মানুষ সহ প্রায় সকল স্থলচর প্রাণীরা পানিতে ডুবে গেলে সল্প সময়ের ভেতর মারা যায়। অন্যদিকে পানিতে বসবাসকারী জীব অর্থাৎ জলজ প্রাণীসমূহ (বিশেষত মাছ) পানি ছেড়ে ডাঙায় উঠালেই মারা যায়। কিন্তু এর কারণ কি? মাছেরাও তো অক্সিজেন নেয়। তাহলে অক্সিজেন পেলেও পানি ছাড়া মাছ মারা যায় কেনো ? চলুন এ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক…
পানি ছাড়া মাছ মারা যাবার কারণ মূলত দুটি :
শ্বসন
পানির চাপ
শ্বসন বা শ্বাস প্রক্রিয়া :
মাছ সহ জলজপ্রাণী সমূহ পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন ব্যবহার করে শ্বাসকার্য চালায় ও বেঁচে থাকে। কিন্তু পানির চেয়ে তো বায়ুতে অক্সিজেনের ঘনত্ব বা পরিমাণ বেশি তাহলে মরার কারণ কি?
কারণ হলো মাছের শ্বাসযন্ত্র। মাছ ফুলকার সাহায্যে শ্বাস নেয়। মাছ পানিতে চলার সময়ে মুখ হা করে থাকে যা দিয়ে পানি প্রবেশ করে এবং ফুলকার ছিদ্র (কানকো) দিয়ে বেরিয়ে যায়। এই পানি যখন ভেতরে ঢুকে, তখন ফুলকার কাছে থাকে অক্সিজেন, যা কিনা ফুলকার সংস্পর্শে এলে ফুলকায় থাকা বায়ু সংগ্রাহক মেকানিজম এর মাধ্যমে মাছের দেহে চলে যায়। মেকানিজমটা হলো এই, পানিতে ফুলকার অংশগুলো চারপাশ থেকে উন্মুক্ত থাকে ও সবদিক থেকে অক্সিজেন নিতে পারে। তো মাছ যদি ডাঙায় তুলে আনা হয়, তখন ফুলকার এই মেকানিজম আর কাজ করেনা। ফুলকা তখন বায়ু থেকে শুধু বায়ুতে উন্মুক্ত অংশ দিয়েই অক্সিজেন নিতে পারে ফলে মাছ শ্বাসকষ্টে মারা যায়।
একইভাবে মানুষ সহ প্রাণী ডুবে গেলে মানুষের নাক মুখ দিয়ে পানি ঢুকে যায়, যেগুলো ফুসফুসে চলে যায়। কিন্তু আমাদের ফুসফুস পানি থেকে অক্সিজেন আলাদা করার জন্য তৈরি নয়, যার কারণে মানুষ শ্বাস নিতে পারেনা এবং পরিশেষে দম আটকে মারা যায়…
পানির চাপ :
আমরা জানি, সেসব পদার্থের ভর আছে, তারা অভিকর্ষ বলের প্রভাবে চাপ প্রয়োগ করে। পানি বাতাসের তুলনায় প্রায় ৬০০ গুন বেশি ঘন। পানির প্রতি ৩৩ ফুট গভীরতায় পানির চাপ এক এটম বায়ুর চাপের আকারে বাড়ে। অর্থাৎ আমাদের মাথার উপরে থাকা এই ৪০০ কিলোমিটার বায়ু মন্ডল একক ক্ষেত্রফলের (যেমনঃ এক বর্গ মিটার বা এক বর্গ ইঞ্চি) উপরে যে চাপ প্রয়োগ করে সেই চাপ ৩৩ ফুট বা ১০.০৫৮৪ মিটার পানির নিচের সম ক্ষেত্রফলের উপরে পানির চাপের সমান। ৬৬ ফুট নিচে পানির চাপ বায়ুমন্ডলের চাপের দ্বিগুন হয়ে যাবে। এভাবে প্রতি ৩৩ ফুট অন্তর এই চাপ ১ এটম হারে বাড়তেই থাকবে।
আমরা জানি যে, চাপ যত বাড়ে বস্তু ততই সংকুচিত হয়। সেক্ষেত্রে মাছ পানির নিচে বা গভীরে থাকে বিধায় তাদের দেহের ব্লাড প্রেসার, ফুসফুসের বায়ু থলীর প্রেসার সব কিছু বেশি থাকে। যখন মাছকে উপরে উঠানো হয় বা ডাঙায় আনা হয়, তখন বাইরের চাপ কমতে থাকে ফলে মাছের দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সমূহ যেগুলো বেশি চাপে ছিলো, ওগুলো দেহ থেকে বায়ু ছেড়ে বাইরের চাপের সাথে সমতা আনার চেষ্টা করে। এই কারণে মাছের দেহ ফুলে যায়, অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, চোখ কোটর থেকে বেরিয়েও আসতে পারে। চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে মাছ মারা যায়…
একই কারণে পানিতে ডুবে মরা মানুষেরও চোখ বড় হয়ে যায়, দেহ ফুলে যায় ও জিভ বেরিয়ে আসে। যদিও এর সাথে ব্যাকটেরিয়ার ভূমিকাও রয়েছে !
মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায় কেনো?
অন্যদিকে মানুষ যখন পানিতে ডুবে যায়, তখন দেহ পানির চাইতে কম ঘনত্বের হওয়ায় দেহ প্রাথমিকভাবে ভাসতে থাকে। তবে যখন নাক মুখ দিয়ে দেহে পানি ঢুকতে থাকে তখন দেহের ঘনত্ব পানির চেয়ে বেড়ে যায় ফলে মানুষ পানিতে ডুবে যায়। ডুবতে থাকা অবস্থায় মানুষ বা প্রাণীর দেহ যত গভীরে যেতে থাকে, ততই দেহের উপরে পানির চাপ বাড়তে থাকে। ফলে এই চাপের কারণে দেহ থেকে বাতাস বের হয়ে যেতে থাকে, সংকুচিত হতে থাকে ও ঘনত্ব আরো বেড়ে যায়। ফলে আরো গভীরে দেহ ডুবে যেতে থাকে। একসময় মানুষের মৃত্যু ঘটে…
ডুবুরিরা যখন ডুব দেয়, তখন অক্সিজেন ছাড়াও প্রায় ৭৫% নাইট্রোজেন ব্যবহার করে। তারা গভীরে ডুব দেয়ার পর দেহের বায়ুর চাপ পানির সাথে সমতা রাখার জন্য এই নাইট্রোজেন ব্যবহার করে। এরপর পানির উপরে ফেরত আসার সময়ে তারা ধীরে ধীরে আসে ও ঘন ঘন শ্বাস নেয়, যাতে উপরের লো প্রেসারের কারণে দেহের রক্ত থেকে আস্তে আস্তে বায়ু বের হয়ে বাইরের চাপের সাথে সমতা রাখতে পারে। এখন এটা না করে তারা যদি একদম এক নাগাড়ে উপরে চলে আসে, তখন দেহে দ্রবীভূত অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন বাইরের চাপের সাথে সমতা রক্ষার জন্য দ্রুত রক্ত ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে যেয়ে বুদবুদের সৃষ্টি করবে। কোকের বোতলের ছিপি খুললে যে রকম বুদবুদ দেখা যায়, ঠিক ওই রকম অবস্থার তৈরি হবে তখন। এর ফলে দেহে প্রচণ্ড যন্ত্রণা এমনকি মৃত্যুও ঘটতে পারে। এজন্য ধীরে ধীরে উপরে উঠেন ডুবুরিরা…
এবং এই একই কারণে মহাকাশে প্রেসারাইজড স্পেসস্যুট ইউজ করতে হয়। নয়ত বায়ু শূন্য মহাকাশে বা বায়ুশূন্য কোনো গ্রহ বা উপগ্রহে যাদের বায়ুর চাপ পৃথিবীর চেয়ে কম, সেখানে খালি গায়ে গেলে মানুষের দেহ ফেটে যাবে, রক্ত ফুটতে শুরু করবে…
তথ্যসূত্র : ছারপোকা ওয়েবসাইট