মধ্যে থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। লিম্বিক লোবের মধ্যে অ্যামিগডেলা, হিপোক্যাম্পাসের মতো অংশ রয়েছে, যা আমাদের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের সঙ্গে জড়িত। অ্যামিগডেলাকে বলা হয় ‘আবেগগত স্মৃতির গুদাম’। এও বলা হয়, এখান থেকেই আমাদের মস্তিষ্ক সিদ্ধান্ত নেয়, ‘ফাইট অর ফ্লাইট’-এর। অর্থাৎ, আমাদের স্বাভাবিক সারভাইভ্যাল ইনস্টিংক্ট এই অংশের মধ্যে থেকেই জন্ম নেয়। যখন কেউ রেগে যাচ্ছে, তার মানে তার লিম্বিক সিস্টেম প্রচÐভাবে কাজ করতে শুরু করেছে। সেই রাগের বহিঃপ্রকাশের অর্থ, সে কর্টেক্স-এর (যেখানে ভাবনাচিন্তা তৈরি হয়) ব্যবহার করতে পারছে না, সে শুধুই লিম্বিক সেন্টারের নির্দেশই মানছে। কর্টেক্স হলো, আমাদের ‘লজিক’ বা ‘জাজমেন্ট’ তৈরি করার জায়গা। সেই জায়গাটি কাজ না করলেই আমরা আতিশয্য দেখাব। রেগে যাব, অহেতুক চেঁচাব বা এমন ব্যবহার করব যার মধ্যে কোনো যুক্তি নেই।
অর্থাৎ রাগের সঙ্গে শরীরের সম্পর্কটা অনেক বেশি প্রতিষ্ঠিত। তবে এই যে কারণগুলো বলা হলো, বা রাগের নির্ধারক হিসেবে মস্তিষ্কের লিম্বিক লোবের কথাও যে বলা হল, তার অনেকটাই কিন্তু এখনো গ্রে-এরিয়ায়, অর্থাৎ, ধূসর এলাকায়। আমরা হয়তো জানি, যে এই কারণে রাগ হয় বা ওই কারণে হয়। জানি, কোন ধরনের ব্যবহার বা মানসিক পরিস্থিতির সঙ্গে রাগের কতটা সম্পর্ক থাকতে পারে, উসকানিমূলক বা অ-উসকানিমূলক পরিস্থিতির কথাও বলা হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে একটাই কথা বলা দরকার, সবটাই কিন্তু খানিকটা কোভিড-১৯’এর পরিস্থিতির মতো। আমরা জানি, বয়স্করা বেশি অরক্ষিত, কাদের ভয় আছে কাদের ততটাও নেই। কিন্তু তার বাইরেও তো এমন ঘটনা ঘটছে, যা আমাদের ভাবনাচিন্তার বাইরে। রাগও সে রকমই। কোন অংশের সঙ্গে এর যোগ, তা এখনো পর্যন্ত নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই। রাগের বিজ্ঞান নিয়ে এখনো অনেক গবেষণাই বাকি।
- ডা. আশরাফ হোসেন