হিপনোসিস শব্দের অর্থ সম্মোহন। একজনের চরম প্রস্তাবনা, তীব্র আবেগ ও কল্পনা শক্তি দ্বারা অন্যের মনকে প্রভাবিত করা এবং পরিচালনা করাকে বলা হয় হিপনোসিস। প্রাচীন কাল থেকেই সম্মোহন বিদ্যা প্রচলিত রয়েছে মানব সমাজে। সে কালে এই বিদ্যাকে যাদুবিদ্যা বা অলৌকিক ক্ষমতা বলে মানুষ বিশ্বাস করত। অষ্টাদশ শতকে সম্মোহন বিদ্যার নামকরণ হয় মেজমেরিজম, অষ্ট্রিয়ার ভিয়েনা শহরের ডাক্তার ফ্রাণ্ডস্ অ্যান্টন মেজমার সম্মোহন বিদ্যার চর্চা শুরু করেন। ফলে এর ব্যাপক প্রচার শুরু হয় এবং ডাক্তারবাবুর নামানুসারে সবাই একে মেজমেরিজম বলতে থাকে। ১৮৪০ সালে স্কটল্যাণ্ডের এক ডাক্তার জেমস ব্রেড নতুন নামকরণ করেন। গ্রিক শব্দে ঘুমের দেবতার নাম হুপ্নস এই শব্দের অর্থ হল ঘুম। সম্মোহিত ব্যক্তি যে হেতু এক প্রকার ঘুমের ঘোরে কাজ করে যায় তাই ডাক্তার ব্রেড এই বিদ্যার নাম দিলেন হিপনোটিজম; এ নামই বর্তমানে প্রচলিত। কি ভাবে সম্মোহন করা হয় তা জানা গেলেও আসলে কি ঘটে এ পূর্নাঙ্গ ব্যাখ্যা বিজ্ঞান এখনও দিতে পারেনি। কারণ মানুষের মন কিভাবে কাজ করে এটা আসলে অনেক বড় বিভ্রান্তির মধ্যে এক টুকরা ছোট বিভ্রান্তি। এটি এক ধরণের চরম প্রস্তাবনা, শিথিলতা এবং তীব্রতার কল্পনা শক্তির দ্বারা একটি অস্বাভাবিক স্বপ্নায়ন মোহগ্রস্তের অবস্থার বৈশিষ্ট্য বর্ননা করে। যা অনেকটা ঘুমের মত মনে হলে আসলে ঘুম নয়। কারন বিষয়টি পুরো সময়জুড়ে সজাগ থাকে। অধিকাংশ সময় একে দিবা স্বপ্নের মত মনে হয়। অথবা কোন বই বা মুভিতে নিজেকে হারিয়ে ফেলার মত। হিপনোসিস চলাকালীন সময়ে মস্তিষ্কের সচেতন অংশকে সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রনে নিয়ে ঐ ব্যক্তির বিক্ষিপ্ত চিন্তাগুলোকে কেন্দ্রীভূত করা হয় এবং তাকে রিলাক্স করার দিকে মনোনিবেশ করা হয়। যখন আমাদের মন কোন একটি দিকে নিবিষ্ট হয়, কেন্দ্রীভূত হয় তখনই আমরা শক্তি অনুভব করি। যখন কোন ব্যক্তি সম্মোহিত হয় তখন আমরা তার মাঝে কিছু শারীরিক পরিবর্তন ও লক্ষ্যনীয় হয়। যেমন তার নাড়ীর স্পন্দন ও কমে যায়, শ্বাস প্রশ্বাস ও কমে যায়। সেই সাথে তার মস্তিষ্কের আলফা স্তরে ঢেউ খেলতে থাকে। এই সময়ে ঐ ব্যক্তিকে কোন একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে বা বিশেষ কোন নির্দেশনা প্রদান করা হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানেএর ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই বিদ্যাকে ব্যবহার করতেন ইংল্যাণ্ডের ডাক্তার এস ডেল। তিনি সম্মোহনের সাহায্যে রোগীকে ঘুম পাড়িয়ে দাঁত তুলতেন, ছোটখাট অপারেশনও করতেন।
;হিপনোসিস অত্যন্ত বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতি। এর মধ্যে অবাস্তব-ভুতুড়েকিছু নেই। আসলে মানুষের অনেক অবদমিত বিশ্বাস বা ভাবনা থাকে। তার থেকে মানসিক রোগ হতে পারে। হিপনোটাইজড অবস্থায় সে এমন অনেক ঘটনার কথা বলে যার পুরোটাই তার ফলস মেমারি। কিন্তু সেটা বলে ফেলার ফলে মনের ভার কেটে যায় এবং সেই মানুষ মানসিক ভাবে সুস্থ হয়ে যায়। হিপনোটিক থেরাপিতে শরীর ও মনের রোগ সারানো, পূর্বজন্মে ফিরে যাওয়া, স্পিরিট রিলিজ কেউ বলছেন বৈজ্ঞানিক কারও কাছে আজগুবি, বুজরুকি, কেউ মনে করেন ব্ল্যাকম্যাজিক,আবার কারও ব্যাখ্যায় অর্ধেক সত্যি-অর্ধেক কল্পনা। সত্যি-মিথ্যা, বিশ্বাস-অবিশ্বাস মিলিয়েই চিকিৎসাশাস্ত্রেজায়গা করে নিয়েছে সম্মোহনবিদ্যা। পেয়েছে অলটারনেটিভ সায়েন্স বা অলটারনেটিভ থেরাপির মর্যাদা। সম্মোহনচর্চা জানলে তা প্রয়োগ করে আর্থ্রারাইটিস, হাইপারথাইরয়েডিজম থেকে শুরু করে অ্যাজমা, ক্রনিক হজমের সমস্যা, মদ বা ধূমপান অভ্যাস, বন্ধ্যাত্ব, স্ট্রোকের ফলে হওয়া পঙ্গুত্ব, অ্যাংজাইটি, মাইগ্রেন, বাত বা ক্যানসারের যন্ত্রণা, অনিদ্রা, ফোবিয়া, উচ্চরক্তচাপ, ওজন বৃদ্ধিসমূলে মিটিয়ে দেওয়া যায়। কাউকে দেখে মনে হয় যেন কত দিনের চেনা, যেন কোথায় দেখেছেন। কোনও জায়গা প্রথম বার চাক্ষুষ করেও মনে হয় যেন আগে কখনও এসেছেন। এটাও হিপনোসিস। কারও সঙ্গে কথা বলতে খুব ভাল লাগে বা কথা বলতে গিয়ে বারবার মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যান। সম্মোহনের এর থেকে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে? আফটারঅল, মানুষের মস্তিষ্কের থেকে শক্তিশালী কিছু নেই। আর কোনও মানুষের মস্তিষ্কের জোর অন্য মানুষের চেয়ে বেশি হলে সে অন্যকে বাগে আনতে চাইবে। হিপনোসিসের মাধ্যমে সেটা বৈজ্ঞানিক ভাবে সম্ভব।স্রেফ কথা বলে লোককে হিপনোটাইজ করে তিনি শারীরিক স্থূলতা-র মতো সমস্যার সমাধান করতে পারেন একজন হিপনো বিশেষজ্ঞ ! খুব সহজ। কথার মাধ্যমে হিপনোটাইজ করে এমন একটা ধারণা ঢুকিয়ে দেয়া হয় যাতে তাঁর মনে হতে থাকে যে তাঁর পাকস্থলীটা ছোট হয়ে গিয়েছে। যেমন অনেকটা বেরিয়াট্রিক সার্জারি করালে হয়। তাঁর ওজন কমে! এমনকি একজন হিপনো বিশেষজ্ঞ চাইলে মানুষকে তাঁর পাঁচ জন্ম আগে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন ! ধকল তেমন কিছুই হয় না! মানসিক ভাবে হুঁশিয়ার, শক্তিশালী, সচেতন থাকতে হয়। মনের গতি দুর্দমনীয়। তার তল পাওয়াও সহজ নয়। মনখননের যাবতীয় উত্তেজনা নিয়ে চলতে থাকে হিপনোসিস।
আমি আদি সত্যটি তুলে ধরছি। কেননা সত্য বলা আল্লাহর ইবাদত। আমি জানি যাদু বিদ্যা, সম্মোহনী বিদ্যা, ফুক ঝাড় করা, জীনের আছর করা, তাবিজ দেয়া এইগুলি একই সুতে বাধা। একই সরাব, বিভিন্ন লেভেল আঁটা বোতলে রাখা। আমি জানি আমার কথা শতকরা ৯৯% জনের কাছে বিশ্বাস হবেনা। আমার সবার্থকতা, আমি সত্য বলেছি। এসব বিদ্যা রপ্ত করে, সরে এসেছি, মিথ্যার জৌলস দেখে। পবিত্র কোর-আন পাঠে অনুধাবন করেছি, মহান আল্লাহ তায়লার সত্য ঘোষনা। পবিত্র কোর-আনে বলা হয়েছে, যাদু হলো মিথ্যার উপস্থাপনা মাত্র। আমি নিজে যাদু বিদ্যা রপ্ত করেছি, নতুন নতুন যাদু সৃষ্টি করেছি, কত জীন ছাড়িয়েছি তা গুনে বলতে পারবনা। যাদু মঞ্চে অতি উৎসাহী কেহ খুব বেশী এগিয়ে গেলে সম্মোহনী বিদ্যার নামে ঘুম বা চেতনা শুন্য করেছি। কিন্তু যে দিন স্রষ্টার কোর-আন বুঝার অভিপ্রায়ে কোর-আন পাঠ করেছি। যাদুর উপর আয়াতগুলি পাঠ করে আনুধাবন করেছি, আল্লাহর সত্য ঘোষনাকে। বুঝতে পেরেছি কেন আল্লাহ এসব বিদ্যাকে হারাম করেছেন, বুঝতে পেরেছি কেন এইসব বিদ্যাকে কবিরা গুনাহে ভুষিত করেছেন। আল্লাহর দরবারে খাস তওবা করে সরে এসেছি এসকল মিথ্যার বেড়াজাল থেকে। এসব বিদ্যা মিথ্যা, বানোয়াট এবং নির্লজ্জ প্রতারনা। কিছু হাতের কারসাজি, কিছু কেমিক্যাল এফেক্ট মাত্র। একটা সত্যকে মিথ্যা দিয়ে উপস্থাপনা করা হয় মাত্র। কথার বেড়াজালে ফেলে মানুষের চিন্তাকে অন্য পথে ধাবিত করে প্রকৃত সত্যকে আড়াল করে মিথ্যার উপস্থাপনা করে। এর নাম যাদু বিদ্যা। আর সম্মোহনী বিদ্যাতো আরো খারাপ। কেমিক্যালের ফাঁদে ফেলে একজন মানুষের চেতনা নষ্ট করা। প্রকৃত সত্য প্রকাশ পেলে তা হবে আইনগত ভাবে দন্ডনীয় অপরাধ। মানুষ মিথ্যাকেই বিশ্বাস করে। সত্য সামনে আসলেও এড়িয়ে যায়। তাই এমন হীন প্রতারনাও থেমে যাবেনা বরং দোদন্ডপ্রতাপেই এগিয়ে যাবে এমন ঘৃন্য প্রতারনা।
১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে হিপনোটিজম নিয়ে গবেষণার জন্য ইংল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত হয় ;The Society for Psychical Research. ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক নিযুক্ত একটি কমিটি বিস্তর অনুসন্ধানের পর রায় দেয় হিপনোটিজম একটি বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি। এরপর যত দিন এগিয়েছে তাবড়-তাবড় চিকিৎসক-বিজ্ঞানীরা এই বিদ্যাটির বিষয়ে অত্যুৎসাহী হয়ে পড়েছেন। সেইসঙ্গে শুরু হয়েছে নিত্যনতুন গবেষণা। অতএব এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে সম্মোহন বা হিপনোটিজম একটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। পৃথিবীতে অনেককিছুই যুক্তিযুক্ত ভাবে ঘটে কিন্তু মানুষের ঘটে সরাসরি সেই যুক্তি খুব সহজেই পৌছেনা বলেই সময় নিয়ে সেটা গবেষনা করে যুক্তি বের করে নয়ত, দৈব কোনকিছু বলে ছুড়ে ফেলে দেয়। জেনে রাখুন, হিপনোটাইজড সবাইকেই করানো সম্ভব।
অনেকে মনে করেন, প্রবল ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন মানুষকে হিপনোটাইজ করা যায় না। এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। দেখা গেছে, মোটামুটিভাবে কোনো জনসংখ্যার ৯০ শতাংশকে হিপনোটাইজ করা যায়। বাকিদের ক্রমশ উপযুক্ত ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে হিপনোথেরাপিতে অভ্যস্ত করে তোলা যায়। হিপনোথেরাপি পদ্ধতি খুব সহজ।অবশ্য হিপনোথেরাপির আসল জোর মোটেই পদ্ধিতে নয়, সাজেশনে। হিপনোথেরাপির উদ্দেশ্য কাউকে হিপনোটাইজ করা নয়, রোগীকে তাঁর সমস্যা থেকে উদ্ধার করা। হিপনোথেরাপি হল প্রোগ্রামিং অফ সাবকনসাস মাইন্ড। এটা অনেক দ্রুত পদ্ধতি, যা কিনা সমস্যার মূলে সরাসরি হিট করতে পারে। তবে সাজেশন ঠিকঠাক না-হলে মনের প্রোগ্রামিংয়ে হয়ে যেতে পারে। কারও কারও ক্ষেত্রে একটা-দুটো অতিরিক্ত শব্দ গ্রহণ বা বর্জন সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। অতএব যথেষ্ট অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত হিপনোথেরাপিস্ট ছাড়া অন্য কারও কাছে থেরাপি নেওয়া উচিত নয়। বহু রকমের অসুখ-বিসুখ সারানো সম্ভব হিপনোথেরাপির মাধ্যমে। সারানো যায় বললে কম বলা হয়, বলা উচিত এক্কেবারে নির্মূল করা যায়, তাও বিনা ওষুধে। যথাযথ ব্যক্তিত্ব ও কেরিয়ার গঠনেও হিপনোথেরাপি ভালো কাজ করে। এ ছাড়া লেখক, শিল্পী, খেলোয়াড়, চিকিৎসক সকলেই তাদের কাজ ভালোভাবে করতে পারে যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নিয়মিত হিপনোসিস অনুশীলন করেন।
নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ফরাসি ফিজিওলজিস্ট চার্লস রিচেট মনে করেন যে, হিপনোসিসের সাহায্যে মানুষের অতীন্দ্রিয় শক্তি বাড়িয়ে দেওয়া যায়। হিপনোটিজম, সম্মোহন বা হিপনোথেরাপি-কে বশিঃকরনের সাথে মেলানোর প্রয়োজন নেই, এটা সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক একটা পদ্ধতি যা মানুষের উপকারেই আসছে।
Source- Quora, Wikipedia etc
–Zhang Bao Hua