Md. Rakibul Hasan-
ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার
ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার
ইনকিউবেটরের বিকল্প হিসেবে কাজ করে ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার, যাতে মৃত্যুঝুঁকি অনেক কম।
অপরিণত বয়স ও কম ওজনে জন্ম নেওয়া নবজাতককে বাঁচাতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক স্বীকৃত চিকিৎসাপদ্ধতি ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার, যা সারা বিশ্বেই জনপ্রিয়। বাংলাদেশ সরকারও এ ব্যাপারে জাতীয় গাইডলাইন প্রণয়ন করেছে। কোনো ব্যয় ছাড়াই এ পদ্ধতিতে নবজাতক মৃত্যুর হার কমানো যায়। লিখেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নবজাতক বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ পেডিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লা
ইনকিউবেটরের সীমাবদ্ধতার কারণে প্রি-ম্যাচিউর শিশুদের চিকিৎসায় কলম্বিয়ার চিকিৎসক ‘নাথালি চারপাক’ ১৯৭৮ সালে প্রচলন করেন ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার বা কেএমসি পদ্ধতি। এটা গত ৩০-৪০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, সুইডেন, ভারতসহ পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। ইউনিসেফের তথ্যমতে, এ পদ্ধতি ব্যবহার করে গত ২০ বছরে ব্রাজিলে জন্মের সঙ্গে সঙ্গে নবজাতক মৃত্যুহার অনেক কমে গেছে। বিশ্বের উন্নয়নশীল ১৫টি দেশের গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার পদ্ধতি অধিক কার্যকর, যাতে ইনকিউবেটরের চেয়ে শিশু দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে।
২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) উদ্যোগে মতলব হাসপাতালে এই পদ্ধতি চালু করা হয়। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নবজাতক বিভাগ, ঢাকা শিশু হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বারডেম জেনারেল হাসপাতালসহ দেশের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জেলা ও উপজেলায় মা ও শিশু স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অপরিণত শিশুকে মায়ের কাছে রেখেই, মায়ের তত্ত্বাবধানে ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার পদ্ধতি প্রয়োগ করে বেশ সাফল্য পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু প্রচারণার অভাবে এটি মানুষের কাছে তেমন পরিচিত নয়।
যাদের জন্য প্রযোজ্য
নবজাতকদের প্রধান পাঁচটি সমস্যা হলো—১. প্রি-ম্যাচিউর বা অপরিণত, ২. ইনফেকশন, ৩. জন্মের পর এক মিনিটের মধ্যে না কাঁদা বা শ্বাস না নেওয়া, ৪. জন্ডিস এবং ৫. জন্মগত ত্রুটি প্রভৃতি। এসবের মধ্যে নবজাতক মৃত্যুর প্রধান তিনটি কারণের মধ্যে অন্যতম হলো, প্রি-টার্ম লো বার্থ রেট অ্যান্ড ইটস কমপ্লিকেশন। অর্থাৎ ৪০ সপ্তাহের মধ্যে কোনো নবজাতক মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নিলে তা স্বাভাবিক। এই সময় ৩৭ সপ্তাহ হলেও চলে। কিন্তু ৩৭ সপ্তাহের আগেই সিজারিয়ান অপারেশন বা স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেওয়া শিশুই প্রি-টার্ম বা অপরিণত শিশু। এই সময় শরীরে তাপমাত্রা কম থাকে ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অপরিণত থাকে। ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যায়। তখন নবজাতক মায়ের বুকের দুধ টেনে পান করতে পারে না। খাবার পাকস্থলীতে না গিয়ে ফুসফুসে চলে যায় বলে শ্বাসও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সারা শরীরে সংক্রমণ হয়। জন্ডিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এসব কারণে তাদের মৃত্যুঝুঁকি থাকে বেশি। এসব নবজাতককে ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার পদ্ধতিতে চিকিৎসাসেবা দেওয়া যেতে পারে।
নবজাতক মৃত্যুর আরো একটি অন্যতম কারণ হলো, স্বল্প ওজন (আড়াই কেজির কম) নিয়ে জন্ম নেওয়া। এই অপরিণত নবজাতকদের বাঁচাতে শরীর গরম রাখা, ঠিকমতো পুষ্টি দেওয়া, ইনফেকশন যাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা, শ্বাসকষ্ট যেন না হয় সেটা দেখা বা অক্সিজেন দেওয়া এবং প্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়াসহ অনেক যত্ন নিতে হয়। এসবের সমন্বিত ও জনপ্রিয় পদ্ধতিই ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার।
ইনকিউবেটরেও ঝুঁকি আছে
নবজাতক জন্মের পর শরীরকে সঠিক তাপমাত্রায় বা গরম রাখার জন্য প্রথাগতভাবে কাঁথা-কাপড় মুড়িয়ে মাথা ও হাত-পা ঢেকে রাখা হয়। উন্নত বিশ্বে ও বাংলাদেশের বড় বড় সেন্টারে ইনকিউবেটর বা রেডিয়েন্ট ওয়ার্মারে ৩৬ থেকে ৩৭ ডিগ্রি তাপমাত্রায় রাখা হয়। কিন্তু এ ব্যবস্থাটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং সব হাসপাতালে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে নেই। আবার অনেক সময় ইনকিউবেটর নিজেই শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যেতে পারে। কেননা এটি পরিষ্কার করা ও রক্ষণাবেক্ষণ পদ্ধতি অনেক জটিল। তা ছাড়া ইনকিউবেটরে খরচের পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিভ্রাটের সমস্যাও রয়েছে। বিদ্যুৎ না থাকলে তাপমাত্রার সমস্যা হয়ে শিশুর ক্ষতি হয়। এসব সমস্যাকে বিবেচনা করে ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার পদ্ধতির সূচনা হয়েছে।
নিয়মাবলি
সময়ের আগে জন্ম নেওয়া ও কম ওজনের শিশুকে ক্যাঙ্গারু পদ্ধতিতে বুকের ওপর চামড়ার সঙ্গে মিশিয়ে রেখে সুস্থ করে তুলতে পারে প্রসূতি মা। মায়ের দুই স্তনের মধ্যে ত্বকের সঙ্গে শিশুটির ত্বকের সংস্পর্শ ঘটাতে হয়। অর্থাৎ ক্যাঙ্গারু যেভাবে পেটের থলেতে শাবককে আগলে রেখে প্রাণ বাঁচায়, তেমনি এসব নবজাতককে মা তার বুকে আগলে রেখে সুস্থ করে তোলে। অপরিণত নবজাতকের শরীরে তাপমাত্রা কম থাকে বিধায় তার মৃত্যুঝুঁকি থাকে। এ পদ্ধতিতে মা নবজাতককে বুকে জড়িয়ে রাখলে তার শরীরের তাপমাত্রা নবজাতকের শরীরে প্রবাহিত হয়। তখন শিশুটি মায়ের দেহের তাপেই গরম অনুভব করে। এটি ইনকিউবেটরের বিকল্প হিসেবে কাজ করে, যাতে মৃত্যুঝুঁকি অনেক কম।
সুবিধা
♦ অপরিণত ও কম ওজনে জন্ম নেওয়া নবজাতককে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ইনকিউবেটরের বিকল্প জনপ্রিয় পদ্ধতি ক্যাঙ্গারু কেয়ার। এ জন্য হাসপাতালে ভর্তি হওয়া কিংবা নার্সের প্রয়োজন হয় না বলে কোনো খরচও হয় না।
♦ মায়ের স্তনের কাছাকাছি শিশুটিকে রাখলে তা মাতৃদুগ্ধ উৎপাদনে সহায়তা করে। এ জন্য জন্মের পরপরই মায়ের বুকের সঙ্গে ক্যাঙ্গারু কেয়ার পদ্ধতি চালু করে দেওয়া উচিত।
♦ এতে মায়ের সঙ্গে নবজাতকের এক ধরনের আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়। আস্তে আস্তে নবজাতক প্রাকৃতিক পরিবেশে মানানসই হয়ে ওঠে।
♦ হৃৎপিণ্ড স্বাভাবিক গতি ফিরে পায়। শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার ক্ষেত্রে উন্নতি হতে থাকে। ফলে মৃত্যুঝুঁকি কমে যায়।
♦ এ অবস্থায়ই মায়ের দুধ খাওয়ানো যায়। প্রয়োজনে কাপ, চামচ বা নলও ব্যবহার করা যায়।
♦ কোনো জটিলতা দেখা দিলে মা দ্রুত বুঝতে পারে এবং প্রয়োজনে চিকিৎসককে জানাতে পারে।
♦ বিশেষ প্রয়োজনে মায়ের অবর্তমানে সন্তানের বাবা, দাদি-নানিরাও এ পদ্ধতিতে সাময়িকভাবে নবজাতককে বুকের সঙ্গে আগলে রাখতে পারেন।
যখন বন্ধ করা যাবে
হাসপাতালের পরিবর্তে বাড়ির পরিবেশে থাকলে নবজাতক ও মা এই পদ্ধতিতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, বিষয়টি অবশ্যই যেন মা ও শিশুর জন্য আরামদায়ক হয়। এ জন্য বিশেষ বেড বা চেয়ার ব্যবহার করা যেতে পারে। শিশুর ওজন ২৫০০ গ্রাম না হওয়া পর্যন্ত ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার চলতে থাকবে। শিশুটি পরিণত হলে হাত-পা বেশি নড়াচড়া করবে, অঙ্গগুলো টেনে বের করতে চাইবে, কাঁদতে থাকবে এবং মায়ের শরীরে লেগে থাকতে চাইবে না। তখন ক্যাঙ্গারু কেয়ার পদ্ধতি বন্ধ করে স্বাভাবিকভাবে রাখতে হবে।
কমবে নবজাতক মৃত্যুর হার
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবমতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর সোয়া চার লাখ অপরিণত বয়সের নবজাতক জন্মগ্রহণ করে। সাধারণত কিশোরী বয়সে বিয়ে বা বাল্যবিয়ে, অ্যাজমা, ডায়াবেটিস, গর্ভাবস্থায় পানি আগে ভাঙা, গর্ভকালীন রক্তপাত, হঠাৎ পড়ে যাওয়া, ধূমপান বা তামাক গ্রহণ করা, মায়ের রক্তশূন্যতা ইত্যাদি কারণে অপরিণত শিশুর জন্ম হয়। অপরিণত ও অপেক্ষাকৃত কম ওজনের এসব নবজাতক শিশুর অকাল মৃত্যুরোধে নতুন জাতীয় গাইডলাইন প্রণয়ন করেছে সরকার, যার আওতায় সরকারি হাসপাতালগুলোতে ‘ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার’ পদ্ধতিতে চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হবে। এতে সহায়তা করেছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)। সারা দেশে এটি চালু হলে নবজাতক মত্যুর হার আরো কমবে।
অনুলিখন : আতাউর রহমান কাবুল
https://www.kalerkantho.com/print-edition/doctor-acen/2017/10/08/551222