“...সেই ১৪০০ বছর আগে আমাদের নবী বলে গেছেন টাখনুর নিচে কাপড় না পরার জন্য। আর আজ তোমাদের বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে—টাখনুর ভিতরে পুরুষের সেক্স হরমোন থাকে। প্যান্ট বা কাপড় টাখনুর নিচে পরলে সেখানে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস যেতে না পারলে পুরুষের যৌন ক্ষমতা কমে যায়।...”
আজকাল বিভিন্ন পোস্টে, বক্তব্যে, ওয়াজে এমন কথাগুলো দেখা যায়, শোনা যায়। অথচ অহংকার করে টাখনুর নিচে কাপড় ঝুলাতে হুযূর পাক (সা.) নিষেধ করেছেন। অহংকার না থাকলে তো কোনো সমস্যা নাই।
__________________________________________
حَدَّثَنِي عَنْ مَالِك عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ دِينَارٍ عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ الَّذِي يَجُرُّ ثَوْبَهُ خُيَلَاءَ لَا يَنْظُرُ اللهُ إِلَيْهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
আবদুল্লাহ্ ইবনে উমার (রা) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি অহংকার করে স্বীয় কাপড় টাখনুর নিচে লটকায়, কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে রহমতের দৃষ্টিতে দেখবেন না।” (হাদীসটি ইমাম মালিক এককভাবে বর্ণনা করেছেন)
و حَدَّثَنِي عَنْ مَالِك عَنْ أَبِي الزِّنَادِ عَنْ الْأَعْرَجِ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لَا يَنْظُرُ اللهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِلَى مَنْ يَجُرُّ إِزَارَهُ بَطَرًا
আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, “আল্লাহ্ তা‘আলা কিয়ামতের দিন ঐ ব্যক্তির প্রতি রহমতের দৃষ্টি করবেন না, যে ব্যক্তি অহংকার করে নিজের কাপড় লটকায়।” (সহীহ, মুসলিম ৫৭৮৮)
و حَدَّثَنِي عَنْ مَالِك عَنْ نَافِعٍ وَعَبْدِ اللهِ بْنِ دِينَارٍ وَزَيْدِ بْنِ أَسْلَمَ كُلُّهُمْ يُخْبِرُهُ عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لَا يَنْظُرُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِلَى مَنْ يَجُرُّ ثَوْبَهُ خُيَلَاءَ
ইবনু উমার (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, “আল্লাহ্ তা‘আলা কিয়ামতের দিন ঐ ব্যক্তির প্রতি রহমতের দৃষ্টি করবেন না, যে অহংকার করে নিজের কাপড় নিচের দিকে লটকে দেয়।” (বুখারী ৫৭৮৩, মুসলিম ২০৮৫)
________________________________________
এখন প্রশ্ন হতে পারে, অহংকার করে আবার টাখনুর নিচে কাপড় পরা কী? এর জবাব হল, যখন রাসুল (সা.)-এর যুগে মানুষের দু’টুকরো কাপড়ই জুটতো না, তখন যারা অহংকার করে ঝুলিয়ে কাপড় পরতো, তাদেরকে আল্লাহর রাসুল (সা.) সাবধান করেছেন অহংকার না করার জন্যে।
অথচ এখন মানুষ টাখনুর নিচে কাপড় নিয়ে অনেক বাড়াবাড়ি করে, কিন্তু অহংকার শব্দটা মাঝ থেকে বাদ দিয়ে দেয়। মেইন যেই বিষয়টা—“অহংকার” না করার জন্য হাদিসগুলো আসছে সেটাকে প্রাধান্য না দিয়ে মানুষ প্রাধান্য দিচ্ছে “টাখনুর উপরে কাপড় পরা”কে।
_______________________________________
এবার আসি তাদের দাবীতে, বিজ্ঞান না-কি বলছে, টাখনুর নিচে কাপড় পরলে ‘সেক্স হরমোন’ তথা ‘যৌনক্ষমতা’ কমে যায়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এমন দাবীর পেছনে ন্যূনতম কোনো যুক্তি তথা সত্যতা নেই। টাখনুর নিচে কাপড় পরলে যৌনক্ষমতা কোনোভাবেই কমে যায় না। কেন না টাখনুতে কোনো হরমোন নিঃসরণকারী কোষ বা গ্রন্থি নেই। নারী-পুরুষের যৌনবৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী সেক্স হরমোন মূলত উৎপন্ন হয় নারী ও পুরুষের যৌনাঙ্গের নিকটবর্তী অঙ্গসমূহে– জরায়ু এবং অণ্ডকোষে, টাখনুর ভেতরে বা নিচে নয়, গোড়ালীতেও নয়।
আসুন চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রেক্ষাপটে বিষয়টির বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক—
★ সেক্স হরমোন কয় প্রকার ও কী কী? এসব হরমোন কোন কোন অঙ্গে বা গ্রন্থির মাধ্যমে উৎপন্ন হয় এবং এদের ফাংশন কোন অঙ্গের কোন অংশের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত তথা নির্ধারিত হয়?
⁂ সেক্স হরমোন ৩ প্রকার যা নিম্নরূপ-
* পুরুষালী বৈশিষ্ট্যসূচক সেক্স হরমোন : টেস্টোস্টেরন (Testosterone)
* মেয়েলী বৈশিষ্ট্যসূচক সেক্স হরমোন : ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন (Estrogen & Progesterone)
______________________________________________
⁂ পুরুষালী বৈশিষ্ট্যসূচক হরমোন টেস্টোস্টেরনের উৎপত্তি ও নিয়ন্ত্রণ : পুরুষালী বৈশিষ্ট্যসূচক হরমোন টেস্টোস্টেরন নারী-পুরুষ উভয়েই উৎপন্ন হয়। পুরুষালী বৈশিষ্ট্যসূচক বলে এটি পুরুষে অনেক বেশি পরিমাণে উৎপন্ন হয় এবং নারীতে অনেক কম পরিমাণে উৎপন্ন হয়।
১) পুরুষের ক্ষেত্রে এটি অণ্ডকোষের লেইডিগ কোষ (Leydig cells in testes) থেকে উৎপন্ন হয়।
২) নারীর ক্ষেত্রে এটি ডিম্বাশয় (Ovaries) থেকে উৎপন্ন হয়।
৩) এছাড়াও, নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে এটি খুব সামান্য পরিমাণে অ্যাডরেনাল গ্রন্থি (Adrenal Glands) থেকে উৎপন্ন হয়।
৪) মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস (Hypothalamus) ও পিটুইটারি গ্রন্থি (Pituitary Gland) এই উৎপাদনের সময় ও মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
সোর্স :
* is.gd/HOIvGw
* is.gd/molxpY
এখান থেকে সুস্পষ্ট যে টেস্টোস্টেরন তথা পুরুষালী বৈশিষ্ট্যসূচক সেক্স হরমোন উৎপাদনে টাখনু বা গোড়ালীর আশেপাশের এলাকার ন্যূনতম ভূমিকা নেই। পা একটি পেশী সঞ্চালক অঙ্গ (Motor Organ), পক্ষান্তরে ব্রেইন একটি সংবেদনশীল অঙ্গ (Sensory Organ)। ফলে বার্তা বা সিগন্যাল পাঠানোর ক্ষমতা ব্রেইনের থাকলেও পায়ের নেই। ব্রেনের বার্তায় তথা ব্রেনের অধীনে পা কাজ করে। যেহেতু পায়ে কোন গ্রন্থি নেই, সেহেতু ব্রেনের অধীনে পা কোন ধরনের হরমোন নিঃসৃত করতে পারে না বরং শুধুমাত্রই পেশীসঞ্চালন সংশ্লিষ্ট কাজই করে।
সুতরাং, *টাখনুর নিচে কাপড় পরলে পুরুষের সেক্স হরমোন তথা যৌনক্ষমতা কমে যাবে*—এমন দাবী সম্পূর্ণ মিথ্যা।
_____________________________________________
⁂ মেয়েলী বৈশিষ্ট্যসূচক হরমোন ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরনের উৎপত্তি ও নিয়ন্ত্রণ :
১) মেয়েলী বৈশিষ্ট্যসূচক সেক্স হরমোনের মধ্যে ইস্ট্রোজেন উৎপন্ন হয় ডিম্বাশয় (Ovaries), অ্যাডরেনাল গ্রন্থি (Adrenal Gland) , চর্বিকোষ (Adipose/Fat Tissues) ও গর্ভাবস্থায়, মা ও শিশুর সংযোগ রক্ষাকারী অঙ্গ (Placenta) থেকে। ছেলেদের ক্ষেত্রে এটি খুব সামান্য পরিমাণে অণ্ডকোষ (Testes) থেকে উৎপন্ন হয়।
২) এদিকে মেয়েলী বৈশিষ্ট্যসূচক আরেকটি হরমোন প্রজেস্টেরন মূলত উৎপন্ন হয় ডিম্বাশয়ের কর্পাস লুটিয়াম (Corpus Luteum) নামের একটি অঙ্গ থেকে তবে ডিম্বাশয় (Ovaries), অ্যাডরেনাল গ্রন্থি (Adrenal Gland) ও গর্ভাবস্থায় মা ও শিশুর সংযোগ রক্ষাকারী অঙ্গ (Placenta) থেকেও এটি সামান্য পরিমাণে উৎপন্ন হয়।
৩) মস্তিষ্কের সম্মুখভাগের পিটুইটারি গ্রন্থি (Anterior Pituitary) ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরনের উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে।
সোর্স :
* is.gd/X97pvb
* is.gd/cS4ble
* is.gd/dkrGuR
এখান থেকে সুস্পষ্ট যে, ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন তথা মেয়েলী বৈশিষ্ট্যসূচক সেক্স হরমোনগুলো উৎপাদনে টাখনু বা গোড়ালীর আশেপাশের এলাকার কোনো ভূমিকা নেই। এদিকে, পায়ের গোড়ালিতে পর্যাপ্ত চর্বি কোষও নেই যে এটি ইস্ট্রোজেন সামান্য পরিমাণে উৎপাদন করবে।
____________________________________________
পায়ের গোড়ালিতে যে কোন হরমোনই উৎপন্ন হয় না সেটি আমরা নিচের সোর্সগুলো থেকে সংক্ষেপে জেনে নিতে পারি–
* is.gd/pe9fBK
* is.gd/OdJRd7
যারা এই প্রসঙ্গে একদম বিস্তারিত জানতে চান তারা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ এন্ডোক্রিনোলজি গ্রন্থ Williams Textbook of Endocrinology থেকে বক্তব্যের সত্যতা সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করে নিতে পারেন—
* is.gd/tkkCjW
বাস্তবিক জীবনে একজন পা হারানো পঙ্গু ব্যক্তি ব্যক্তিগত জীবনে নানাবিধ অসুবিধার সম্মুখীন হলেও তার ল্যাব টেস্টের রিপোর্টসমূহ যাচাই করে যে কেউই বুঝতে পারবেন যে, তার রক্তরসে Serum Estrogen/Progesterone/Testosterone Level কমে যাচ্ছে না, যা থেকে সুস্পষ্ট হয় যে, পায়ের সাথে সেক্স হরমোন বাড়া বা কমা তথা যৌনক্ষমতার কোনো সম্পর্ক নেই।
____________________________________________
★ টাখনুতে আলো বাতাসের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু?
১) টাখনুতে আলো বাতাস লাগলে সেটি কোনোভাবেই খারাপ কিছু নয় তবে এতটা গুরুত্বপূর্ণও নয়, কেন-না ২৪ ঘন্টায় মানুষ অন্তত সামান্য কিছু সময় বাইরে অবস্থান করে তথা সূর্যালোকে থাকে যাতে করে মোটামুটিভাবে শরীরে ভিটামিন ডি পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপন্ন হয়ে যায়। টাখনুতে সূর্যালোক না লাগলেও সমস্যা নেই। হাত ও পায়ের মোটামুটি অংশে সূর্যালোক পৌঁছুলেই সেটি সারা শরীরে ভিটামিন ডি এর অভাব পূরণ করে। মোটামুটিভাবে সপ্তাহে ৩ দিন সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৩টার মধ্যে ১৫-৩০ মিনিট রোদের আলোতে অবস্থান করলেই শরীরে ভিটামিন ডি পর্যাপ্ত পরিমাণে তৈরি হয়।
* is.gd/6nSe3X
* is.gd/I4inEO
২) টাখনুতে আলোর ভূমিকা নগণ্য কিন্তু বাতাসের ভূমিকাও আরো বেশি নগণ্য। কোনো ধরনের গবেষণায় এটা প্রমাণিত হয়নি যে টাখনুতে বাতাস না লাগলে কোনো ধরনের স্বাস্থ্যসমস্যার সৃষ্টি হবে।
৩) যৌনক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণ বা বাড়ানোর জন্য মেডিকেল সায়েন্সের কোথাও টাখনুর নিচে কাপড় পরার কোনো উল্লেখ নেই এবং আরো সম্প্রসারিত করে বলা যায়, পৃথিবীর কোনো বিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিজ্ঞান গ্রন্থেই এরকম কোনো প্রমাণ নেই। নিচে তিনটি মেডিকেল সাইট দেওয়া হলো বিস্তারিত জানার জন্য।
* is.gd/FVyFR9
* is.gd/uNhUrT
* is.gd/FB9uzp
________________________________________________
যাই হোক, ধর্মীয় বিষয়টা নিয়ে আসলে আমি আলোচনা করতে যাইনি। কিন্তু ধর্মীয় একটা বিষয়কে—হাদিসকে গ্লোরিফাই করার জন্য সম্পূর্ণ বানোয়াট, অপ্রাসঙ্গিক, অবৈজ্ঞানিক একটা কুযুক্তি দিয়ে সেটাকে 'বিজ্ঞান' বলে চালিয়ে দিলে তো আর হাদিসটার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে না। বরং হাদিসটাকেই অপমান করা হচ্ছে।