মানুষের অমরত্বের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে আমাদের ক্রোমোজোমের ঠিক শেষ প্রান্তে যাকে বলা হয় টেলোমিয়ার। কিন্তু এই টেলোমিয়ার জিনিসটা আবার কি? খায় না মাথায় দেয়? একটু সহজ ভাবে বুঝিয়ে বলা যাক।
আমাদের শরীর অসংখ্য কোষের সমন্বয় গঠিত হয়, যার ঠিক কেন্দ্রে রয়েছে নিউক্লিয়াস। এই নিউক্লিয়াসের মধ্যেই কুণ্ডলীকৃত অবস্থায় আছে ডাবল স্ট্র্যান্ডেড DNA বা ক্রোমোজোম। এই ক্রোমোজোমের ঠিক শেষ প্রান্তে DNA এর যে বিশেষ অংশটি রয়েছে তাকে বলা হয় টেলোমিয়ার। অর্থাৎ আমাদের মানব দেহের প্রতিটি কোষে যেহেতু ৪৬ টি ক্রোমোজম আছে এবং প্রতিটি ক্রোমোজোমের দুটি বাহু, সেহেতু মোট টেলোমিয়ারের সংখ্যা দাঁড়ালো গিয়ে ৯২।
জুতোর ফিতেতে ঠিক শেষ প্রান্তে ছোট্ট একটা প্লাস্টিকের অংশ থাকে নিশ্চই খেয়াল করেছেন? কোনোদিন ওই প্লাস্টিকের অংশটাকে ভেঙে দিয়ে লক্ষ করুন তো জুতোর ফিতেটার ঠিক কি অবস্থা হয়। আমাদের ক্রোমোজোমও ঠিক ওই জুতোর ফিতেটার মতন আর টেলোমিয়ার হলো প্লাস্টিকের অংশটা। টেলোমিয়ার আসলে আমাদের ক্রোমোজোমগুলিকে রক্ষা করে যাতে তারা অবিন্যস্ত না হয়ে পড়ে অথবা পরস্পরের সাথে যুক্ত না হয়ে যায়। যদি কোনো ক্রোমোজোমের টেলোমিয়ার না থাকে তাহলে তা কোষের বিভিন্ন ধরনের অস্বভাবিকতাকে ডেকে আনে, যা বহু ক্ষেত্রে ক্যান্সারের মতো রোগেরও কারণ।
টেলোমিয়ারের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে যার বিশ্লেষণে না গিয়ে সরাসরি এবার চলে আসি এই টেলোমিয়ারের সাথে মানুষের বার্ধক্য বা মৃত্যু কিভাবে সম্পর্কিত।
আমাদের কোষ বিভাজনের সময় প্রতিমুহূর্তে DNA এর প্রতিলিপিকরণ ঘটে যাকে বলা হয় DNA replication। এই পদ্ধতিতেই একটি DNA থেকে দুটি, দুটি থেকে চারটে এইভাবে সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্ত গণ্ডগোলটা বাধে তখনই যখন DNA এর শেষপ্রান্তের প্রতিলিপিকরণ শুরু হয়। একটি DNA স্ট্র্যান্ডের প্রথম থেকে প্রতিলিপিকরণ হতে থাকে আর অল্প অল্প করে নতুন DNA টি তৈরি হতে থাকে। শেষপ্রান্তে এসে রেপ্লিকেশনে সহয়ককারী যে উপাদানটি থাকে (primer) সেটির জন্য শেষপ্রান্তটি আর রেপ্লিকেট হতে পারে না। ব্যাপারটি কিরকম বলুন তো? মনে করুন আপনি আপনার ঘরের মেঝেতে দাঁড়িয়ে মেঝেটাই রং করছেন। কিন্তু এমন একটি সময় আসবে যখন আপনি যেই জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে আছেন সেই অংশটুকু আর রং করতে পারবেন না।
এইভাবেই প্রতিবারের কোষ বিভাজনের সাথে সাথে টেলোমিয়ারের দৈর্ঘ্যও ধীরে ধীরে কমতে থাকে আর একটা সময় আসে যখন কোষটির মৃত্যু ঘটে। আর এই টেলোমিয়ার শর্টনিংই হলো বার্ধক্যের অন্যতম প্রধান কারণ। ডিম্বাণু এবং শুক্রাণুর মধ্যে টেলোমারেস নামে একটি উৎসেচকের উপস্থিতিতে এই টেলোমিয়ার এর দৈর্ঘ্য কমে না, বরং প্রতিবার যেটুকু ক্ষয় হয় তা পুনরায় ফিরে আসে। কিন্তু আমাদের দেহকোষের মধ্যে এই উৎসেচকের কর্মক্ষমতা খুবই কম। আর ঠিক এই কারণেই ডিম্বাণু বা শুক্রাণু অমর হলেও মানুষ অমর হতে পারে না।
বৈজ্ঞানিক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী ওবেসিটি, স্ট্রেস, anxiety অথবা ধূমপান টেলোমিয়ার শর্টনিং এর এই পদ্ধতিকে যথেষ্ট ত্বরান্বিত করে। তাই যতই পন্ডস এজ-মিরাকল মাখুন না কেন, বার্ধক্যকে ঠেকিয়ে রাখতে গেলে টেলোমিয়ারকে রক্ষা করতে হবে। আর বয়স্ক মানুষকে দেখলে অবশ্যই সম্মান করুন। মনে রাখবেন তার DNA কিন্তু আপনার থেকে অনেক বেশি রেপ্লিকেটেড।
কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে, মানুষ অমর হয়ে যাবে এটা ভাবলেই কিরকম সাফোকেটেড লাগতে থাকে। মানে, কোনোকিছুর শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই এরকম হলে হয়তো এই পৃথিবীর ভারসাম্যটাই নষ্ট হয়ে যাবে। তার থেকে জন্ম মৃত্যু দুটোকে একসাথে নিয়ে চলার মধ্যে আনন্দ খোঁজাই হয়তো ঢের ভালো
©শ্রীময়ী চক্রবর্তী