সাধারণভাবে পদার্থ প্রকৃতিতে তিনটি অবস্থায় থাকতে পারে। এগুলো হল কঠিন, তরল ও গ্যাসীয়। এদের মধ্যে কঠিন পদার্থের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি, তরলের তুলনামূলক কম এবং গ্যাসীয় পদার্থের ঘনত্ব অত্যন্ত কম। কঠিন পদার্থকে তাপ দিলে তা তরলে এবং তরলকে তাপ দিলে তা গ্যাসীয় বা বায়বীয় পদার্থে পরিণত হয় (কিছু ক্ষেত্রে ভিন্নতা রয়েছে)। আবার তাপ অপসারণ করতে থাকলে ঠিক উল্টো ঘটনা ঘটে।
এবার একটি কঠিন পদার্থের কথা ভাবুন যাকে তাপ দিলে তরলে পরিণত করা যাবে। এবার ওই কঠিন পদার্থকে যদি তাপ দিতে থাকেন তাহলে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় তরলে পরিণত হতে শুরু করবে। আর এই অবস্থায় পদার্থের আয়তন বাড়তে থাকে।
তাপ প্রয়োগ করলে পদার্থের পরমাণু গুলো শক্তি গ্রহণ করে পূর্বের তুলনায় অধিকতর দ্রুত কাপতে থাকে। এই অধিক কম্পনের জন্য পরমাণুগুলোর পূর্বের তুলনায় অধিক স্থানের প্রয়োজন হয়। এতে করে পরমাণু সমূহের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। ফলে পদার্থের আয়তন বেড়ে যায়।
এই পদার্থটিকে যদি আরও তাপ দিতে থাকেন তাহলে পরমাণুর সমূহের মধ্যে দূরত্ব আরও বাড়তে থাকবে এবং এটি গ্যাসীয় পদার্থে পরিণত হবে। এ অবস্থায় পদার্থের আয়তন হবে সর্বোচ্চ।
এবার উল্টো প্রক্রিয়াটি চিন্তা করুন। গ্যাসীয় পদার্থের তাপ অপসারণ করলে এটি শীতল হয়ে আয়তন কমে তরলে পরিণত হবে। এই তরলের তাপমাত্রা আরও কমালে আয়তন কমে সেটি কঠিন পদার্থে পরিণত হবে।
হ্যাঁ, এ পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল। মূল সমস্যাটি তৈরি হয় পানি যখন বরফে পরিণত হয়। পূর্বের আলোচনা অনুযায়ী আমরা জানলাম যে তরল কঠিনে পরিণত হলে পদার্থের আয়তন কমে। কিন্তু পানির ক্ষেত্রে এই ঘটনাটি সম্পূর্ণ বিপরীত। পানি বরফে পরিণত হলে আয়তন না কমে উল্টো বেড়ে যায়।
তাহলে কেন এমনটি ঘটে?
মূলত পানির অণুর অদ্ভুত গঠন এই ঘটনাটির জন্য দায়ী।
পানিতে প্রতিটি অণুসমূহের মধ্যে একটি অক্সিজেন পরমাণু দুটি হাইড্রোজেন পরমাণুর সাথে সমযোজী বন্ধন দ্বারা গঠিত। পানিতে অক্সিজেন পরমাণু ঈষৎ ঋণাত্মক আধানযুক্ত এবং হাইড্রোজেন পরমাণু ঈষৎ ধনাত্মক আধানযুক্ত হয়ে অবস্থান করে। ফলে সমযোজী বন্ধনের পাশাপাশি দুটি পানির অণুর মধ্যে হাইড্রোজেন পরমাণুর সাথে অক্সিজেন পরমাণুর আকর্ষণ বলের মাধ্যমে একটি বন্ধন গড়ে ওঠে, যাকে আমরা হাইড্রোজেন বন্ধন বলে থাকি।
যখন পানির অণুগুলি তরল অবস্থায় থাকে, তখন স্বাভাবিকভাবেই পরমাণুগুলো ক্রমাগত জোড়ে জোড়ে কাঁপতে থাকে। ফলে হাইড্রোজেন বন্ধনগুলি স্থির থাকতে পারে না। এরা নির-বিচ্ছিন্নভাবে গঠিত হতে থাকে এবং ভাংতে থাকে। এই প্রক্রিয়াটি ক্রমাগত চলে। হিসাব করে দেখা গেছে 25 ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় একটি পানির অণুতে গড় হাইড্রোজেন বন্ডের পরিমাণ 3.4।
এবার তরল পানিকে বরফে রূপান্তরের সময় তাপ অপসারণ করা হয়। ফলে পানির অণুগুলো শক্তি হারাতে থাকে এবং এর স্পন্দনের হার কমে যায়। শক্তি কমে যাওয়ার দরুন এই হাইড্রোজেন বন্ধন ভেঙে যাওয়ার হার কমে যায় এবং অণুগুলির মধ্যে আরও স্থিতিশীল হাইড্রোজেন-বন্ধন তৈরি হতে থাকে।
ফলে, তাপমাত্রা হিমাঙ্কের কাছে পৌঁছে যাওয়ার পরে পানির অণুগুলোর স্ফটিক জাল কাঠামোর কারণে গড় হাইড্রোজেন বন্ডের সংখ্যা সর্বোচ্চ বন্ড সংখ্যা 4 এর কাছাকাছি পৌছায়। এমন স্ফটিক বা ক্রিস্টাল জাল কাঠামোর জন্য তরলে একটি পানির অণু তার পার্শ্ববর্তী সকল পানির অণুর সাথে হাইড্রোজেন বন্ধন গঠন করে। ফলে পানির অণুটি তার পার্শ্ববর্তী সকল পানির অণু থেকে হাইড্রোজেন বন্ডের সমান দূরত্বে অবস্থান করে। ফলে অধিক স্থান উন্মুক্ত বা ফাকা রয়ে যায়। ফলে আয়তন বেড়ে যায়।
এভাবেই যখন অন্যান্য পদার্থের ক্ষেত্রে কঠিনে রুপান্তর হলে আয়তন কমে যায় সেখানে তরল পানিকে বরফে পরিণত করা হলে এর আয়তন না কমে উল্টো বেড়ে যায়।