যেভাবে আপনি একটি বল আকাশের দিকে ছুড়ে দিলে এটি কিছুক্ষনের জন্যে শূন্যে ভেসে থাকবে, সেভাবেই সবকিছু আকাশে ভেসে আছে বা (আসলে বলা দরকার যে) ভেসে বেড়াচ্ছে।
মানে, আপনার ছুড়ে দেয়া বলটি যেমন প্রথমে উপরের দিকে উঠবে, ধীরে ধীরে তার গতির দিক পরিবর্তন হবে, তারপর একসময় পৃথিবীতে ফিরে আসবে। ততক্ষণে কিছু সময় অতিবাহিত হয়ে যাবে। বলটি উপরের দিকে ছুড়ে দেয়ার পর থেকে আবার ভূমিতে ফিরে আসতে কতক্ষণ লাগবে, সেটা নির্ভর করছে আপনি কত গতিতে তাকে ছুড়তে পেরেছেন, তার উপর। কিন্তু সময় যত কম-বেশিই হোক না কেন, আপনি কিন্তু নিশ্চিতভাবেই বলতে পারেন যে, বলটা কিছুক্ষণ শূন্যে ভাসমান ছিল।
আকাশের সব বস্তুই এভাবে একটা আদিবেগ প্রাপ্ত হয়ে, তারপর কারো না কারো দিকে পড়ে যাওয়া টর চেষ্টা করছে। কিন্তু কারো কারো জন্যে সময়টা লাগছে বেশী। কারণ, তাদের পড়ে যাওয়ার দিকটা এমনভাবে বাঁকানো, যে তাদের ক্ষেত্রে সময়টা লাগছে অত্যাধিক। এভাবে সবকিছুই কিন্তু মাত্র কিছু সময়ের জন্যেই ভেসে বেড়াচ্ছে।
আসলে ভেসে বেড়াচ্ছে মানে হলো- সবাই পদার্থবিদ্যার নিয়ম মেনে অন্য সবার দিকে একটা পড়ে যাচ্ছে। সবাই একে অপরের দিকে পড়ে যেতে চাইছে, কিন্তু আদি বেগের কারণে পারছে না। “পারছে না” মানে সময়টা অনেক বেশি লাগছে।
লক্ষ্য করুন যে, আপনার ছুড়ে দেয়া বলটি যেমন সাময়িক কিছু সময়ের জন্যে আকাশে ভেসে ছিল, সবাই তেমন কিছু সময়ের জন্যেই ভেসে আছে। গতির দিক এবং আদি ভরবেগের কারণে এই “কিছু সময়” টা একেকজনের একেক রকম।
- যাদের এই সময়টা কম, তারা অল্প সময়ের মধ্যে অন্যের সাথে মিশে যাচ্ছে।
- যাদের আদি ভরবেগ বেশি, তারা আকর্ষন বলের সীমা কাটিয়ে দুরে চলে যাচ্ছে।
এই দুয়ের কাউকেই কিন্তু আমরা বহুকাল ধরে ঘুরতে দেখছি না, কারণ তারা হয় অধিক ভরের বস্তুটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে, নয়ত ছিটকে বহু দুরে হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা তাদেরকে ঘূর্ণায়মান বস্তু বলে মনেই করি না।
বাকী যারা ফিরেও আসছে না আবার ছেড়েও চলে যাচ্ছে না (সেরকম কেউ নেই আসলে) তাদেরকে আমরা অনেকদিন ধরে একই নিয়মে চলতে দেখার সুযোগ পাচ্ছি। আর ভাবছি যে তারা ঘুরছে।
পৃথিবীর চারপাশে আমরা একটি সাময়িক স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করতে দেখছি, কিন্তু কোনকিছুই চিরস্থায়ী নয়। সুদীর্ঘ কাল ধরে অনেক অনেক তোলপাড় হয়েছে, আরো অনেক তোলপাড় এখনো হচ্ছে, আরো অনেক তোলপাড় হতেই থাকবে।
এরই মাঝে ক্ষুদ্র একটি সময়ের জন্য জীবনের বিকাশ হয়েছে এবং আমরা একটি গোলযোগপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহের একটুখানি খণ্ডচিত্রকেই সাময়িকভাবে স্থিতিশীল বলে ভাবছি, কারণ আমাদের সময়ের জ্ঞান মহাবিশ্বের সময়ের মাপের তুলনায় অত্যাধিক ক্ষুদ্র।
এবার বৈজ্ঞানিক কারণটা বলি। কেন ফ্রি-ফল মানেই একটা ছুড়ে দেয়া বলের মত ধুপ করে পড়ে যাওয়া নয়। ফ্রি-ফল আরও অনেক রকম হতে পারে। চলুন দেখে নিই।
মনে করুন আপনি একটি উঁচু স্থানে (এভারেস্টের চূড়ায় বা উঁচু দালানের ছাদে) দাঁড়িয়ে আছেন। ওখান থেকে একটি বলকে ছেড়ে দিলেন। বলটি তখন সোজা নিচে নেমে গেল।
বলটি পড়ন্ত বস্তুর সূত্র মেনে সোজা নিচে পড়ছে।
পরের বার বলটিকে শুধু ছেড়ে না দিয়ে, আলতো করে পূর্বদিকে ছুড়ে মারলেন, এবারও বলটি নিচে পড়বে, তবে একটু দুরে গিয়ে পড়বে।
বলটিকে যেদিকে ছুড়ে দিলেন, সেদিকে একটু এগিয়ে যাচ্ছে। একই সাথে কিন্তু পড়েও যাচ্ছে।
এবার আপনি যদি আরেকটু বেশি শক্তি দিয়ে আরো জোরে ছুড়তে পারেন, তাহলে সেটি আরো দুরে গিয়ে পড়বে। তাই না? এই যে নিচের ছবিতে দেখুন।
এবার আরও জোরে যদি ছুড়তে পারেন বলটিকে, খুব স্বাভাবিকভাবেই সেটি আরো দূরে গিয়ে পড়বে। নিচের ছবিতে বেশি দূরত্ব বোঝাতে আপনার উচ্চতা কমিয়ে দেখানো হয়েছে।
এর পরের বার আরও জোরে ছুড়তে পারবেন? এবার একই ঘটনা ঘটবে। কিন্তু দেখুন যে, বলটি পড়ার সাথে সাথে পৃথিবীর নিজের পৃষ্ঠতলের বক্রতা দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে।
আপনি নিশ্চয় ধারনা করতে পারছেন যে, এবার বলটিকে আরও জোরে ছুড়লে ঘটনা কী হবে!
এভাবে আপনি যদি আরো বেশি শক্তি দিয়ে ছুড়ে মারতে পারেন, তাহলে দেখা যাবে বলটি আসলে পড়ছে ঠিকই, কিন্তু পৃথিবীর গোলকীয় তলকে কিছুতেই স্পর্শ করতে পারছে না। যতোই সামনে যাচ্ছে আর পড়ে যেতে চেষ্টা করছে, পৃথিবীর পৃষ্ঠ ততোই দুরে থাকছে। ফলে পুরো ৩৬০ ডিগ্রী ঘুরে বলটি একসময় আবার পশ্চিম দিক দিয়ে আপনার কাছে ফেরত চলে আসছে।
এখানে পৃথিবীকে একটা সুষম গোলক ধরা হয়েছে এবং বাতাস বা অন্য সব বাঁধাকে অস্বীকার করা হয়েছে। কারণ, অনেক দূর দিয়ে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে যারা ঘুরছে, তাদের ক্ষেত্রে এগুলো প্রযোজ্য হয় না।
তো ওভাবেই, ওই একই নিয়মে পৃথিবীর চারপাশে চাঁদ ঘুরছে, আর ওভাবেই পৃথিবীও (চাঁদ সহ) ঘুরছে সুর্যের চারপাশে।
থেমে থাকতে পারবে না কেউ। থেমে গেলেই আর ঘুরতে পারবে না, যার চারপাশে ঘোরার কথা, কিছুক্ষনের মধ্যেই তার সাথে মিশে যাবে। এভাবে বহুযুগ ধরে বহুরকমের বস্তু একসাথে মিশেই বড় বড় জিনিসের জন্ম হয়েছে। এখনো মিশে যাচ্ছে। তার মধ্যে কেউ কেউ মোটামুটি স্থিতিশীলভাবে ঘুরলে, তারাই কেবল আমাদের নজরে আসে।
এখন চিন্তা করুন, আরো বেশি বেগে যদি ছুড়তেন বলটাকে, ও বেচারা ধীরে ধীরে দুরে চলে যেত পৃথিবী থেকে। ঘুরত ঠিকই, কিন্তু আবার দুরে চলে যেতেও থাকত।
রকেট ছোড়ার ব্যাপারটি অনেকটা এভাবেই কাজ করে।
এখন যে কিনা পৃথিবীতে ফিরে এসে আছড়ে পড়ল তাকে আপনি ভাববেন পৃথিবীর অংশ। আর যে চলে গেল তাকে পরবর্তীতে আর ফিরে আসতে দেখতে পেলেন না, তাই জানতেও পারবেন না তার কথা।
আর বাকি যারা একটা মোটামুটি সাম্যাবস্থা তৈরী করতে পারল, তাদেরকে ভাবলেন যে এরা একেবারে হাতে ধরে হিসেব করে বসানো, যাতে ঘুরতে থাকে, পড়েও না যায় আবার সরেও না যায়। আসলে সবাই পড়ছে বা দুরে চলে যাচ্ছে। কারো কারো সময়টা খুব বেশি লাগছে। সেকারণে মনে হচ্ছে তারা বুঝি ঘুরছে আর চিরকাল ঘুরতেই থাকবে।
এখন একটা প্রশ্ন থাকে যে, ঘুর্ণায়মান বস্তুগুলোর এই আদি বেগটি এলো কোথা থেকে, কে ছুড়ে দিল প্রথমে!
আসলে দুটো বস্তু বহু দুর থেকে যখন একে অপরের আকর্ষণে, একে অপরের দিকে পড়তে শুরু করে, সেটা কখনো কখনো যেমন একেবারে মুখোমুখি হতে পারে, ফলে একটা ক্র্যাশ-ল্যান্ডিং ঘটে। আবার কখনো কখনো একেবারে মুখোমুখি হয় না, পাশ কেটে চলে যায় দুরে। একে অপরের দিকে পড়ার সময় পরস্পরের আকর্ষণে তাদের গতি বাড়তে থাকে, সেই গতিতে বহুদুর ছুটে চলে যায়, আবার বহুদিন পর অন্য পাশ দিয়ে ফিরে আসতে থাকে। এভাবেই চলতে থাকে যুগের পর যুগ। কেউ কেউ ধীরে ধীরে দুরে যাওয়ার পরিমান কমাতে থাকে এবং একসময় প্রায় বৃত্তাকার পথে ঘুরতে থাকে। কিন্তু কারো পথই পুরোপুরি বৃত্তাকার হতে পারে না।
যেমন - হ্যালির ধুমকেতু ৭০-৮০ বছর পরে পরে ফিরে আসে, আবার ছুটে চলে যায় দুরে কোথাও। তারপর আবার সেদিক থেকে ছুটে আসতে থাকে। একেবারে পৃথিবীর দিকে মুখ করে যদি আসত, তাহলে আমরা বহু আগেই ওকে হারাতাম, ঘুরতে দেখতাম না কখনো।
চাঁদ আর পৃথিবীর কথা তো বললাম। সৌরজগতে আরো বহু জিনিস আছে, যারা তাদের বর্তমান আকৃতি পাওয়ার বহু আগে থেকে ঘুরছে। একেবারে যখন গ্যাসের মেঘ ছিল, বা ধূলিকণার মেঘ ছিল, তখন থেকে। কারণ সেই একই - আকর্ষনের কারণে ফ্রি-ফল, অন্যের আকর্ষনে সেটা আবার কিছুটা বিচ্যুত হওয়া, তারপর ধাক্কা খাওয়া থেকে বেঁচে গেলেই একটা কিছু হবে। পৃথিবীর বর্তমান আকৃতি এবং বিশাল জলরাশি তৈরী হয়েছে এরকম বহু বস্তুর আছড়ে পড়ার কারণে। এই প্রক্রিয়া এখনো চলমান। ৪৫০ কোটি বছর ধরে একেকটি বস্তুর আবির্ভাবে আমাদের এই বর্তমান অবস্থা।
এরকম পুরো সৌরজগৎটাও একটা সংঘবদ্ধ বস্তু হিসেবে ঘুরছে গ্যালাক্সীর কেন্দ্রের চারপাশে। আকাশে আমরা যত তারা দেখি, সেগুলো আমাদের গ্যালাক্সির খুব ক্ষুদ্র একটা অংশ, তারাও একই কারণে ঘুরছে গ্যালাক্সীর কেন্দ্রের কোন বৃহৎ বস্তু বা বস্তুসমূহের চারপাশে।
অ্যান্ড্রোমিডা আর আমাদের মিল্কীওয়ে - এরাও পরস্পরের আকর্ষণে একে অপরের দিকে পড়ে যাচ্ছে এবং একটি অবধারিত সংঘর্ষের দিকে এগোচ্ছে। যদিও সেই সংঘর্ষ হতে বহু দেরী আর সেটা হলেই যে আমাদের পৃথিবী বা সৌরজগৎ খুব নড়েচড়ে উঠবে এমন নাও হতে পারে। কারণ, অধিকাংশ জায়গায় তো ফাঁকা।
আর গ্যালাক্সীগুলোর মধ্যে আরো অন্যধরনের আরো কিছু বল নাকি কাজ করে, যার কারণ স্থানের প্রসারণ ঘটে আর মহাজগতের ব্যপ্তি বাড়ে, সেসম্পর্কে আমরা তেমন কিছু এখনো জানি না।
- পার্থিব প্রকাশ