কোহিনূর হীরা পৃথিবীজুড়ে বহুল আলোচিত একটি হীরা। কোহিনুরের সাথে গেঁথে আছে নানা মিথ, বিশ্বাস ও গল্প। কেউ কেউ ভাবেন এ হীরাটি ভীষণভাবে অভিশপ্ত। আবার হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, কোহিনূর ছিল অর্জুনের বাহুর অলঙ্কার।
অনেকে মনে করেন, কাকাতিয়া রাজবংশের দেবীমন্দিরে দেবীর চোখ হিসেবে কোহিনুর ব্যবহার করা হতো। সবার বিশ্বাস, আলোচনা, দ্বন্দ্ব নিয়েই কোহিনূর এখনও পৃথিবীবাসীর কাছে ঐতিহাসিক রহস্যের নাম।
কোহিনূর হীরার সন্ধান পাওয়া যায় তের শতাব্দীতে। গবেষকদের মতে, ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টার জেলার সন্তোষনগর অঞ্চলের কল্লর খনি থেকে এ হীরাটি উত্তোলন করা হয়। কোহিনুরের সাথে দরিয়া–ই–নূর নামে আরেকটি হীরাও উত্তোলন করা হয়। এটিকে কোহিনূরের জমজ বলা হয়ে থাকে।
কোহিনূরের প্রাথমিক ওজন ছিল ৭৯৩ ক্যারেট। কিন্তু ভেনিসের হীরা কর্তনকারী হরটেনসিও জর্জিস অদক্ষতার কারণে কোহিনূর কেটে ছোট করে ফেলেন। এর বর্তমান ওজন ১০৫ ক্যারেট।
কোহিনুর বহুল আলোচিত হলেও এটি কখনো বিক্রি করা হয়নি। সাম্রাজ্যে বদলের সাথে সাথে হীরাটিরও হাত বদল হয়েছে। আবার কোহিনূর চুরি করে নেয়ারও বহুল আলোচিত ইতিহাস রয়েছে। ঐতিহাসিকদের তথ্য মতে, কোহিনূর প্রথম দিকে মালবের রাজপরিবারের অধিকারে ছিলো। তখনও কোহিনুর এত আলোচিত হয়নি।
মুঘল আমলে এটি মুঘল সাম্রাজ্যের ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে ওঠে। যার কারণে মুঘল শাসকবৃন্দ কোহিনূরের প্রতি বিশেষ যত্নবান ছিলেন। এ শাসকদের অধিকারে কোহিনুর ২১৩ বছর ছিল। পরে আফগানদের কাছে ৬৬ বছর ও ব্রিটেনের অধিকারে ১৩৪ বছর পার করে হীরকখণ্ডটি। এটি বর্তমানে ব্রিটিশ রাজপরিবারের সম্পত্তি হিসেবে রয়েছে।
কোহিনূর নামটি মুঘলদের দেয়া। ফারসি শব্দ কোহ–ই–নূর শব্দটি থেকে কোহিনুর শব্দটির উদ্ভব। কোহ–ই–নূর অর্থ আলোর পর্বত। পর্তুগিজ চিকিৎসক ও দার্শনিক গার্সিয়া দা ওরতো–এর রচনায় কোহিনূর সম্পর্কে বলা হয়েছে বলে মনে করেন গবেষকরা। তিনি ১৫৬১ সালে প্রকাশিত তাঁর কোলোকুইজ অন দ্য সিম্পলস অ্যান্ড ড্রাগস অব ইন্ডিয়া গ্রন্থে বলেছেন, ভারতবর্ষের বৃহত্তম হীরা বিজয়নগরে সংরক্ষিত আছে। ধারণা করা হয়, উনি হয়তো কোহিনূরের কথাই বলেছেন।
বাবরনামাতে কোহিনুর সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। এ গ্রন্থে বাবর লিখেছেন, গোয়ালিয়রের রাজা বিক্রমজিতের পরিবারকে গ্রেফতার করার পর তারা হুমায়ুনকে কিছু রত্ন দিয়েছিল। বাবরকে প্রশংসাকারীরা বলেন এই রত্নের মধ্যে থাকা একটি হীরার মূল্য দিয়ে পুরো দুনিয়ার মানুষকে আড়াই দিন খাওয়ানো যাবে। বাবর বর্ণিত এই একটি হীরাই হচ্ছে কোহিনূর।
মুঘল আমলে এটিকে বাবরের হীরা বলা হত। পানিপথের যুদ্ধের পর বাবরকে কোহিনুর হীরা উপহার দিয়েছিলেন তাঁর পুত্র হুমায়ূন। বাবর বা হুমায়ূন কেউ এ হীরাকে অলঙ্কার হিসেবে ব্যবহার করেননি। সম্রাট শাহাজাহান এসে প্রথমবারের মতো ময়ূর সিংহাসনের অলঙ্কার হিসেবে কোহিনুর ব্যবহার করেন। পরে পারস্যের নাদির শাহ কোহিনুর লুট করেন।
কোহিনূরের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল এটির ৩৩টি পাশ রয়েছে। এর রং শ্বেত শুভ্র। কোহিনুরকে সবচেয়ে নিখুঁতভাবে কাটা হীরা মনে করা হয় হয়। এর বর্তমান মূল্য ১০০ মিলিয়ন পাউন্ড বা ১২শ’ কোটি টাকা। এটির মালিকানা নিয়ে এখনও দ্বন্দ্ব রয়েছে। ভারতবাসী মনে করে, ব্রিটিশটা কোহিনূর চুরি করে বা পাচার করে নিয়ে গেছে।
২০১৬ সালের এক রায়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় মনে করে, ইংরেজ শাসকেরা ভারত থেকে কোহিনূর চুরি যেমন করেনি, তেমনি লুট করেও নিয়ে যায়নি। পাঞ্জাবের মহারাজা রণজিৎ সিং ১৮৪৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে নিজেই এই অমূল্য সম্পদ উপহার দিয়েছিলেন।