আমাদের হৃৎস্পন্দন ছন্দময়। স্বাভাবিকভাবে মিনিটে ৬০ থেকে ১০০ বার স্পন্দিত হয়। ব্যায়াম, পরিশ্রম, বিশ্রাম, জ্বর, উদ্বেগসহ নানা কারণে এই হার ওঠানামা করে। হৃৎস্পন্দন নিয়ন্ত্রণের জন্য হৃদযন্ত্রের ভেতরই আছে ছোট্ট নোড, যা থেকে স্পন্দনবার্তা তৈরি হয়ে হৃৎপিণ্ডে ছড়িয়ে পড়ে। এই নোডে বা বার্তা ছড়িয়ে পড়ার পথে কোনো বাধা বা সমস্যা দেখা দিলে হৃৎস্পন্দন অনিয়মিত হয়ে পড়ে। একে হার্ট ব্লক বলা হয়। হৃদযন্ত্রের নানা রোগে, বিশেষ করে হার্ট অ্যাটাকের পর এমনটা হতে পারে।
অনিয়মিত হৃৎস্পন্দনে মাথা ঝিম ঝিম করা, মাথা ঘোরা, চোখে অন্ধকার দেখা, হঠাৎ চেতনা হারানো বা পড়ে যাওয়ার মতো উপসর্গ হতে পারে। ইসিজির মাধ্যমে এটি শনাক্ত করা যায়। কারণ নির্ণয়ে ইকোকার্ডিওগ্রাফি, এনজিওগ্রামসহ আরও পরীক্ষার দরকার হতে পারে। রোগনির্ণয়ের পর কারও কারও কৃত্রিম পেসমেকারের প্রয়োজন হতে পারে।
কৃত্রিম পেসমেকার হলো ব্যাটারিচালিত পাতলা হাতঘড়ির মতো একটি জেনারেটর, যা বুকের ত্বকের নিচে ছোট্ট অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে স্থাপন করা হয়। এর বিশেষ ধরনের তার শিরার মধ্য দিয়ে হৃদযপ থাকে। এই যন্ত্রে তৈরি বার্তা হৃৎপিণ্ডে পৌঁছে স্পন্দন স্বাভাবিক ও নিয়মিত রাখে। আধুনিক পেসমেকার স্বাভাবিক নোডের মতোই পরিশ্রম, বিশ্রাম, ঘুম, টেনশনে পরিবর্তিত হৃৎস্পন্দন তৈরি করে। এটি এমনভাবে তৈরি যে হৃৎপিণ্ড যখন স্বাভাবিক স্পন্দন তৈরি করে, তখন তা নিষ্ক্রিয় থাকে। আবার প্রয়োজন হলে সচল হয়। যন্ত্রের ব্যাটারি ১০ থেকে ১৫ বছর পর পরিবর্তন করতে হয়।
পেসমেকার প্রধানত দুই প্রকারের।অস্থায়ী বা টেম্পোরারি পেসমেকার এবং স্থায়ী বা পারমানেন্ট। অস্থায়ী পেসমেকার সাধারণত হার্ট অ্যাটাক বা হৃদপিণ্ডের অস্ত্রোপচার বা অতিরিক্ত ওষুধ সেবনে ফলে যখন হৃদপিণ্ডের গতি কমে যায়, তখন বসানোর প্রয়োজন হয়। প্রয়োজন শেষ হলে, মানে হৃদপিণ্ড নিজস্ব গতি ফিরে পেলে এটি সরিয়ে নেওয়া হয়। স্থায়ী পেসমেকার তাঁদেরই বসানো হয়, যাঁদের হৃদপিণ্ডের গতির স্থায়ী সমস্যা রয়েছে। হৃদপিণ্ডের শ্লথ গতির জন্য যে সমস্যাগুলি হয়, যেমন ক্লান্তি, হার্ট ফেলিওর, বারবার চোখে অন্ধকার দেখা বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং রোগীকে সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।
পেসমেকারের সমস্যা সাধারণত দুই ধরনের।
প্রথমত, তাৎক্ষণিক সমস্যা। সাধারণত পেসমেকার বসানোর সময় বা পরবর্তী ২৪ ঘন্টার মধ্যে এগুলি হয়। যেমন, পকেট হেমাটোমা বা পেসমেকারের পকেটে রক্ত জমে যাওয়া, নিউমোথেরাক্স, হিমোথেরাক্স, লিড সরে যাওয়া বা লিড ডিসলজমেন্ট। দ্বিতীয়ত হচ্ছে বিলম্বিত জটিলতা। যেমন, পেসমেকার সংক্রমণ, পকেট ক্ষয়ে যাওয়া, লিড ভেঙে যাওয়া, অক্সিলারি শিরায় রক্ত জমে যাওয়া এবং পেসমেকার সিন্ড্রোম।
যেসব মেনে চলা উচিত-
পেসমেকার অপারেশনের স্থান নখ দিয়ে চুলকানো এবং পেসমেকার হাত দিয়ে চাপ দেওয়া বা নাড়াচাড়ার চেষ্টা করা উচিত নয়।
হৃদযন্ত্রের গতি অনিয়মিত হলে বা কমে গেলে এবং পেসমেকার লাগানোর আগের অসুবিধাগুলো আবার দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে যেকোনো হৃদরোগ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যোগাযোগ বা হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
বুকের যে পাশে পেসমেকার বসানো হয়েছে সেদিকের কানে মোবাইল ফোন ব্যবহার করা ঠিক না।
উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বৈদ্যুতিক ও চুম্বকীয় ক্ষেত্র (এমআরআই মেশিন, মেটাল ডিটেক্টর, মাইক্রোওয়েভ ওভেন ইত্যাদি) থেকে দূরে থাকা উচিত।
পেসমেকার স্থাপনের পর প্রথমে এক মাস, তিন মাস, ছয় মাস এবং পরবর্তী সময়ে প্রতিবছর একবার চেকআপের জন্য নির্ধারিত স্থানে যোগাযোগ করতে হয়।
যাদের পেসমেকার লাগানো হয়েছে তারা সব সময় একটি পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখলে ভালো, যাতে অন্যরা বুঝতে পারে যে শরীরে পেসমেকার বসানো আছে।
প্রথম আলো