C : Saroj Nag
2021 সালে, জাপানের Hayabusa2 মহাকাশ অভিযান একটি দারুন উল্লেখযোগ্য কাজ করেছিলো। প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন বছর আগে গঠিত সৌরজগতের উৎপত্তির সময়কালীন একটি গ্ৰহাণু থেকে প্রায় পাঁচ গ্ৰামের মতো টুকরো পৃথিবীতে নিয়ে এসেছিলো। গ্ৰহাণুটির নাম ছিল 162173 Ryugu এবং সেটি মোটামুটিভাবে তার ইতিহাসে অবিকৃতই ছিল বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে গ্রহাণুটির রাসায়নিক সংমিশ্রণে দশটি অ্যামিনো অ্যাসিড (প্রোটিনের বিল্ডিং ব্লক) রয়েছে। এই ঘটনা অন্তত সাক্ষ্য দেয় যে সেই আদিম 'স্যুপ' যা থেকে পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব হয়েছিল তা গ্রহাণুর টুকরো থেকে প্রাপ্ত অ্যামিনো অ্যাসিড দ্বারা মিশ্রিত হয়ে থাকতে পারে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো সেই আদিম গ্ৰহাণুর মধ্যে অ্যামিনো অ্যাসিড কোথা থেকে এল? জীবিত কোষের মধ্যে জৈবিক ক্রিয়াকলাপের দ্বারা অ্যামিনো অ্যাসিডগুলি উৎপন্ন হতে পারে। কোন অজৈবিক প্রক্রিয়া তাদের উল্কা এবং গ্রহাণুতে সৃষ্টি করতে পারে? বিজ্ঞানীরা এই বিষয়ে বিভিন্ন উপায় নিয়ে চিন্তা করেছেন। তবে জাপানের গবেষকদের সাম্প্রতিক কাজ একটি উল্লেখযোগ্য নতুন সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত করে। তা হলো গামা রশ্মি ব্যবহার করে অ্যামিনো অ্যাসিড তৈরি হওয়া। সেক্ষেত্রে গ্ৰহাণু এবং উল্কাপিন্ড থেকে পৃথিবীতে জীবনের আবির্ভাবের সম্ভাবনা আরও বেশি করে বেড়ে যায়।
জৈব রসায়নে অ্যামিনো অ্যাসিডগুলির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও এগুলো খুবই সাধারণ অণু। পর্যাপ্ত শক্তি থাকলে কার্বন, অক্সিজেন এবং নাইট্রোজেনের যৌগগুলি থেকে উপযুক্ত পরিবেশে সহজেই এদের উৎপাদন করা যায়। সত্তর বছর আগে স্ট্যানলি মিলার (Stanley Miller) এবং হ্যারল্ড ইউরে-এর (Harold Urey) বিখ্যাত পরীক্ষাগুলি প্রমাণ করেছিল যে মিথেন, অ্যামোনিয়া এবং হাইড্রোজেনের একটি বায়বীয় মিশ্রণে বৈদ্যুতিক প্রভাবের ফলে জৈব যৌগগুলির একটি মিশ্রণ তৈরি করা যায় যার মধ্যে অ্যামিনো অ্যাসিডও থাকে। পরবর্তীকালে দেখা গেছে যে অ্যামিনো অ্যাসিডগুলি সমুদ্রতলের হাইড্রোথার্মাল ভেন্টের কাছে পলিতেও তৈরি হতে পারে।
1969 সালের পর থেকে মহাকাশ থেকে অ্যামিনো অ্যাসিডের আসার সম্ভাবনা দেখা দিতে শুরু করে। দক্ষিণ-পূর্ব অস্ট্রেলিয়ায় এবং মেক্সিকোতে পাওয়া দুটি উল্কা (যথাক্রমে Murchison meteorite এবং Allende meteorite) তাদের পৃথিবীতে পড়ার পরপরই উদ্ধার করা গিয়েছিল। উভয়ই ছিল কার্বোনাসিয়াস কনড্রাইট (carbonaceous chondrites) শ্রেণীর উল্কাপিন্ড। এরা পৃথিবীতে পাওয়া এক রকমের বিরল শ্রেণীর উল্কাপিন্ড। বিজ্ঞানীরা মনে করেন এরা সৌরজগত গঠনের একদম প্রথম দিকের ছোট বরফের বস্তু থেকে সংগৃহীত (Ryugu-ও এই শ্রেণীর)। সেই দুটি উল্কা আকারে ছোট হলেও তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অ্যামিনো অ্যাসিড পাওয়া যায়। অবশ্য বিজ্ঞানীরা তখন নিশ্চিত হতে পারেননি যে উল্কাগুলোতে আগে থেকেই আ্যমিনো আ্যসিড বর্তমান ছিলো কিনা।
তবুও মহাকাশ বিজ্ঞানীরা জানতেন যে বরফের ধূলিকণাগুলি যেগুলি কার্বনাসিয়াস কনড্রাইট তৈরি করে তাতে জল, অ্যামোনিয়া, অ্যালডিহাইড এবং মিথানলের মতো ছোট কার্বন যৌগ থাকতে পারে, তাই অ্যামিনো অ্যাসিডের মৌলিক উপাদানগুলি উপস্থিত থাকবে। শুধু সেখানে প্রয়োজন শক্তির উৎসের। বিজ্ঞানীরা জানতেন সেখানে শক্তির উৎস রয়েছে, যেমন সুপারনোভা থেকে নির্গত অতিবেগুনী বিকিরণ ও ধূলিকণাগুলির মধ্যে পারস্পরিক সংঘর্ষ ইত্যাদি। নাসার অ্যামেস রিসার্চ সেন্টারের (Ames Research Center) অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট স্কট স্যান্ডফোর্ড (Scott Sandford) বলেছিলেন “We know a lot of ways to make amino acids abiologically, and there’s no reason to expect that they didn’t all happen.”
সম্প্রতি রসায়নবিদ ইয়োকো কেবুকাওয়া (Yoko Kebukawa) এবং কেনসেই কোবায়শির (Kensei Kobayashi) নেতৃত্বে জাপানের ইয়োকোহামা ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির গবেষকদের একটি দল দেখিয়েছেন যে গামা রশ্মিও কনড্রাইটে অ্যামিনো অ্যাসিড তৈরি করতে পারে। তাঁরা দেখিয়েছেন যে কনড্রাইটের মধ্যে উপস্থিত থাকা তেজস্ক্রিয় উপাদান (অ্যালুমিনিয়াম-26) থেকে নির্গত হওয়া গামা রশ্মি কার্বন, নাইট্রোজেন এবং অক্সিজেন যৌগকে অ্যামিনো অ্যাসিডে রূপান্তরিত করতে পারে।
অবশ্যই, গামা রশ্মি জৈব যৌগগুলিকে যত সহজে তৈরি করতে পারে তত সহজে ধ্বংস করতে পারে। কিন্তু জাপানি দলের পরীক্ষায় দেখা গেছে রেডিও-আইসোটোপগুলির দ্বারা অ্যামিনো অ্যাসিড উৎপাদনের বৃদ্ধি সেগুলো নষ্ট হওয়ার চেয়ে বেশি কার্যকর ছিল। সেজন্য গামা রশ্মিগুলি তাদের ধ্বংসের চেয়ে বেশি অ্যামিনো অ্যাসিড তৈরি করেছিল। তাদের পরীক্ষায় পর্যবেক্ষণ করা উৎপাদনের হার থেকে গবেষকরা মোটামুটিভাবে গণনা করেছেন যে গামা রশ্মি কার্বোনাসিয়াস কনড্রাইট গ্রহাণুতে অ্যামিনো অ্যাসিডের ঘনত্বকে 1,000 বছর থেকে 100,000 বছরের মধ্যে মুর্চিসন উল্কাপিণ্ডে দেখা মাত্রার সমমানে বাড়িয়ে তুলতে পারে।
অতিবেগুনি রশ্মি যেমন গ্রহাণু বা উল্কাপিণ্ডের অভ্যন্তরে গভীরভাবে প্রবেশ করতে পারে না, গামা রশ্মি কিন্তু তা পারে। তাই এই প্রক্রিয়াটি জীবনের উদ্ভবের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। পৃথিবীর আবহাওয়ার মধ্যে প্রবেশ করার সময়ে উল্কাপিন্ডের বাইরের অংশটি নষ্ট হয়ে গেলেও এগুলির মধ্যবর্তী অংশ বেঁচে যেতে পারে। সুতরাং গামা রশ্মি ব্যবহার করলে আপনি শুধুমাত্র অ্যামিনো অ্যাসিড তৈরি করছেন না বরঞ্চ আপনি তাকে একটি গ্রহে যাওয়ার রাস্তা সুগম করে দিচ্ছেন!
তাহলে আমাদের অল্প পরিমাণে তরল জল উপস্থিত থাকতে হবে। এও দেখা যায় যে কার্বোনাসিয়াস কনড্রাইট উল্কাগুলি হাইড্রেটেড সিলিকেট এবং কার্বনেটের মতো খনিজ পদার্থে পূর্ণ যা শুধুমাত্র জলের উপস্থিতিতে তৈরি হয়। কেবুকাওয়া বলেছেন কনড্রাইটের খনিজ পদার্থের অভ্যন্তরে খুব সামান্য পরিমাণ জল আটকা পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
এই ধরনের খনিজ প্রমাণ থেকে ফ্রান্সের Aix-Marseille বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ভ্যাসিলিসা ভিনোগ্রাডফ (Vassilissa Vinogradoff) বলেছেন, বিজ্ঞানীরা জানেন যে আদিম গ্রহাণুগুলিতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে তরল জল রয়েছে। প্রায় এক মিলিয়ন বছর সময়কালের মধ্যে সেই পরিমাণ জলের দ্বারা অ্যামিনো অ্যাসিডগুলি তৈরি হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
স্কট স্যান্ডফোর্ড এবং তাঁর সহকারীরা গবেষণায় দেখেছেন আদিম আন্তঃনাক্ষত্রিক আণবিক মেঘের (primordial interstellar molecular clouds) মধ্যে বরফের মিশ্রণের উপস্থিতিতে বিকিরণ শর্করা এবং নিউক্লিওবেস সহ অ্যামিনো অ্যাসিড তথা জীবনের সাথে প্রাসঙ্গিক বহু যৌগের জন্ম দিতে পারে।
সুতরাং সাম্প্রতিক গবেষণাগুলিতে আমাদের সামনে পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব সম্পর্কে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে চলেছে। তবে বিজ্ঞানীরা এখনই কোনো বৈপ্লবিক সিদ্ধান্তে আসতে চান না, তার জন্য আরও সময় দরকার।
© সরোজ নাগ।
তথ্যসূত্র - Gamma-Ray-Induced Amino Acid Formation in Aqueous Small Bodies in the Early Solar System. Yoko Kebukawa, Shinya Asano, Atsushi Tani, Isao Yoda, and Kensei Kobayashi, ACS Cent. Sci. 2022, 8, 12, 1664–1671 https://doi.org/10.1021/acscentsci.2c00588