এক লক্ষ বছর পর যেরকম দেখতে হবে মানুষের মুখ!
আমাদের নিকটতম আত্মীয় শিম্পাঞ্জির সঙ্গে আমাদের পূর্বপুরুষদের অদ্ভুত কিছু মিল ছিল ৬০-৭০ লক্ষ বছর আগেও। কিন্তু মানব শরীরের অভ্যন্তরে অদৃশ্যভাবেই চলেছিল বিবর্তনের খেলা। তাই আমাদের নিকটতম আত্মীয় শিম্পাঞ্জির সঙ্গে আমাদের পূর্বপুরুষদের গঠনগত ও অভ্যাসগত দূরত্ব বাড়ছিল। পরিবর্তিত পৃথিবী ও পরিবর্তিত জীবনযাত্রার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্যই বাড়ছিল এই দূরত্ব।
শারীরিক কাঠামোর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মুখাবয়বের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে শেষ কুড়ি লক্ষ বছরে। গোলাকৃতি মুখাবয়ব ক্রমশ লম্বাটে হয়ে যেতে শুরু করেছিল। ভুরুর জায়গায় থাকা উঁচু হাড়দুটি ক্রমশ বসে যেতে শুরু করেছিল। শিম্পাঞ্জির মত ছুঁচলো মুখ সমতল হতে শুরু করেছিল, চওড়া ও ভোঁতা নাকের পাটা ক্রমশ সরু ও টিকলো হতে শুরু করেছিল।
অতীতের বিভিন্ন ধাপে, মানব প্রজাতির মুখাবয়ব কেমন ছিল তা জানিয়ে দিয়েছে বিজ্ঞান। বর্তমানে মানবপ্রজাতির মুখাবয়ব কেমন, তার সাক্ষী আমরা নিজেরাই। কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগে কেমন দেখতে হবে ভবিষ্যতের মানুষদের মুখ? ভবিষ্যতকে দেখার কোনও টাইম মেশিন আবিষ্কার হয়নি যে! যাঁরা ভরসা রাখেন বিজ্ঞানে, তাঁরা বলেন বিজ্ঞানই ‘টাইম মেশিন’।
বিজ্ঞান আমাদেরকে জানিয়েছে আমাদের অতীত, বিজ্ঞানই জানাতে পারে আমাদের ভবিষ্যত। কথাটা একেবারেই ঠিক। ভবিষ্যতে মানুষের মুখ দেখতে কেমন হবে, এই প্রশ্নের ওপর আলোকপাত করেছেন বিভিন্ন বিজ্ঞানী। বিবর্তনমূলক জীববিজ্ঞান, জিনতত্ত্ব ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে কোনও বিজ্ঞানী আবার এঁকে ফেলেছেন ভবিষ্যতের মানুষের মুখ।
ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির অ্যানথ্রোপলজির প্রফেসর এরিক ট্রিনকাস বলেছেন, মানব প্রজাতির মুখের মূল কাঠামো তৈরি হয়েছিল ২০ লক্ষ বছর আগে। তারপর ক্রমাগত চলেছে পরিবর্তন। যদি এভাবেই পরিবর্তিত হতে থাকে মানুষের মুখ, তাহলে একসময় মানবের মধ্যে দেখা দিতে পারে “neoteny”। এর ফলে সঠিক বয়সের তুলনায় অনেক কমবয়স্ক দেখতে লাগবে মানুষের মুখকে। ডঃ ট্রিনকাসের মতে বড় খুলি, ছোট মুখ, বড় বড় চোখ ও ছোট থুতনি নিয়ে জন্ম নেবে ভবিষ্যতের মানুষ।
বিজ্ঞানীদের মতে আমাদের মুখাবয়বের এখনও পরিবর্তন হয়ে চলেছে। ভবিষ্যতের প্রয়োজনে এই বিবর্তন হয়েই চলেছে। তাঁরা বলছেন, মুখের প্রধান অংশগুলির কাজ একই থাকবে। তবে সেগুলির আকার ও আকৃতির আরও কিছু পরিবর্তন হবে ভবিষ্যতে। এই পরিবর্তনগুলি হবে তখনকার পৃথিবী ও মানুষের জীবনযাত্রার প্রয়োজন অনুসারে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ইতিমধ্যেই সেসবের কিছু ইঙ্গিত মিলেছে।
ব্রিটেনের ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির পুরাতন প্রস্তরযুগ সংক্রান্ত বিষয়ের বিশেষজ্ঞ প্রত্নতাত্ত্বিক পেনি স্পিকিংস এর মতে, মানুষের খাদ্যাভ্যাস মানুষের মুখাবয়বের আকারের পরিবর্তনের জন্য দায়ী। সেন্ট অ্যান্ড্রু ইউনিভার্সিটির গবেষক ও লেখক ডেভিড পেরেট তাঁর “In Your Face: The New Science of Human Attraction” বইটিতে প্রায় একই কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন মানুষের খাদ্যভ্যাস পাল্টে যাচ্ছে, এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে মানুষের মুখাবয়বের ওপর। আমাদের আদিম পূর্বপুরুষদের থেকে আমাদের মুখের গঠন আলাদা হয়ে গিয়েছে খাদ্যভ্যাসের পরিবর্তনের ফলেই।
মানুষের মুখের কাঠামো অনেকটাই গঠিত হয়েছে খাদ্য গ্রহণের সুবিধার কথা ভেবেই। তাই ভবিষ্যতের মানুষের মুখাবয়বে যে পরিবর্তনগুলি হবে, সেই পরিবর্তনগুলির জন্যেও দায়ী থাকবে আগামী দিনের মানুষের খাদ্যাভ্যাস। এই মতবাদে বিশ্বাসী বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিগত এক লক্ষ বছর ধরে, মানুষের মুখগহবর আকারে ক্রমশ ছোট হচ্ছে। কারণ পরিবর্তিত পৃথিবীতে নতুন নতুন খাদ্যের ওপর মানুষকে ভরসা করতে হচ্ছে। মানুষের খাওয়ার ধরনও পাল্টাচ্ছে। মানুষ খাওয়ার সময় ক্রমশ অল্প অল্প খাবার নিচ্ছে মুখে। অবশ্য এই পরিবর্তনটা লক্ষ্য করা গিয়েছে তখন থেকেই, যখন থেকে বেশিরভাগ মানুষ শিকার ছেড়ে সম্পূর্ণ কৃষিজীবী হয়ে গিয়েছিল।
বর্তমানে মানুষের দুরন্তগতিতে চলা জীবনযাত্রা, ফাস্টফুড ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য খাওয়ার প্রবণতা বাড়িয়ে দিয়েছে। স্যুপ, জুস ও নরম হালকা খাবার খাওয়ার দিকে মানুষের ঝোঁক ক্রমশ বাড়ছে। শক্ত খাবার খাওয়ার প্রবণতা কমে গিয়েছে। তাই খাবার মুখ গহবরে রেখে বেশিক্ষণ ধরে চিবোতে হচ্ছে না। দ্রুত খাবার চলে যাচ্ছে পেটে। তাই বিজ্ঞানীরা বলছেন মানুষের মুখগহবর এবং ‘হাঁ’ আকৃতিতে আরও ছোট হবে ভবিষ্যতে। তবে মানুষের মুখের বিভিন্ন অংশ ছোট হওয়ার একটা সীমাও থাকবে। মুখগহ্বর ছোট হলেও নাসাছিদ্র দুটি কিন্তু আর ছোট হবে না। কারণ শ্বাস গ্রহণের জন্য আমাদের দরকার বড় নাসাছিদ্র। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন যতদিন পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব থাকবে, মানুষের মুখের পরিবর্তন ততদিন হতেই থাকবে।
ভাষাহীন ভাববিনিময়ের জন্য পরিবর্তিত হয়েছে মুখের কাঠামো!
একদল বিজ্ঞানী একটু ভিন্ন মত পোষণ করেন। ‘নেচার ইকোলজি অ্যান্ড ইভোলিউশন‘ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল তাঁদের একটি গবেষণাপত্র। এই বিজ্ঞানীরা বলছেন, আমাদের মুখাবয়ব কেবলমাত্র জলবায়ু বা খাদ্যাভ্যাসের জন্য পরিবর্তিত হয়নি। মুখের অভিব্যক্তির সাহায্যে অন্য মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের প্রচেষ্টাও মুখাবয়বের পরিবর্তনের জন্য দায়ী। মানুষ যেভাবে মুখের বিভিন্ন অভিব্যক্তি দিয়ে ভাব বিনিময় করতে পারে, পৃথিবীর কোনও প্রাণীই সেটি পারে না।
ব্রিটেনের ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির প্রফেসর পল হিগিনস বলেছিলেন, কেবলমাত্র মুখের পেশি নাড়িয়ে আমরা প্রায় কুড়িটি ভিন্ন ধরনের আবেগ ও অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারি। মুখাবয়বের পেশি নাড়িয়ে ভাব বিনিময়ের কৌশলগুলি মানুষের ক্ষেত্রে খুবই প্রয়োজনীয় ছিল। কারণ এই কৌশলগুলি সমাজবদ্ধ হওয়ার জন্য, অপরের সহযোগিতা নিয়ে চলার জন্য, সমাজে মানিয়ে নেওয়ার জন্য কাজে লাগত।
কিন্তু ভাববিনিময়ের এই ভাষাহীন কৌশল দেখা যায়নি আমাদের আদিমতম পূর্বপুরুষদের মধ্যে। কারণ আমাদের আদিমতম পূর্বপুরুষদের মুখের আকার ও মুখের পেশির অবস্থান, ভাববিনিময়ের এই ভাষাহীন কৌশলের পক্ষে আদর্শ ছিল না। তাদের চেয়ে আমাদের ভুরুর হাড় সমতল হওয়ায় ও ভুরু লোমশ হওয়ায় অনেক সহজে আমরা ভুরুর সংকোচন ও প্রসারণ করে, কথা না বলেই ভাববিনিময় করতে পারি। ভাষাহীন এই ভাববিনিময়ের পদ্ধতিকে সাহায্য করেছে আমাদের মুখের কাঠামো ও পেশির বিবর্তন।
এবার ছবিতে ‘ভবিষ্যতের মুখ’ :
ভবিষ্যতের মানুষের মুখ দেখতে কেমন হবে, তা জানার জন্য বিশ্ববাসী অধীর ছিলেন। অধীর ছিলেন গবেষক ও শিল্পী নিকোলাই লাম নিজেও। কারণ তিনি একদল জিনতত্ত্ববিদের সঙ্গে এই সংক্রান্ত একটি গবেষনার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে নিকোলাই লাম একদিন এঁকে ফেলেছিলেন ভবিষ্যতের মানুষের মুখ। প্রযুক্তি বিজ্ঞানের সাহায্যে নিকোলাই লাম এঁকে ছিলেন তিনটি ছবি। সেই ছবিগুলি থেকে জানা গিয়েছিল, ২০ হাজার বছর, ৬০ হাজার বছর ও ১ লক্ষ বছর পর কেমন দেখতে হবে মানুষের মুখ।
নিকোলাই লামের আঁকা ছবিগুলি আসলে ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির জিনতত্ত্ববিদ ডঃ অ্যালান কোয়ানের মতবাদের শৈল্পিক প্রকাশ। আগামী দিনের পৃথিবীতে মানুষের বাঁচার পরিবেশ, জলবায়ু ও প্রযুক্তির অগ্রগতি বিচার করে ডক্টর অ্যালান কোয়ান বলেছিলেন, মানুষের কপাল ও মাথা বড় হবে। সেটা হবে খুলি আকারে ক্রমশ বড় হওয়ার জন্য। ক্রমশ বড় হতে থাকা মস্তিষ্ককে ধরে রাখার জন্য খুলি বড় হতে থাকবে।
ডক্টর অ্যালান কোয়ান বলেছেন, ভবিষ্যতের মানুষের মুখ আকারে বেশ ছোট হবে। চোখদুটি মুখের তুলনায় অস্বাভাবিক বড় হবে। চোখের পাতা আরও মোটা হয়ে যাবে। শরীরের সঙ্গে মুখের চামড়ার রঙও গাঢ় হবে অতিবেগুনী রশ্মি থেকে বাঁচবার জন্য। নাক ছোট ও আরও টিকলো হবে। শ্বাসগ্রহণের সুবিধার জন্য নাসাছিদ্র আরও বড় হবে। মুখের ডানদিক ও বাঁদিকের গঠন একেবারে এক হবে। তাঁর গবেষণায় ডক্টর কোয়ান ব্যাখ্যা দিয়েছেন কীভাবে ১৪ -১৬ শতাব্দী থেকেই মানুষের কপাল ও খুলি বড় হওয়া শুরু হয়েছে।
ডক্টর অ্যালান কোয়ানের গবেষণা ও ব্যাখ্যায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন শিল্পী বিজ্ঞানী নিকোলাই ল্যাম। ডক্টর অ্যালান কোয়ানের সিদ্ধান্তগুলিকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে, বাস্তবের রূপ দিয়ে, এঁকে ফেলেছিলেন একলক্ষ বছর পর পৃথিবীর বুকে বিরাজ করা মানুষদের মুখ।
নিকোলাই ল্যামের আঁকা ছবিগুলিতে দেখতে পাওয়া মানুষের মুখগুলিই যে ভবিষ্যতের মানুষের মুখ, এই কথা কেউ বিশ্বাস করেছিলেন, কেউ করেননি। বিশ্বাস করা বা না করাটা একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন তো, আদিম মানবদের যে ছবিগুলি আমরা দেখেছি, তা কিন্তু এঁকেছে বিজ্ঞানই। ছবিগুলি আঁকা হয়েছে পৃথিবীর বুকে মেলা আদিম মানবের দেহাবশেষের ওপর ভিত্তি করেই। তবুও তো বিশ্বাস করতে মন চায় না। মন বলে, ইশশ, এত বাজে দেখতে আমরা কখনওই ছিলাম না। কিন্তু তা সত্ত্বেও সত্যকে এড়ানো যাবে কি!
তথ্যসূত্র : বিজ্ঞান চর্চা