সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিঃ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধি দ্বারা বোঝানো হচ্ছে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রের পানির পরিমাণ বেড়ে গিয়ে স্থলভাগ গ্রাস করে ফেলা সংক্রান্ত দুর্যোগকে। এই দুর্যোগ একটি বৈশ্বিক সমস্যা, যা প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট কারণসমূহের সম্মিলিত ফলাফল।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানোর কারণে বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং অন্যান্য গ্যাস মুক্ত হয়ে পৃথিবীর হতে তাপ নির্গমন রুদ্ধ করে দেয়। ফলে সমুদ্র এই গ্যাসসমূহ শোষণ করে। এর ফলে সমুদ্রের তাপ বৃদ্ধি পায় আর সমুদ্রের পানির আয়তন বাড়ে। সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধির আরও একটি কারণ হলো মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়া।
আমাদের জীবনে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রভাবঃ
১. সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য নদীর পানি স্রোত ধীর হয়ে গেছে। ফলে বন্যার সময় অতিরিক্ত পানি সমুদ্রে ধীরে যাচ্ছে। এতে বন্যা দীর্ঘ সময় থাকে ও জনজীবন একেবারে দুর্বিষহ হয়ে যায়।
২. সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য নদীর পানির অনেক গভীর পর্যন্ত লবনাক্ততা ঢুকে পড়ছে, যা পুকুর ও জলাশয় এবং জমিকে লবণাক্ত করে ফসল ও মিঠা পানির মৎস্য উৎপাদন নষ্ট করছে।
৩. সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য হিমবাহ গলে গেলে এর উপর বসবাসরত জীবকুলের বাসস্থান ধ্বংস হচ্ছে, এতে আমরা জীব বৈচিত্র্য হারাচ্ছি। এছাড়াও সুন্দরবনের অনেক জীবনও এই কারণে এখন বিপন্নের মুখে।
৪. সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য উপকূলবর্তী অঞ্চলের জমি পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে, যার ফলে জনজীবনে দুর্ভোগ দেখা দিবে। জাতীয় উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যেমন:
⇨ ভারত মহাসাগরের উপসাগর বঙ্গোপসাগরের সাথে বাংলাদেশের রয়েছে ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলভাগ। দিনে দিনে এন্টার্কটিকার বরফ গলার ফলে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধিতে (Sea Level Rise: SLR) ডুবে যাবার আশঙ্কায় রয়েছে বাংলাদেশ। UNFCCC'র দেয়া তথ্যমতে, বিংশ শতাব্দিতে সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা ১০-২০ সেন্টিমিটার বেড়েছে এবং ২০১১ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ আরো ১৮-৫৯ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে। আর এতে মালদ্বীপসহ তলিয়ে যাবে উপকূলবর্তী দেশ বাংলাদেশও। জাতিসংঘের আন্তসরকার জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যানেল বা IPCC ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে জানিয়েছে যে, ২০৫০ খ্রিস্টাব্দে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের অন্তত ১৭% ভূমি সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যাবে৷ কিন্তু ২০০৯ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে 'দ্যা সায়ন্টিফিক কমিটি অন এন্টার্কটিক রিসার্চ' (SCAIR) জানিয়েছে, যে হারে এন্টার্কটিকার বরফ গলছে, তাতে ২১০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে ৫ ফুট। বিগত দিনের পরিসংখ্যানের প্রায় দ্বিগুণ এই হিসাবের প্রেক্ষিতে ব্রিটেনের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা DFDI-এর অভিমত হলো, এপরিমাণ উচ্চতাবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের প্রায় এক পঞ্চমাংশ সমুদ্রে তলিয়ে যাবে। বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত তালিকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে ঝুঁকিপূর্ণ ১২টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দশম (১০ম)। এরকম অকষ্মাৎ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে ২০৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ দেশের প্রায় ৮%-এরও বেশি নিম্নাঞ্চল ও প্লাবনভূমি আংশিক এবং/অথবা স্থায়ীভাবে জলমগ্ন হয়ে পড়বে।এছাড়া রাজধানী শহর ঢাকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১ মিটার উঁচুতে অবস্থান করছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাজনিত কারণে ঢাকাও আক্রান্ত হতে পারে বলে ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড বা WWF-এর অভিমত। এইসব ভবিষ্যত সংশ্লিষ্টতার প্রেক্ষিত পেরিয়ে বর্তমানেই (২০০৯) সুন্দরবনে সর্বপ্রথম, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি অনুভূত হয়। কারণ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞানীদের দেয়া তথ্যমতে, ২০০০ খ্রিস্টাব্দের আগ পর্যন্ত সমুদ্র, প্রতি বছর ৩ মিলিমিটার (০.১২ ইঞ্চি) করে বাড়ছিলো, কিন্তু পরবর্তি দশকেই প্রতি বছর ৫ মিলিমিটার (০.২ ইঞ্চি) করে বাড়া শুরু হয়েছে। এবং ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে সার্কের "আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্র"(SMRC)-এর একটি গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে যে, হিরণ পয়েন্ট, চর চাঙ্গা, এবং কক্সবাজারে জোয়ারের পানির স্তর প্রতি বছর, যথাক্রমে ৪.০ মিলিমিটার, ৬.০ মিলিমিটার এবং ৭.৮ মিলিমিটার বেড়েছে।
এদিকে সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ, সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধির হারের চেয়েও আরো বেশি হারে ডুবে যাচ্ছে। কারণ প্রতি বছর বঙ্গোপসাগর উপকূলের এলাকাসমূহের মাটি দেবে, বসে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই একটি গবেষণা থেকে ভারতের কলকাতা শহরে, মাটি বসে যাওয়ার প্রমাণ মিলেছে।এছাড়া আরো দুটি গবেষণায় ভবিষ্যতে লখনৌ এবং পাটনার ভূমি বসে যাবার সম্ভাব্যতা দেখানো হয়েছে। যদিও বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন যে, ভূমি, প্রতি বছর ৫মিলিমিটার বসে গেলেও, পলি জমে আরো ৭ মিলিমিটার উঁচু হয়ে যায় ভূত্বক। কিন্তু মানবসৃষ্ট বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে নদীর পানি বা বন্যার পানি সর্বত্র পৌঁছাতে পারে না, ফলে পলি পৌঁছতে পারছে না সেসব স্থানে। আর তাই ভূমি বসে যাবার তুলনায় সব স্থানে ভূমি উঁচু হচ্ছে না। এ গবেষণা সঠিক হলে, সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধির হারের চেয়ে অতিরিক্ত হারে বাংলাদেশ ডুবে যাবে; এতে যেমন মানুষের হস্তক্ষেপ আছে, তেমনি আছে প্রকৃতির রূপ পরিবর্তন।( তথ্যসূত্রঃ Wikipedia)
৫. ঘন ঘূর্ণিঝড়সহ আরও নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ অনিয়মিতভাবে দেখা দিবে। এতে জাতীয় জীবনে সংকট দেখা দিবে।
এছাড়াও আরও অনেক প্রভাব রয়েছে।
সর্বোপরি সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি আমাদের জীবনকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করবে। ধন্যবাদ।
- মোঃ সাদমান সাকিব।