মানুষের শরীরকে তুলনা করা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে জটিল আর কার্যকর যন্ত্র হিসেবে। আসলেই মানবদেহ এক অদ্ভুত প্রাকৃতিক বিস্ময়! সৃষ্টিগত নৈপুণ্য আর অভিযোজন সক্ষমতা মানুষকে পৃথিবীর সেরা জীবের খেতাব এনে দিয়েছে। আর মানবদেহের জৈবিক উন্নয়ন সাধনে কয়েক হাজার বছরের সামগ্রিক অভিযোজন আর বিবর্তন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
যেমন- তিব্বতের দুর্গম জনগোষ্ঠীর লোকেরা কম অক্সিজেনসমৃদ্ধ উঁচু পাহাড়ি এলাকায় দিব্বি বসবাস করতে পারে, সাইবেরিয়ার হিমশীতল স্থানের অধিবাসীরা অধিক দৈহিক তাপ তৈরি করতে পারে, ইন্দোনেশিয়ার সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষ দম বন্ধ করে প্রায় সত্তর ফুট গভীর সমুদ্রে বিচরণ করতে পারে। পরিবেশের সাথে মানিয়ে চলতেই এই বিবর্তনের ধারা- মানুষের টিকে থাকার এক জৈবিক সংগ্রাম। কিছু তত্ত্ব নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক থাকলেও, অভিযোজন উদ্দেশ্যে একই প্রজাতির মধ্যে সীমিত পরিসরে বিবর্তনের ব্যাপারটি স্বীকার করা যায়। তাই এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, ভবিষ্যতেও কি মানুষের দেহে আরো বিবর্তনগত পরিবর্তন ঘটবে? ঘটলেও তা কি মানুষের উপকার করবে নাকি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে?
ক্রমাগত মানুষের বিবর্তনের ফলাফল ভবিষ্যতে ঠিক কেমনটা হবে তা সম্পূর্ণভাবে ধারণা করা দুষ্কর। তবুও অতীত জৈবিক পরিবর্তন, বৈজ্ঞানিক বেশ কিছু গবেষণা আর প্রস্তাবনা থেকে মোটামুটি কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। কি ধারণা পাওয়া যায়, চলুন জেনে নেই।
১। আরো ছোট মস্তিষ্ক :
বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন যে, গত দশ-বিশ হাজার বছর যাবত মানব মস্তিষ্ক আকারে ছোট হয়ে আসছে। বর্তমান মানব মস্তিষ্ক নাকি তার পূর্বপুরুষদের মস্তিষ্কের থেকে দশ শতাংশের মতো ছোট হয়ে গেছে। আসলে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতার পরিবর্তনের কারণেই এমন হচ্ছে। আদিম মানুষদের জীবন ধারণের পদ্ধতি আধুনিক কাল থেকে অনেক কষ্টকর ছিল। তাই দৈনন্দিন জীবনধারণে শারীরিক পরিচালনার জন্য অধিক টিস্যু সমৃদ্ধ মস্তিষ্কের প্রয়োজন ছিল। তবে দক্ষতা আর প্রযুক্তির ব্যবহার আদিম প্রেক্ষাপট পরিবর্তন করে দিয়েছে আর মস্তিষ্কের উপর চাপ কমায় এর সামগ্রিক ভর কমে আসছে। তবে ভর কমে আসলেও মস্তিষ্কের কার্যকারিতা আগের থেকে কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে আর মস্তিষ্ক আরো জটিল গঠন প্রাপ্ত হয়েছে। আর ভবিষ্যতেও মানব মস্তিষ্ক আরো আকারে ছোট এবং জটিল গঠনের হয়ে যাবে বলে গবেষকরা ধারণা করছেন।
২। পাখির মতো চঞ্চু ঠোঁট :
২০১৩ সালে শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ফ্রেজার মানুষের দাঁতের গঠনের সাথে সামুদ্রিক কাঁটাযুক্ত পাফার মাছের শক্তঠোঁটের গাঠনিক মিল খুঁজে পান। পাফার মাছের শক্ত ঠোঁট আগে ছোট ছোট দাঁতের মতোই ছিল, যা পরে একত্র হয়ে বর্তমান গঠন তৈরি করে। তাই ড. ফ্রেজার ধারণা করছেন, কয়েক হাজার বছর পর পাফার মাছের মতো ভবিষ্যতে মানুষের দাঁতগুলো একত্র হয়ে পাখির মতো চঞ্চু ঠোঁট এর গঠন লাভ করতে পারে। মানুষের দাঁতগুলো এমন চঞ্চুর মতো হয়ে গেলে খাবার চিবানো আরো সহজ হবে বলে অধ্যাপক ফ্রেজার মনে করেন।
৩। মাংসপেশির শক্তি হ্রাস :
আদিম যুগের মানুষের চেয়ে বর্তমান সময়ের মানুষের শারীরিক গড়ন আর পেশিশক্তি বহুলাংশে কম বলে বিজ্ঞানীরা গবেষণায় প্রমাণ পেয়েছেন। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, প্রাকৃতিক নির্বাচনের ক্ষেত্রে শক্তিবান ধরণের মানুষের থেকে বুদ্ধিমান ধরণের মানুষ পরিবার এবং সমাজ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন এবং তাদের বংশগতি বিভিন্ন সময় পৃথিবীতে আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। জিনগত ভাবেও পেশিশক্তি থেকে বুদ্ধিমত্তার বৈশিষ্ট্য মানুষকে সফল প্রাণীসংঘ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দান করে। আর বর্তমান জগতে প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীলতা ভবিষ্যতের মানব প্রজন্মকে আরো বুদ্ধি দীপ্ত করবে এবং একই সাথে মানুষের শারীরিক কর্মদক্ষতা আর মাংসপেশির শক্তিও আরো কমে আসবে বলে গবেষকরা মতামত প্রদান করেন।
৪। অধিক উচ্চতা এবং অধিক সৌন্দর্য :
ভবিষ্যতের মানব প্রজন্ম যেকোনো সময়ের থেকে অধিক উচ্চতা আর সৌন্দর্য সমৃদ্ধ হবে বলে গবেষকরা ধারণা করছেন। এর কারণ হিসেবে প্রাকৃতিক নির্বাচন আর জিনগত অভিযোজন কে ধরা হয়। প্রাচীনকালের মতো মানবসভ্যতা জৈবিক ভাবে বিপর্যস্ত নয় আর জীবন যাপনের অভিজ্ঞতা পূর্বপুরুষদের তুলনায় অনেক ভালো- তাই ধীরে ধীরে মানুষের শারীরিক বৈশিষ্ট্য আরো শাণিত হয়ে উঠবে। পাশাপাশি আগের তুলনায় পুষ্টির নিশ্চয়তা, চিকিৎসার মান বৃদ্ধি এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা সৌন্দর্য ক্ষেত্রে বিবর্তনের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
৫। পায়ের কোণা আঙুলের বিলুপ্তি :
শারীরিকভাবে পায়ের কোণার আঙুলের প্রয়োজনীয়তা অতীতের থেকে বর্তমানে অনেক কম বলে ধারণা করা হয়। এখনকার মানবদেহে এই আঙুল টি নড়নক্ষম আর কার্যকর হলেও ভবিষ্যতে মানবদেহে আঙুল টি তার নড়নক্ষমতা হারিয়ে একটি নিষ্ক্রিয় অংশে পরিণত হতে পারে। পরবর্তীতে মানবদেহের এই কোণার পায়ের আঙুলটি স্বাভাবিক ভাবেই বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হয়। এতে করে দেহের চলাচলে সুবিধা পাওয়া যাবে বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন।
৬। একক জাতিসত্তা :
পৃথিবীতে মানুষের এখন কেবল একটি মাত্র প্রজাতি টিকে রয়েছে- প্রায় সাড়ে সাতশো কোটি জনসংখ্যা নিয়ে। তবুও জাতিভেদে মানুষের দৈহিক গঠনের যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। তবে গবেষকরা জানিয়েছেন, আগামী কয়েক হাজার বছর পরে নব্য মানবসভ্যতায় জাতিগত শারীরিক কোনো পার্থক্য আর থাকবে না। সেই ভবিষ্যতে পৃথিবীতে বসবাসরত সকলের দৈহিক কাঠামো অনুরূপ হবে। এর কারণ হিসেবে বৃহত্তর অভিবাসন, আন্তঃজাতি বিবাহ এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনকে বিবেচনা করা হচ্ছে। সেই দূর ভবিষ্যতে মানুষের সামগ্রিক দৈহিক গঠন বর্তমান ব্রাজিলে বসবাসরত মানুষদের মতো হবে বলে গবেষকরা ধারণা করছেন।
আজকের লেখাটি পড়ে আপনাদের সকলের কেমন লাগলো তা অবশ্যই কমেন্টস সেকশন এ জানাবেন। দূর ভবিষ্যতে মানুষের শরীরে ক্রমাগত বিবর্তনের ফলে আর কি কি পরিবর্তন আসতে পারে বলে আপনি মনে করেন- জানতে চাই আপনাদের কাছে।
লেখকঃ ফাহাদ মান্নান-Team Science Bee