এ তো গেল সাধারন "ম্যাটার" তত্ত্ব। এবার আসি অ্যান্টিম্যাটারে। এবার ধারনা করুন এমন একটি মৌল যার পরমাণুতে আছে তিনটি ঠিক বিপরীত-ধর্মী কণা সমষ্টি। মানে ইলেকট্রনের জায়গায় পজিটিভ ইলেক্ট্রন বা পজিট্রন, আর প্রোটনের স্থানে অ্যান্টি প্রোটন। তাহলে কেমন হয়? ঠিক ধরেছেন, তাহলে ব্যাপারটা একটু গোলমেলে হয়ে পড়ে ঠিকই তবে এটাও যে সম্ভব সেটা রীতিমত অঙ্ক কষে দেখিয়েছিলেন ব্রিটিশ পদার্থবিদ পল মরিস ডিরাক তাঁর বিখ্যাত "ডিরাক সমুদ্র" (Dirac Sea) থিয়োরীর মধ্যে দিয়ে। সেও হয়ে গেল নয় নয় করে প্রায় নব্বই বছর।
জটিল হয়ে গেল?? তা একটু হওয়ারই কথা। আসলে ব্যাপারটা সোজা ভাবে ব্যাখ্যা করা খুব মুশকিল। তবুও চেষ্টা করা যাক। তার জন্য ফিরে যেতে হবে একটু পেছনে। এর ব্যাখ্যার মধ্যে মিশে আছে কোয়ান্টাম ধারনা, বিশেষ আপেক্ষিকতা এবং সাধারন আপেক্ষিকতা। এই তিনিটে জিনিস এতটাই দুরূহ যে সহজ কথায় বলতে গেলেই কঠিন হয়ে পড়ে, আর ভুল ব্যাখ্যা হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায় পুরোমাত্রায়। একে হয়ত সবেচেয়ে সোজা ভাবে বোঝানো যায় গাণিতিক তত্ত্ব দিয়ে। গনিতের আঁকিবুঁকি কেটে ব্যাখ্যা করার মধ্যে একটা অসুবিধা আছে। যখন স্টিফেন হকিং যখন তাঁর প্রথম বই বের করতে গিয়েছিলেন, “দ্য ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম” তখন সম্পাদক মহাশয় তাঁকে সাবধান করে দেন, এক একটি সমীকরণ মানেই, বই এর কাটতি অর্ধেকেরও কম। তাই যথাসম্ভব অগাণিতিক ভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব এখানে, যাতে সাধারনের বোধগম্য হয়ে ওঠে বিষয়টি।
অষ্টাদশ শতকের শেষ সময়ে নিউটনিয়ান বলবিদ্যার থেকে বেশ কিছু জিনিস ব্যাখ্যা করা গেল না। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে কিরচফ এবং বোলজম্যান বের করলেন কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ মতবাদ, আর পরবর্তীকালে ম্যাক্সওয়েল বের করলেন তাঁর বিখ্যাত তড়িৎচুম্বক তত্ত্ব। এতদিন আমরা জেনে আসছিলাম যে নিউটনের কথা অনুযায়ী বস্তুর বেগ তার মাধ্যমের উপর নির্ভরশীল, তা কোনোভাবেই নির্দেশতন্ত্র (reference frame)-র ওপর নির্ভর করে না। নদীতে স্রোতের বেগের দিকে নৌকা চালালে নৌকার বেগের সাথে নদীর গতিবেগ মিলে যাবে আর বিপরীতে চালালে সেটি বিযুক্ত হবে। কিন্ত ম্যাক্সওয়েল নিঁখুতভাবে প্রমান করে ছাড়লেন যেযে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ যে কোনো মাধ্যমে এমনকি মাধ্যম না থাকলেও তার মধ্য দিয়ে আলোর গতিবেগে প্রবাহমান - আবার নির্দেশতন্ত্র পরিবর্তন ঘটলে ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণটাই পরিবর্তন হয়ে যায়। এ হেন ব্যাপারে তো নিউটনের বলবিদ্যা খাটে না, তাহলে উপায়??
ধরি মাছ না ছুঁই পানি ধরনের একটা প্রচেষ্টা করতে গেলেন কিছু বিজ্ঞানী। নিউটনকে কোনোভাবেই সরানো যাবে না, আর ম্যাক্সওয়েলকেও নস্যাৎ করার কোনো উপায় নেই। তাই, বিজ্ঞানীরা এবারে একটা নতুন জিনিসের পত্তন ঘটালেন - সর্বব্যাপী, স্থিতিস্থাপক এক অদ্ভুত মাধ্যম, ইথার। ওনারা বললেন, ধরে নিলেই হয় যে আমাদের চারপাশ ঈথারে ভরপুর, যা আমাদের পঞ্চেন্ত্রিয়ের দ্বারা অনুভূত নয়। এ এমন একটি মাধ্যম যার মধ্যে দিয়ে যেতে গিয়ে বস্তুর দৈর্ঘ্য হয়ে পড়ে ছোট - আর সময় হয়ে যায় ধীর স্থির। ব্যাস - আর কী? মার দিয়া কেল্লা!! অংক সব মিলে গেল। কিন্তু এতে কি আর ফাঁকি আটকায়?? সেটা থেকেই গেল - যতদিন না আইনস্টাইন এসে হাল ধরলেন।
আইনস্টাইন এসে তাঁর বিশেষ আপেক্ষিকতা দিয়ে হাতে কলমে প্রমান করলেন, যে ইথার ফিথার একদম বাজে কথা। এরকম কিছুর অস্তিত্ব নেই কোথাও। যা ধ্রুব, তা হলো শুধু আলোর গতিবেগ। যাকে পরম গতি বলা যেতে পারে। আইনস্টাইনের এই বিশেষ আপেক্ষিকতা ব্যাপারটা অসামান্য কিছু যুক্তির ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তবে এটিকে "বিশেষ" বলা হয়, কারণ এ কেবলমাত্র ব্যাখ্যা করে যে পরস্পরের সাথে সমবেগে চলা দুটি নির্দেশতন্ত্রের মধ্যে অবস্থিত সবকিছুর মধ্যে পদার্থবিদ্যার নিয়মগুলি সমান ভাবে সিদ্ধ। বস্তুর ভর, দৈর্ঘ্য এবং সময় তিনটির কোনটিই ধ্রুব নয়। বস্তুর গতির সাথে এসবেরই পরিবর্তন ঘটতে পারে। কিন্তু এটি ব্যাখ্যা করার পরও আইনষ্টাইনের মাথায় একটি নতুন চিন্তা দেখা দিল। যদি পরস্পরের সাথে সমবেগে চলমান দুটি নির্দেশাক্ষের ক্ষেত্রে পদার্থবিদ্যার সব তত্ত্ব খাটতে পারে তবে ভিন্ন ভিন্ন বেগ বিশিষ্ট নির্দেশাক্ষরা কি দোষ করল? সেখানে কি আলাদা নিয়ম? এবার চলে এল উচ্চতম গণিতের প্রশ্ন এবং নন- ইউক্লিডীয় জ্যামিতির ধারনা। এত দিনের জানা জ্যামিতির সমস্ত ধারনাকে হেলার সরিয়ে দিলেন তিনি। সেই নতুন জ্যামিতি দিয়েই ব্যাখ্যা করলেন এই মহাবিশ্বের নানা অজানা রহস্য। সে বড়ই গোলমেলে জিনিস, কিন্তু আশ্চর্য, আইনস্টাইনের ব্যাখ্যা মিলে গেল অনেক জ্যোতিষ্কের অদ্ভুত আচরণের সাথে। তাদের অনিয়মিত ঘোরাফেরার তাত্ত্বিক এবং গাণিতিক ব্যাখ্যা মিলল আইনস্টাইনের হাত ধরে - আর এটাই হলো খুব সংক্ষেপে সাধারন আপেক্ষিকতার তত্ত্ব।