সেলফি শব্দের সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। নিজেই নিজের ছবি তুলাকে বলে সেলফি। অনেকটা শখের বশে কেউ কেউ সেলফি তুলেন। কিন্তু সেলফ টক বা একা একা কথা বলার সঙ্গে হয়তো আমরা অনেকেই তেমন পরিচিত নই।
একা একা কথা বলা বা নিজে নিজে কথা বলা মানসিক রোগ সিজোফ্রেনিয়া বা মুড ডিসওর্ডারের লক্ষণ। ওই রোগীরা অনবরত একা একা কথা বলতে থাকেন। তাদের কথাগুলোর মধ্যে তেমন একটা সামঞ্জস্যতা নেই।
এরকম একা একা কথা বলা টুকটাক আমরা বলি। রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে আমরা একা একা কথা বলে ফেলি। শিশুরাও খেলতে গিয়ে খেলনার সঙ্গে বা পুতুলের সঙ্গে একা একা কথা বলে। তবে ওই কথাগুলোর মধ্যে পারিপার্শ্বিক সামঞ্জস্যতা আছে। এটা মানসিক রোগের লক্ষণ নয়।
ঘোরতর মানসিক রোগীদের রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনবরত কথা বলতে দেখা যায়। বাংলাদেশে এ রোগীদের তাচ্ছিল্য করে পাগল ডাকা হয়। মূলত এ সম্পর্কে আমরা জানি না বলেই এমন ডাকি। কেন মানসিক রোগীরা একা একা কথা বলতে থাকে?
মানসিক রোগীদের মধ্যে হয় এমন হয় কারণ তাদের অডিটরি হ্যালুসিনেশন। অডিটরি হ্যালুসিনেশন মানে হলো অবাস্তব কিছু শুনতে পাওয়া। অর্থাৎ অস্তিত্ব নেই এমন কিছুর আওয়াজ শোনা। ব্যাপারটা স্বাভাবিক মানুষের ক্ষেত্রেও হতে পারে!
এই যেমন ধরুণ, আপনি গভীর চিন্তায় মগ্ন। হঠাৎ শুনলেন কে জানি ডাকলো; কিংবা কিসের আওয়াজ কানে আসলো। আপনি তাকিয়ে দেখলেন কেউ নেই। অনেকটা শ্রুতিভ্রম মনে হয় আপনার কাছে।
গভীর রাতে এরকম হয়। অঘুমা রোগ, দুশ্চিন্তা, এনজাইটি এসবে টুকটাক এরকম হতেই পারে। কেউ কেউ এসবে অনেক সময় ভূত ভূত বলে দৌঁড় দিয়ে হাত পা ভাঙে। দিনে তারা গল্প করে বেড়ান, কাল রাতে আপনাকে ভূত তাড়া দিয়েছে। আসলে এটা হ্যালুসিনেশন।
কিন্তু মানসিক রোগীদের ক্ষেত্রে এই হ্যালুসিনেশন অনবরত হতে থাকে। তারা অনবরত শুনতে থাকেন, তাদের সঙ্গে কেউ কথা বলছে, কিংবা তাদের নিয়ে কেউ কথা বলছে। তাই তারা এসব কথার উত্তর ও দিতে থাকেন। অগোছালো অসামঞ্জস্যপূর্ণ কিংবা সামঞ্জস্যতাপূর্ণ। যারা মদপান করেন বা যারা মাদকসেবীদের তাদেরও অনেক সময় হ্যালুসিনেশন হয়।
মানসিক রোগগুলো সত্যিই অদ্ভূত। হাত পা, চোখ নাক কান সবই ঠিক আছে কিন্তু কোথায় যেনো একটু গরমিল। যার জন্যে সবকিছুতে গরমিল।
ভয়ংকর হ্যালুসিনেশন
হ্যালুসিনেশন অনেক ধরনের হয়ে থাকে। অবাস্তব কিছু দেখাও হ্যালুসিনেশন। একে ভিজুয়াল হ্যালুসিনেশন বলে। এই যেমন আপনি দেখলেন আপনার মৃত মা-বাবা বা কোন আত্মীয়-স্বজন আপনার সামনে হঠাৎ দাঁড়িয়ে আছেন। কিংবা আপনি দেখলেন, আপনি প্যারিসের রাস্তার ফুটপাতে দাঁড়িয়ে বাদাম বিক্রি করছেন। এটা এক্সট্রা ক্যাম্পেইন হ্যালুসিনেশন।
রিফ্লেক্স হ্যালুসিনেশন বলে ইন্টারেস্টিং একটা হ্যালুসিনেশন আছে, এটা হলো আপনার চোখের সামনে নীল রঙ আলো বা পর্দা, কিছু ভাসলো ওমনি আপনি একটা মিউজিক শুনতে পেলেন। নিজেই নিজের শরীরকে দেখতে পাওয়াকে বলে অটোস্কোপিক হ্যালুসিনেশন। এগুলো ভয়ংকর আকার ধারণ করে। ঘোরতর মানসিক রোগে এরকম হয়। তবে ডিপ্রেশন বা বিষন্নতা, এনজাইটি, মানসিক চাপ, অঘুমা এসবেও হয়। ডিমেনসিয়া বা পারকিনসন রোগেও এমন হতে পারে।
যেমন অনেক সময় ডিমেনসিয়ার পেশেন্ট এসে বলেন, কাল রাতে আমি আমার বড় ছেলেকে ঘুরতে ফিরতে দেখলাম। অথচ তার বড় ছেলে হয়তো অনেক আগেই মারা গিয়েছেন। ডিমেনশিয়া আক্রান্তরা সাধারণত ঘরের মুরুব্বী দাদা বা নানা প্রকৃতির হন। এদের এ আচরণ আর কথাবার্তায় অনেকে অনেক সময় ভুল করে তাদের পাগল হয়ে ভাবেন। কারণ তাদেরও অনেক সময় হ্যালুসিনেশন হয় এমনকি ডিলিউসন হয়।
রোগের নাম ডিলিউসন
ডিলিউসন হলো অলীক বিশ্বাস। এতে তারা অনেক সময় না বুঝে উলটোপালটা কথা বলেন, কাজকর্ম করে বসেন। পারসিকিউটরি ডিলিউসনের জন্যে ডিমেনসিয়া আক্রান্ত বয়স্করা অনেক সময় বিশ্বাস করেন এবং বলেন, তার সকল সম্পত্তি তারই ছেলেমেয়েরা আত্মসাৎ করতে চাচ্ছে, তাকে তাকে মেরে ফেলতে চাচ্ছে।
বৃদ্ধ বয়সে ভীমরতি কেন?
একবার এক ডিমেনসিয়া পেশেন্টকে তার ছেলেরা অনেকটা বেঁধে জোর করে নিয়ে আসলো চেম্বারে। বললো, বাবা পাগল হয়ে গেছেন, ভীমরতিতে পেয়েছে। তিনি নাকি এক ছেলের বউকে জড়িয়ে ধরেছেন। আসলে বৃদ্ধ ওই ব্যক্তিটি ছিলেন ডিমেনসিয়ার পেশেন্ট। ঘটনার কিছুই তিনি মনে করতে পারলেন না। একে বলে লস অব ইনহিবিশন। সাধারণত ফ্রন্টো-টেমপোরাল টাইপের ডিমেনসিয়াতে ব্রেইনের ফ্রন্টাল লোব ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে এমন হয়।
মানসিক রোগের চিকিৎসা যেভাবে করা হয়
মানসিক রোগ বা সিজোফ্রেনিয়াতে অনবরত হ্যালুসিনেশন হয় ব্রেইনের ডোপামিন নিউরোট্রান্সমিটার মাত্রাতিরিক্ত হওয়াতে। এজন্যে ডোপামিন রিসেপ্টর ব্লকার ঔষধ দেওয়া হয়। এতে অবিশ্বাস্য রকমভাবে হ্যালুসিনেশন বন্ধ হয়ে যায়। রোগীদের একা একা কথা বলা কমে আসে। এক সময় সে সাধারণ মানুষের মতই সুস্থ হয়ে উঠে।
বিষয়টি একজন সাইকিয়াট্রিস্টের চেম্বারে কিংবা একটি মানসিক রোগ হাসপাতালে গেলে অবাক বিস্ময়ে অবলোকন করা যাবে। যে রোগীটি এক মাস আগে অসংলগ্ন কথাবার্তা আর আচরণ নিয়ে আসছিলো, যাকে অনেকটা ধরে বেঁধে মেরে চেম্বারে আনা হয়েছিল, এক মাস পর সে কী সুন্দর সুস্থ! দিব্যি সবার সঙ্গে চলাফেরা করছে, গালগল্প করছে, কাজকর্ম করছে।
লেখক: ডা সাঈদ এনাম
এমবিবিএস (ডিএমসি, কে ৫২), এমফিল (সাইকিয়াট্রি)
সাইকিয়াট্রিস্ট, ইউএইচএফপিও, দক্ষিণ সুরমা, সিলেট।