প্রকৃতিক ঘটনাগুলোর মধ্যে বজ্রপাত খুব পরিচিত, সুন্দর, রহস্যময় এবং একই সাথে আতঙ্কের। বজ্রপাতের এই ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যের সাথে সাথে আমাদের মনে বিজ্ঞানের আরেকটি চিরন্তন রহস্যের জন্ম দেয়, বজ্রপাতের কারণ কি? ছোটবেলায় এই প্রশ্নের কারণ খুঁজতে গিয়ে আমরা বেশির ভাগ সময় এ উত্তর পেয়েছি, মেঘে মেঘে সংঘর্ষের ফলাফল হলো এই বজ্রপাত।
বজ্রপাত সংক্রান্ত যে প্রশ্ন আমাদের মাথায় ঘুরপাক খায়-
(১) কেন বজ্রপাত হয় ?
(২) বজ্রপাতের সময় বিদ্যুৎ চমকায় কেন?
(৩) বজ্রপাতের সময় শব্দ উৎপন্ন হয় কেন?
(৪) বজ্রপাতের সময় কি পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয়?
★কেন বজ্রপাত হয়?
জলীয়বাষ্প ঘণীভূত হয়ে মেঘে পরিণত হওয়ার সময় এতে প্রচুর স্থির বৈদ্যুতিক চার্জ (electrostatic charge) জমা হয়। মেঘ কিভাবে চার্জিত হয় তা নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে বেশ মতভেদ থাকলেও সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত মতবাদ হচ্ছে, পানিচক্রে জলকণা যখন ক্রমশ উর্ধ্বাকাশে উঠতে থাকে তখন তারা মেঘের নিচের দিকের বেশি ঘনীভূত বৃষ্টি বা তুষার কণার সাথে সংঘর্ষের মুখোমুখি হয়। যার ফলে উপরের দিকে উঠতে থাকা অনেক বাষ্প পরমাণু বেশ কিছু ইলেকট্রন হারায়। যে পরমাণু ইলেকট্রন হারায় তা পজিটিভ চার্জে এবং যে পরমাণু ইলেকট্রন গ্রহণ করে তা নেগেটিভ চার্জে চার্জিত হয়। অপেক্ষাকৃত হাল্কা পজিটিভ চার্জ থাকে মেঘের উপর পৃষ্ঠে এবং ভারী নেগেটিভ চার্জ থাকে নিচের পৃষ্ঠে। যথেষ্ট পরিমাণ পজিটিভ (+) ও নেগেটিভ (-) চার্জ জমা হওয়ার পর পজিটিভ ও নেগেটিভ চার্জ পরস্পরকে আকর্ষণের দরুণ electrostatic discharge প্রক্রিয়া শুরু হয়। discharge তিন ভাবে হতে পারে-
(ক) মেঘের নিজস্ব পজিটিভ (+) ও নেগেটিভ (-) চার্জের মধ্যে (একে বলা হয় intra cloud বা, IC discharge)
(খ) একটি মেঘের পজেটিভ (+) কিংবা নেগেটিভ (-) চার্জের সাথে অন্য মেঘের নেগেটিভ (-) কিংবা পজেটিভ (+) চার্জের সাথে (একে বলা হয় cloud to cloud বা, CC discharging)
(গ) মেঘের পজেটিভ (+) চার্জের সাথে ভূমির (একে বলা হয় cloud to ground বা, CG discharging)
Cloud to Cloud বজ্রপাত, Cloud to Ground বজ্রপাত
Discharge হওয়ার সময় পজেটিভ (+) চার্জ থেকে নেগেটিভ (-) চার্জের দিকে বাতাসের মধ্য দিয়ে স্পার্ক আকারে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। এ ঘটনাই হল বজ্রপাত। বজ্রপাতের শাব্দিক অর্থ হলো ভূমিতে বিদ্যুৎ পতিত হওয়া। তবে সব বজ্রপাতে ভূমিতে বিদ্যুৎ বা চার্জ পতিত হয় না। শুধু মাত্র CG discharging প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন বজ্রপাতে ভূমিতে বৈদ্যুতিক চার্জ পতিত হয়।
★বজ্রপাতের সময় বিদ্যুৎ চমকায় কেন?
বজ্রপাতের সময় বাতাসের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। আমরা জানি বাতাস বিদ্যুৎ অপরিবাহী। কিন্তু মেঘে জমা হওয়া স্থির বিদ্যুৎ এত উচ্চ বিভব শক্তি (১০ মিলিয়ন ভোল্ট পর্যন্ত) উৎপন্ন করে যে, তা বিদ্যুৎ প্রবাহিত হওয়ার জন্য বাতাসের একটা সরু চ্যানেলকে আয়নিত করে পরিবাহী পথ (conductive path) তৈরি করা হয়। আয়নিত পরমাণু থেকে বিকীর্ণ শক্তি তিব্র আলোক ছটা তৈরি হয়।
★বজ্রপাতের সময় শব্দ উৎপন্ন হয় কেন?
Discharge হওয়ার সময় বাতাসের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়, একে বলা হয় air breakdown। এ সময় বাতাসের যে চ্যানেলের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয় তার তাপমাত্রা প্রায় ২৭০০০ ডিগ্রি সেঃ (যা সূর্যের তাপমাত্রা থেকে বেশি) এ উন্নীত হয় এবং বাতাসের চাপ স্বাভাবিক চাপ থেকে ১০ থেকে ১০০ গুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়। এ চাপ এবং তাপমাত্রায় পৌঁছাতে সময় লাগে মাত্র এক সেকেন্ডের কয়েক হাজার ভাগের এক ভাগ। এত কম সময়ে তাপমাত্রা ও চাপের এত ব্যাপক পরিবর্তন চারপাশের বায়ুমণ্ডলকে প্রচণ্ড গতিতে (বিস্ফোরণের মত) সম্প্রসারিত করে। এ সময় যে শব্দ তরঙ্গ উৎপন্ন হয় সেটাই আমরা শুনতে পাই।
★বজ্রপাতের সময় কি পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয়?
ভূমি থেকে ৩ মাইল দূরত্বের বজ্রপাত (lightning strike) গড়ে এক বিলিয়ন থেকে ১০ বিলিয়ন জুল শক্তি উৎপন্ন করে। একটি ১০০ ওয়াট বাল্ব ১ সেকেন্ড জ্বালাতে শক্তি খরচ হয় ১০০ জুল। সে হিসাবে, ১০ বিলিয়ন জুল শক্তি দিয়ে ওই বাল্বকে ১১৬০ দিন বা প্রায় ৩৯ মাস অবিরাম জ্বালানো যাবে। বৈদ্যুতিক শক্তি পরিমাপক একক কিলোওয়াট-আওয়ার হিসেবে এ শক্তি ২৭,৮৪০ কিলোওয়াট-আওয়ার। বাংলাদেশে একটি পরিবার গড়ে প্রতি মাসে প্রায় ১০০- ১৫০ ইউনিট (কিলোওয়াট-আওয়ার) বিদ্যুৎ ব্যাবহার করে। তার মানে একটি বজ্রপাতের বিদ্যুৎ শক্তি জমা করতে পারলে একটি পরিবার ১৮৫ মাস বা, প্রায় ১৫ বছর বিনা পয়সায় বিদ্যুৎ ব্যাবহার করতে পারবেন।
চাইলে আপনিও বজ্রপাতকে ট্র্যাপে ফেলে বিনা পয়সায় বিদ্যুৎ ব্যাবহারের সুযোগ লুফে নিতে পারেন। তবে সে ক্ষেত্রে বজ্রপাত ঘায়েল করতে আপনি সময় পাবেন এক সেকেন্ডেরও কম (কারণ বজ্রপাতের পুরো প্রক্রিয়াটি ঘটে এক সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে)।
থেমে নেই বিজ্ঞানীরা। বজ্রপাত থেকে উৎপন্ন বিপুল পরিমাণ তড়িৎ শক্তিকে ধারণ করে বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের বিষয়ে বিজ্ঞানীরা উৎসাহী হয়ে উঠেছেন এবং তা বাস্তবায়িত করে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন ।
-সংগৃহীত