ইলেকট্রিক ঈল এর বৈজ্ঞানিক নাম Electrophorus electricus। আসলে এটি একটি মাছ, কিন্তু এটি সাপের মতো দেখতে। এর শরীরে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করার ক্ষমতা আছে বিশেষ ধরনের কোষের মাধ্যমে, যাকে বলা হয় ইলেকট্রোসাইট (electrocyte)। এই ইলেকট্রোসাইটগুলো একত্রে কাজ করে একটা জৈব-বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা তৈরি করে, যা অনেকটা ব্যাটারির মতো কাজ করে।
১. শারীরবৃত্তীয় গঠন
ইলেকট্রিক ঈলের শরীরের প্রায় ৮০% অংশ জুড়ে থাকে তিনটি বিশেষ অঙ্গ: মেইন অর্গান (Main Organ), হান্টার’স অর্গান (Hunter’s Organ) এবং স্যাক্স অর্গান (Sachs Organ)। এই অঙ্গগুলোতে হাজার হাজার ইলেকট্রোসাইট থাকে, যেগুলো সিরিজে সাজানো। একটা ইলেকট্রোসাইট নিজে থেকে খুব কম ভোল্টেজ তৈরি করে (প্রায় ০.১৫ ভোল্ট), কিন্তু যখন হাজার হাজার ইলেকট্রোসাইট একসঙ্গে কাজ করে, তখন এরা ৬০০-৮০০ ভোল্ট পর্যন্ত বিদ্যুৎ তৈরি করতে পারে। এই ভোল্টেজ শিকার ধরতে এবং শত্রু থেকে বাঁচতে ব্যবহৃত হয়।
২. ইলেকট্রোসাইটের কাজের প্রক্রিয়া
ইলেকট্রোসাইট হলো বিশেষ ধরনের পেশি কোষ, যেগুলো বিবর্তনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ তৈরির জন্য রূপান্তরিত হয়েছে। এদের কাজ অনেকটা নিউরন বা স্নায়ুকোষের মতো, কিন্তু উদ্দেশ্য ভিন্ন। প্রতিটি ইলেকট্রোসাইটের দুটি দিক থাকে: একটা স্নায়ু দ্বারা নিয়ন্ত্রিত (নার্ভ-ইনারভেটেড) এবং অন্যটা না। এখানে বিদ্যুৎ তৈরির জন্য যে প্রক্রিয়া কাজ করে, তা হলো মেমব্রেন পটেনশিয়াল (Membrane Potential) এবং আয়ন ট্রান্সপোর্ট (Ion Transport)।
বিশ্রামের অবস্থা (Resting State): সাধারণ অবস্থায়, ইলেকট্রোসাইটের ভেতরে পটাশিয়াম আয়ন (K⁺) বেশি থাকে, আর বাইরে সোডিয়াম আয়ন (Na⁺) বেশি থাকে। এই আয়ন গ্রেডিয়েন্ট মেমব্রেনের ওপর একটা সম্ভাব্য তফাৎ (potential difference) তৈরি করে, যাকে বলে রেস্টিং মেমব্রেন পটেনশিয়াল (প্রায় -৭০ mV)।
অ্যাকশন পটেনশিয়াল (Action Potential): যখন ঈলের স্নায়ুতন্ত্র থেকে সংকেত আসে, তখন ইলেকট্রোসাইটের মেমব্রেনে থাকা ভোল্টেজ-গেটেড সোডিয়াম চ্যানেল (Voltage-gated Na⁺ channels) খুলে যায়। Na⁺ আয়ন কোষের ভেতরে ঢুকে পড়ে, ফলে মেমব্রেন পটেনশিয়াল ইতিবাচক হয়ে যায় (প্রায় +৪০ mV)। এরপর পটাশিয়াম চ্যানেল (K⁺ channels) খুলে K⁺ বাইরে বেরিয়ে যায়, যাতে পটেনশিয়াল আবার শূন্যের কাছে ফিরে আসে।
সিরিজে সংযোগ: একটা ইলেকট্রোসাইটের এই ভোল্টেজ তফাৎ খুব কম (০.১৫ V), কিন্তু হাজার হাজার ইলেকট্রোসাইট যখন সিরিজে সংযুক্ত হয়, তখন ভোল্টেজ যোগ হয়ে বড় হয়। এটাই বিদ্যুৎ তৈরির মূল কারণ।
৩. রাসায়নিক ও জৈবিক ভিত্তি
এই প্রক্রিয়ার জন্য শক্তি আসে এটিপি (ATP) থেকে। Na⁺/K⁺ পাম্প (Sodium-Potassium Pump) নামে একটি প্রোটিন আয়ন গ্রেডিয়েন্ট বজায় রাখে। এটি সক্রিয় পরিবহন (active transport) প্রক্রিয়ায় ATP ভেঙে Na⁺ বাইরে এবং K⁺ ভেতরে পাঠায়। এই শক্তি ব্যয়ের ফলে ইলেকট্রোসাইট প্রতিবার বিদ্যুৎ তৈরির জন্য প্রস্তুত থাকে।
৪. ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ
ইলেকট্রিক ঈল এই বিদ্যুৎ দুইভাবে ব্যবহার করে:
শিকার ধরা: উচ্চ ভোল্টেজ (৬০০-৮০০ V) দিয়ে শিকারকে অজ্ঞান বা মেরে ফেলে।
নেভিগেশন: কম ভোল্টেজ (১০ V) দিয়ে ইলেকট্রোলোকেশন (electrolocation) করে, যাতে পানির মধ্যে বস্তু শনাক্ত করতে পারে।
বিদ্যুৎ মানে চার্জের প্রবাহ। এখানে ইলেকট্রোসাইটগুলো সিরিজে থাকায় ভোল্টেজ (V = IR) বাড়ে, আর পানির মাধ্যমে কারেন্ট প্রবাহিত হয়। ঈলের শরীরে প্রায় ২-১০ অ্যাম্পিয়ার কারেন্ট তৈরি হতে পারে, যা মারাত্মক। এটি একটা জৈব-বৈদ্যুতিক জেনারেটরের মতো কাজ করে।