সেই ছোটবেলা থেকে আমরা পড়ে এসেছি- "পানির অপর নাম জীবন" আর পানি ছাড়া আমরা বাঁচতে পারব না- কথাটি সত্য! অনেকে আবার চালাকি করে বলে থাকেন- শুধু পানি নয়, বিশুদ্ধ পানির অপর নাম জীবন। যাইহোক অতিরিক্ত কোন কিছুই যেমন ভালো না, তেমন অতিরিক্ত বিশুদ্ধ পানি পান করার মাধ্যমেও আপনার শরীরে বিষাক্ততা তৈরি হতে পারে। কথাটি শুনতে আশ্চর্যজনক মনে হলেও বাস্তবে অতিরিক্ত পানি পান করার মাধ্যমে মানুষের শরীরে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, মানুষ কোমায় চলে যেতে পারে আর মৃত্যুও ঘটতে পারে! চলুন, প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি পান করলে আমাদের শরীরে কি প্রভাব পড়তে পারে তা নিয়ে আজকের আলোচনা শুরু করি।
মানবদেহের উদরগহ্বর এ অবস্থিত দুটো বৃক্ক/কিডনি আমাদের শরীরের পানির সাম্যতা রক্ষা করে। মানুষের বৃক্ক বা কিডনি প্রতিনিয়ত নেফ্রনের গ্লোমেরুলাস জালিকার মাধ্যমে রক্ত বিশোধোন করে দেয় এবং পাশাপাশি বৃক্কীয় নালিকার ক্ষরণ আর শোষণ এর মাধ্যমে শরীরের বিপাকীয় বর্জ্য সমৃদ্ধ মূত্র তৈরি করে। মূত্র তৈরির মাধ্যমে আমাদের দেহের বৃক্কগুলো সর্বোচ্চ প্রতি ঘন্টায় ৮০০ থেকে ১০০০ মিলি পানি শরীর থেকে বের করে দিতে পারে। আর অল্প কিছু পরিমাণ পানি ঘাম এবং শ্বাস নেওয়ার মাধ্যমে বের হতে পারে। তবে যদি কেউ একক সময়ে শরীরের স্বাভাবিক উপায়ে পানি বের করার সক্ষমতার থেকে বেশি পানি পান করে তাহলে তার শরীরে পানির দ্বারা বিষাক্ততা তৈরি হতে পারে যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় "ওয়াটার ইনটক্সিকেশন" (Water intoxication)।
আমাদের শরীরের প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত পানি পান করলে বৃক্ক/কিডনি গুলো সেই সবটুকু পানি নিয়মিত হারে শরীর থেকে বের করতে ব্যর্থ হয়ে পড়ে, আর অতিরিক্ত পানি আমাদের শরীরের কোষগুলোতে জমা হতে শুরু করে। স্বাভাবিকভাবে আমাদের দেহের কোষগুলোর বাইরের তরল মাধ্যমে কোষের ভেতরের তুলনায় সোডিয়াম আয়নের পরিমাণ বেশি থাকে। পানির দ্বারা বিষক্রিয়ার শুরুতে যখন অতিরিক্ত পরিমাণে পানি কোষগুলোর বাইরের তরল মাধ্যমে জমা হতে থাকে, তখন দ্রবণের আয়তন বেড়ে যাওয়ায় সোডিয়াম আয়নের ঘনমাত্রা কমে যেতে থাকে। আর একপর্যায়ে কোষের ভেতরে আর বাইরে তরল মাধ্যমগুলোর সোডিয়াম আয়নের অভিস্রবণিক সাম্যাবস্থা রক্ষা করার প্রয়াসে অতিরিক্ত পানি কোষগুলোর ভেতরে অভিস্রবণ প্রক্রিয়ায় ঢুকতে শুরু করে। কোষগুলোর আয়তন বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর তখনই বিপত্তির শুরু হয়! শরীরের কোষগুলোর আয়তন পানির দ্বারা বিষক্রিয়ায় বেড়ে যেতে থাকলে তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা ব্যাহত হয়। যেমন: মাংসপেশির শক্তি হ্রাস পেতে থাকে আর পরিপাকতন্ত্রে গোলযোগ সৃষ্টি হয়।
অতিরিক্ত পানিপানে সৃষ্ট বিষাক্ততায় সবথেকে বেশি ভয়াবহতা দেখা যায় মস্তিষ্কের নিউরন আর সাহায্যকারী কোষগুলোতে। শরীরের অন্যান্য কোষগুলো তুলনামূলক কোমল যোজক কলার (Connective tissue) এর আচ্ছাদনে আবৃত থাকে। তবে মস্তিষ্কের কোষগুলো যথেষ্ট শক্ত অস্থিময় করোটির মাধ্যমে আচ্ছাদিত থাকে। তাই অতিরিক্ত পানির ঢুকে পড়ার জন্য মস্তিষ্কের কোষগুলোর আয়তন শক্ত এক কোটরের মধ্যে বৃদ্ধি পেতে থাকে আর সাথে সাথে মস্তিষ্কের কোষগুলোর অভ্যন্তরীণ চাপ প্রচণ্ড পরিমাণ বেড়ে যেতে থাকে। এজন্য মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটে। প্রচণ্ড পরিমাণ মাথাব্যথা শুরু হয় আর শারীরিক সমন্বয়হীনতা দেখা দেয়। পানির দ্বারা বিষক্রিয়ার পরিমাণ বাড়তে থাকলে একপর্যায়ে খিচুনি ও মানসিক ভারসাম্যহীনতা দেখা যায় এবং আক্রান্ত ব্যক্তি কোমায়ও চলে যেতে পারেন। শরীরের বিভিন্ন তন্ত্রের স্থায়ী ক্ষতি সাধন হতে পারে, মস্তিষ্কের নিউরন মারা যেতে পারে আর ফলশ্রুতিতে মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একজন ৬০ বছর বয়সী মহিলা একদিন ৩০-৪০ গ্লাস( প্রতি গ্লাস=২৫০ মিলি করে) পানি পান করে সেই দিনের সন্ধ্যায় মস্তিষ্কের ভয়াবহ নিষ্ক্রিয়তা জনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। বিভিন্ন ক্রীড়া আয়োজন, বিশেষ করে ম্যারাথন জাতীয় লম্বা সময় আর দূরত্বের দৌড় প্রতিযোগিতায় দৌড়বিদদের মধ্যে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত পানি পান করার প্রবণতা দেখা যায়, যার কারণে তাদের প্রতি ছয়জনের মাঝে একজনের অতিরিক্ত পানি পানের কারণে সৃষ্ট বিষাক্ততার লক্ষণ দেখা যায়।
তাহলে, অতিরিক্ত পানি পান করার ব্যাপারটি কিভাবে প্রতিহত করতে পারেন?
একজন সুস্থ, প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন প্রায় ২-৩ লিটার পানি পান করলেই শরীরের পানি সাম্যতা ঠিক থাকবে। তবে সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে, যখন তৃষ্ণা লাগে তখন পরিমিত পানি বা পানীয় পান করবেন আর খাবারের পরে পানি পান করবেন। সকালে ঘুম থেকে উঠার পর পানি পান করলে উপকার পাওয়া যায়। আর অকারণে বেশি পানি/পানীয় গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
লেখকঃ ফাহাদ মান্নান-Team Science Bee