ফ্যাক্টস :
প্রিয় পাঠক, ওপরের গল্পটার প্রায় সবটুকুই সত্যি। অবিশ্বাসের কোনো কারণ নেই। কেউ কেউ হয়তো বলবেন, নিউটনের মাথায় আপেল পড়েনি, পড়েছিল সামনে, মাটিতে। এইটুকু পার্থক্যে গল্পে মিশে থাকা ইতিহাসের ফ্লেভার নষ্ট হয় না। কিন্তু আপনি যদি চিন্তাশীল পাঠক হন, তাহলে গল্পের শেষ দুলাইন কি, আপনার মনে প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে না? একটা কালজয়ী তত্ত্বের জন্ম কি এভাবে হুট করেই হয়? এখানেই আসলে মিথ আর ফ্যাক্টের মধ্যে ফারাক। শেষের দুলাইন ইতিহাসটাকে মিথে পরিণত করেছে, যিঁনি কখনো বিজ্ঞানের আল মাড়াননি, তিনিও অবলীলায় রায় দিয়ে দেন, আপেল পড়েছিল বলেই নিউটন মহাকর্ষ সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন।
আসল ঘটনা কিন্তু তা নয়। নিউটন যে চিন্তা করেছিলেন আপেল পড়া দেখে, সে প্রশ্নের বয়স কিন্তু কয়েক হাজার বছরের। গ্রিকদের হাতে যখন আধুনিক সভ্যতার গোড়াপত্তন হচ্ছে, তখনও এই প্রশ্ন করত মানুষ, কোনো বস্তুকে ওপর দিকে ছুড়ে মারলে কেন আবার নীচে ফিরে আসে? কিংবা গাছের ফল কেন নিচে পড়ে? আর এসব প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলনে সে যুগে যাঁকে সর্বজ্ঞানী মনে করা হত, সেই গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল। তাঁর, জবাব ছিল যেসব বস্তু স্বর্গীয় নয়, সেগুলোকে ওপর দিকে ছুড়ে মারলে আবার তা নীচে ফিরে আসে। এসব বস্তুর সঙ্গে পৃথিবীর একটা ভাব-ভালোবাসা আছে। অন্যদিকে যেসব বস্তু স্বর্গীয়, তাদের সঙ্গে পৃথিবীর ভাবভালো বাসা কম, তারা সুযোগ পেলেই পৃথিবী ছেড়ে স্বর্গের পথে পাড়ি দেয়। ধোঁয়া, জলীয় বাষ্প ইত্যাদি উদ্বায়ী পদার্থকে অ্যারিস্টটল স্বর্গীয় বস্তু বলে মনে করতেন।
আপেল পড়ার ঘটনা থেকেই যদি মহাকর্ষ সূত্রের হঠাৎ জন্ম হতো, তাহলে অ্যারিস্টটলের চিন্তার সূত্র ধরে অনেক আগেই আবিষ্কৃত হয়ে যেত মহাকর্ষ তত্ত্ব।
মহাকর্ষ সূত্রের পথে বিজ্ঞান এগিয়ে যায় জার্মান বিজ্ঞানী কোপার্নিকাসের গবেষণার মাধ্যমে। আধুনিক যুগে তিনিই প্রথম অ্যারিস্টটলের বিরোধিতা করে বলেছিলেন, পৃথিবীকে কেন্দ্র করে গ্রহ-নক্ষত্রগুলো ঘুরছে না, বরং সুর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে গ্রহ নক্ষত্রগুলো। তিনি কিছু যুক্তি প্রমাণও দেখিয়েছিল। কিন্তু খ্রীষ্টানদের ধর্মগুরুরা সেটা মানতে পারেননি, কারণ, বাইবেলের বাণীগুলো অ্যারিস্টটলের মতের সঙ্গে মিলে যেত। কোপার্নিকাসের মতকে তাই বাইবেলবিরোধী আখ্যা দেওয়া হয়। তাঁর লেখ বইপত্রগুলো পুড়িয়ে ধংস করার চেষ্টা করেছিলেন ধর্মগুরুরা।
পরে কোপার্নিকাসের মতকেই জোরেশোরে প্রচার করেছিলেন তরুণ ধর্মগুরু জিওর্দানো ব্রুনো। সেই অপরাধে তাঁকে পুড়িয়ে মারা হয়। কিন্তু সমসাময়িক দুই বিজ্ঞানী, যাঁরা পরীক্ষা নীরিক্ষামূলক বিজ্ঞানের পথপ্রদর্শক, গ্যালিলিও আর কেপলার- তাঁরা সত্যি সত্যি গবেষণা শুরু করেন।
১৬১০ সালে নেদারল্যান্ডের চশমা বিক্রেতা হ্যান্স লিপারশেই তৈরি করে বসেন এক আশ্চর্য যন্ত্র। যন্ত্রটা দেখতে নলের মতো, এর দুই মাথায় বসানো আছে দুটি লেন্স। আর সেটার ভেতর দিয়ে তাকালে অনেক দূরের জিনিস খুব কাছে চলে আসে! সেই যন্ত্রখানা যেভাবেই হোক নেড়েচেড়ে দেখার সুযোগ পান গ্যালিলিও। তিনি তখন বিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে কাজ করছেন, সেগুলোর পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করে দেখছেন। আকাশের তারাদের চালচলন নিয়েও চলছিল তাঁর কাজ। সেই সময় ওই লেন্সওয়ালা নলটা তাঁর জন্য আশির্বাদ হয়ে এলো। কিন্তু যন্ত্রটা ঠিক জুৎসই নয়। তাঁর মনে হলো, চেষ্টা করলে তিনি আরও ভালো যন্ত্র বানাতে পারবেন। সত্যি সত্যি কিছুদিনের মধ্যে তৈরি করে ফেললেন আকাশ পর্যবেক্ষণের উপযোগী একটা টেলিস্কোপ। গ্রহ-নক্ষত্রের চালচলন তো দেখলেনই, আবিষ্কার করে ফেললেন বৃহস্পতি গ্রহের চার চারটি চাঁদ!
গ্যালিলিওর তৈরি সেই টেলিস্কোপ যেভাবেক হোক পৌছে যায় কেপলারর হাতে। গ্যালিলিওর চোখ (বঙ্গানুবাদ) উপন্যাসে লেখক জাঁ পিয়েরে লুমিনে দাবি করছেন, গ্যালিলিওর সঙ্গে কেপলারের পত্রালাপ হত নিয়মিত আর গ্যালিলিও তাঁর তৈরি একটা টেলিস্কোপ উপহার হিসেবে পাঠিয়ে দেন কখনো দেখা না হওয়া বন্ধু কেপলারের ঠিকানায়। আর এ ঘটনাই ঘুরিয়ে দেয় মহাকাশচর্চার ইতিহাসে মোড়। কেপলার সেই টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ করেন। গ্রহদের গতি-প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে কয়েকটি সিদ্ধান্তে আসেন। সেই সিদ্ধান্তগুলোও পরে পরিণত হয় একেকটি সূত্রে। আর সেগুলোই ছিল মহাকর্ষ সূত্রের প্রাচীন রূপ।
পৃথিবীকেন্দ্রিক যে মহাবিশ্ব ছিল, কিংবা কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক মহাবিশ্ব, সেগুলোতে মনে করা হতো গ্রহনক্ষত্রদের কক্ষপথ বুঝি গোল। কিন্তু কেপলার পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন, গ্রহদের কক্ষপথ মোটেও গোল নয়, বরং উপবৃত্তাকার। আবার উপবৃত্তের ঠিক মাঝখানেও অবস্থান করে না সূর্য। অর্থাৎ সূর্যকে উপৃত্তেরর একদিকে একটি ফোকাসে রেখে কক্ষপথ তৈরি করে গ্রহগুলো।
কেমব্রিজে যখন পড়ছেন নিউটন, ইউরোপের সেরা কয়েকজন বিজ্ঞানীর কাজ তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে- কোপার্নিকাস, কেপলার আর গ্যালিলিওর। আরব বিজ্ঞানীদের করা আলোকবিদ্যা কিংবা রজার বেকনের সেসব নিয়ে বিস্তর গবেষণার খবরও অজানা ছিল না নিউটনের। নিউটন কেপলারের তত্ত্বগুলো নিয়ে ভাবতে থাকেন। সেই ভাবনাগুলোই পরে ডালপালা মেলে প্লেগের সময়, উলসথ্রোপ গ্রামে। নিউটন কেপলারের সূত্রগুলো গাণিতিকভাবে প্রমাণ করেন। গ্রহগুলো কেন সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে এর জবাব কেপলারের সূত্রে ছিল না। নিউটন সেই জবাবটাই আবিষ্কার করেন।
একটা আকর্ষণ বলের ধারণা মাথায় আসে নিউটনের মাথায়। তখন আকর্ষণ বলতে মানুষ জানত শুধু চুম্বকের কথা। একটা চুম্বক যেমন চৌম্বক পদার্থকে আকর্ষণ করতে পারে, তেমনি গ্রহ-নক্ষত্রগুলোও পরস্পরকে আকর্ষণ করে। তবে নিউটন এই আকর্ষণের ধারণাটা আরেকটু বিস্তৃত করেন। তিনি নিশ্চিত হন, যে আকর্ষণের কারণে সূর্যের চারপাশে পৃথিবী ঘোরে, সেই একই আকর্ষণের কারণে গাছের আপেল মাটিতে পড়ে। আর নিউটনের বাতিক ছিল সবকিছুকে গণিতের কাঠামোতে রূপদান করা। তাঁর এই প্রবণতাই আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ভিত গড়ে দেয়। মহাকর্ষ সুত্রেরও একটা গাণিতিক কাঠামো খোঁজেন তিনি ।
এবার আসা যাক আপেলের কথায়। নিউটনের প্রথম জীবনী লেখেন আরেক বিজ্ঞানী ডেভিড বিউস্টার। সেই জীবনীতে কিন্তু আপেলের গল্পটা ছিল না। তারমানে বিউস্টার এ ঘটনাকে বিশ্বাস করেননি। এটাকে স্রেফ গাজাখুঁরি গল্প মনে করে এড়িয়ে গেছেন। তাহলে এ গল্প ডালপালা মেলল কীভাবে? নিউটন কি কাউকে বলেছিলেন এই গল্প?
বলেছিলেন, সম্ভবত তাঁর ভাগ্নি কুহুইটেকে। এর পক্ষে শক্তিশালী কোনো প্রমাণ নেই। তবে গণিতবিদ অগাস্ট দ্য মর্গানের অ্য বাজেট অব প্যারাডক্সেস বই থেকে। এও জানা যায়, কুহুইটের মুখ থেকেই নাকি এ গল্প ছড়িয়ে পড়ে। মজার ব্যাপার হলো, কুহুইটকে এ গল্প নিউটন বলেছিলেন প্লেগ-মহাররীর ৫০ বছর পর। এত বছর পর কেন বললেন, নিউটন?
মানুষ ফ্যান্টাসি পছন্দ করে, তাই তো সুপারহিরো সিরিজগুলোর এত কদর। বড় লোকের মেয়ের সঙ্গে রিকশাওয়ালার প্রেম টাইপের সিনেমাগুলো নানা স্বাদে, নানাভাবে দৃশ্যায়ন করে নানা নামে নব্বই দশকে বাজারে ছাড়ে সিনেমাওয়ালারা। সে সব সিনেমা দেখতে মারকাটারি ভিড় হত হলগুলোতে। বাস্তবের নায়কদের মধ্যেও এমন ফ্যান্টাসি খোঁজেন সাধারণ মানুষ, তাই গরীব উদ্ভাবক নিকোলা টেসলাকে আইনস্টাইনের চেয়েও বড় বিজ্ঞানী দাবি করে বসেন কেউ কেউ, ভাবতে ভালোবাসেন সরাসরি বাঁধাইখানার কর্মচারি থেকে বিজ্ঞানী বনে গিয়েছিলেন ফ্যারাডে।
নিউটন ধনী ঘরের সন্তান। হ্যাঁ, তিনি অন্যের বাড়িতে চাকরের মতো খেটে পড়াশোনার খরচ যুগিয়েছেন। এ নিয়েও ফ্যান্টাসি তৈরি হতো পারত, কিন্তু ফ্যানাটিকদের কাছে যে আরও বড় উপকরণ রয়েছে ফ্যান্টাসিকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার। হুট করে একটা আপেল মাটিতে মতান্ত্বরে মাথায় পড়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে সর্বকালের অন্যতম সেরা একটি তত্ত্ব আবিষ্কার হয়ে যাওয়ার ঘটনা ভাবতে ফ্যান্টাসিপ্রেমীরা রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করবে, সেটাই স্বাভাবিক। নিউটনের ভাগনিও এমন ফ্যান্টাসিই মামার মুখ থেকে শুনতে চেয়েছিলেন, মামাও ভাগনির হাবভাব বুঝে গল্পটা শুনিয়ে দেন।
আপেলের গল্প যদি সত্যিই হবে, তো পঞ্চাশ বছর পর নিউটনক ভাগনিকে শোনাতে গেলেন কেন? কোনো কথা বা গবেষণা পেটে রাখার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল নিউটনের। তাই ১৬৬০ এর দশকে করা তাঁর গবেষণার কথা বিশেষ করে মহাকর্ষ সূত্রের কথা কাউকে জানাননি নিউটন। চেপে রেখেছিলেন প্রায় বিশ বছর। ১৬৮০ দশকে প্রিয় বন্ধু এডমন্ড হ্যালি, যাঁর নামে হ্যালির ধূমকেতু, তাঁর কাছে প্রথম ফাঁস করেন মহাকর্ষ সূত্রের কথা। বিশেষ করে, হ্যালি তখন বিশেষ একটা ধূমকেতু নিয়ে গবেষণা করছেন, যেটা ৭৬ বছর পর পর ফিরে আসে। তার বাখ্যা খুঁজতে গিয়েই গ্রহদের কক্ষপথ, চালচলন ইত্যাদি নিয়ে বিস্তর জানার প্রয়োজন পড়ে হ্যালির। কেপলারের সূত্রগুলো হ্যালিকেও আকৃষ্ট করে, কিন্তু এগুলোর গূঢ়ার্থ বোধগোম্য হচ্ছিল না হ্যালির কাছে, তাই তিনি নিউটনের শরণাপন্ন হন। নিউটন তাঁকে বিস্মিত করে দিয়ে বলেন, কেপলারের সূত্রগুলোর সমাধান তিনি বিশ বছর আগেই করেছেন একটি মাত্র সূত্রের মাধ্যমে।
লেখাটি ২০২১-এর বইমেলায় প্রকাশিতব্য ‘নিউটনের আপেল ও অন্যান্য বিজ্ঞান মিথ’ বইয়ের অংশবিশেষ।
নিউটনের সবচেয়ে কাছের বন্ধু হ্যালি। আপেল পড়ার ঘটনা যদি সত্যি হয়েই থাকে তাহলে মহাকর্ষ সূত্রের কথা যখন হ্যালিকে বলছেন, তখন এ গল্প কেন বলেননি? বিষয়টা পরিষ্কার, নিউটন যেমন বিজ্ঞানী, হ্যালিও তেমন বিজ্ঞানী। আরেকজন বিজ্ঞানীর সঙ্গে কথা বলার সময় ফ্যান্টাসি নয়, কার্যকারণ সম্মন্ধেই বলবেন, সেটাই স্বাভাবিক। অর্থাৎ মহাকর্ষ গবেষণায় আপেল পড়ার ঘটনা মূল অনুসঙ্গ নয়।
তাহলে এই মিথ বা গল্প ছড়ালো কীভাবে?
যখন একজন ইতিহাসবিদও ফ্যান্টাসীপ্রেমী হয়ে ওঠেন, তখন ইতিহাসের ডালপালা বিকৃত হবেই। দ্য ইসরায়েলি নামের এক অখ্যাত ইতিহাসবিদ আপেল পড়ার ঘটনাটা একধাপ এগিয়ে নেন। তিনিই প্রথম লেখেন, নিউটনের মাথায় আপেল পড়েছিল বলেই মহাকর্ষ সূত্র আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন। অথচ এর আগে চালু ছিল, আপেলটা নিউটনের সামনে বা পাশে পড়েছিল। তবে ইসরায়েলী নয়, নিউটনের আপেল পড়ার ঘটনাটিকে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় কররার কাজটি করেন ফরাসী লেখক ও ইতিহাসবিদ ভলতেয়ার। তিনি একটি গল্পে বা প্রবন্ধে আপেল পড়ার ঘটনাটিকে প্রায় বাস্তুবে রূপ দিয়ে ফেলেছিলেন।
অনেকেই মনে করেন, আপেল পড়ার ঘটনাটি ঘটেছিল। আর সেই আপেল পড়েছিল নিউটনের মাথায় নয়, সামনে। তবে এই ঘটনাই মহাকর্ষ তত্ত্ব আবিষ্কারের পেছনে মূল নিয়ামক নয়। তাই যদি হত কোপারর্নিকাস, কেপলার, গ্যালিলিওদের পরিশ্রম বৃথা হয়ে যায়। তাঁদের গবেষণার দ্বারস্থ হওয়ার দরকারই হত না নিউটনের।
মিথ অনেকটা গুজবের মতো। এর ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা সত্যির চেয়েও অনেক অনেক গুণ বেশি। তাই এই অনলাইনের যুগে এসেও বোধহয় ৮০ ভাগ মানুষ বিশ্বাস করেন, আপেল পড়েছিল বলেই নিউটন মহাকর্ষ সূত্র আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন।
সূত্র : সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকান, হিস্ট্রি ডট কম
লেখক : Abdul Gaffar Rony