অরোরা বা মেরুজ্যোতি!
মানুষ ভালোবাসে প্রকৃতি, ভালোবাসে প্রকৃতির সৌন্দর্য্যকে। যতো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য রয়েছে তারমধ্যে অরোরা যেনো এক বিশেষ স্হান দখল করে আছে। আমাদের ভৌগোলিক অবস্হান বিষুবরেখা থেকে ২৬৭০ কি.মি উত্তরে। কিন্তু উত্তর মেরু থেকে ৭,৩৪১ কি.মি দক্ষিনে। এই অপরুপ সৌন্দর্য্য থেকে আমরা বন্ঞ্চিত। সেটি হচ্ছে অরোরা।
অরোরা কি?
অরোরার বাংলা অর্থ "মেরুজ্যোতি"। উচ্চ অক্ষাংশ ও দক্ষিন অক্ষাংশে চার্জিত কনার প্রতিক্রিয়ার কারনে যে আলোকীয় প্রাকৃতিক ঘটনা দেখা যায়, তাকেই অরোরা বলে। উত্তর অক্ষাংশে এটি অরোরা বোরিয়ালিস বা নর্দার্ন লাইটস বা সুমেরুজ্যোতি নামে পরিচিত। আর দক্ষিণে এর নাম অরোরা অস্ট্রালিস বা সাউদার্ন লাইটস বা কুমেরুজ্যোতি।
অরোরা কেন ঘটে?
সুর্য পৃথিবী থেকে প্রায় ১৪কোটি ৯৬ লক্ষ কি.মি দুরে অবস্হিত। সুর্যের উপরিভাগের তাপমাত্রা ৫৭৭৮ কেলভিন। সুর্যের অভ্যন্তরে ঘটে চলেছে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া। হাইড্রোজেন পুড়ে উৎপন্ন হচ্ছে হিলিয়াম, সাথে সৃষ্টি হচ্ছে আলো ও প্রচন্ড উত্তাপ। অভ্যন্তরীন এ প্রক্রিয়ায় কখনও সুর্যের অভ্যন্তরভাগ থেকে আগুনের শিখার মতো অংশ মহাশুণ্যে সজোড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। একে বলা হয় সৌরঝড়। একে Coronal mass ejection ও বলা হয়, কারন এর মাধ্যমে সুর্য তার কিছু পরিমান ভর শুণ্যে নিক্ষেপ করে৷ কিন্তু তা নির্গত হয় প্রচন্ড শক্তিরুপে। এই শক্তি মুলত নির্গত করে বহুসংখ্যক চার্জিত কণা, যা চারদিকে ছড়িয়ে যেতে থাকে। সুর্য পৃথিবী থেকে যথেষ্ট দুরত্বে থাকলেও সৌর বায়ু বা ঝড়ের প্রভাব অনেক দুর পর্যন্ত বিস্তুৃত।এভাবে সৌরঝড়ের কারনে চার্জিত কণা ছড়িয়ে পড়ার সময় যখন তা পৃথিবীর ম্যাগনেটোস্ফিয়ারের কাছাকাছি আসে বা প্রবেশ করে তখন বায়ুমন্ডলের থার্মোস্ফিয়ারে থাকা অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন পরমাণুর সাথে ম্যাগনেটোস্ফিয়ার থেকে আসা সে চার্জিত কণিকাসমূহের (প্রধানত ইলেক্ট্রন, কিছু ক্ষেত্রে প্রোটন) সংঘর্ষের ফলেই অরোরা সৃষ্টি হয়। কারন, সংঘর্ষের কারণে পরমাণু বা অণুসমূহ কিছু শক্তি লাভ করে চার্জিত কণিকাসমূহের কাছ থেকে যা অভ্যন্তরীণ শক্তি হিসেবে সঞ্চিত হয় ও পরবর্তীতে তা আলোকশক্তি রুপে বিকিরিত হয়।
এ শক্তি কিভাবে কাজ করে?
আমরা জানি, পরমানুর কেন্দ্রে রয়েছে নিউক্লিয়াস যা মুলত প্রোটন ও নিউট্রন দ্বারা গঠিত এবং এর চারপাশে বিভিন্ন স্তরবিশিষ্ট কক্ষপথে রয়েছে ঘুর্নায়মান ইলেকট্রন৷ যখন ধেয়ে আসা সৌরঝড়ের চার্জিত কনার সাথে বায়ুর পরমানুর সংঘর্ষ হয় তখন বায়ুমন্ডলের থার্মোস্ফিয়ার স্তরের কনাসমুহের ইলেকট্রন শক্তি লাভ করে। শক্তি লাভ করে তা তার কক্ষপথ থেকে উপরের শক্তিস্তরে চলে যায়। তারপর যখন ইলেকট্রনসমুহ পুনরায় তাদের নিজ কক্ষপথে ফিরে আসে তখন তাদের শোষন বা লাভকৃত অভ্যন্তরীণ শক্তি আলোকশক্তি হিসেবে নির্গত হয়, যাকে বলা হয় ফোটন। আর সে আলোকেই আমরা দেখতে পাই, যাকে মেরুজ্যোতি বলে।
কি কি রঙের অরোরা সৃষ্টি হতে পারে?
বিভিন্ন রঙের অরোরা সৃষ্টি হতে পারে। মেরুজ্যোতির রঙ নির্ভর করে কোন গ্যাসীয় পরমাণু ইলেক্ট্রন দ্বারা উদ্দীপ্ত হচ্ছে, এবং এই প্রক্রিয়ায় কত শক্তি বিনিময় হচ্ছে তার উপর।
অরোরার সবচেয়ে পরিচিত রঙ যা অধিকাংশ সময় দেখা যায় তা হলো সবুজাভ-হলুদ, তার জন্য দায়ী অক্সিজেন পরমাণু। অক্সিজেন থেকে অনেকক্ষেত্রে লাল রঙ এর অরোরাও তৈরী হয়। নাইট্রোজেন সাধারণত একটি নীল রঙের আলো দেয়। এছাড়াও অক্সিজেন এবং নাইট্রজেন পরমাণু অতি-বেগুনী রশ্মি নির্গত করে, যা শুধুমাত্র স্যাটালাইটের বিশেষ ক্যামেরা দ্বারা শনাক্ত করা যায়, খালি চোখে দেখা যায় না।
সাধারনত অরোরা ৯০-১৩০ কি.মি উচ্চতায় সৃষ্টি হয়। হলুদাভ সবুজ রঙের অরোরার সৃষ্টি হয় ৭০ মাইল উচ্চতায়, আর লালরঙের অরোরা সৃষ্টি হয় ২০০-৩০০ কি.মি উচ্চতায়। অরোরা কতোটা উজ্জ্বল দেখাবে এটা নির্ভর করে কতোটা চার্জিত সৌরকনা বায়ুমন্ডলে আঘাত করছে যেমনটা আমরা দেখতে পাই, কারেন্ট বেশি মাত্রায় প্রবাহিত হলে বাতির উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায়, আর কম প্রবাহিত হলে উজ্জ্বলতা কমে।
কেনো অরোরাকে শুধু উচ্চ অক্ষাংশেই দেখা যায়?
যখন সৌরচার্জিত কনাগুলো পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ফিল্ডের দিকে আসে তখন বিষুবঅন্ঞ্চল বা নিম্ন অক্ষাংশের অন্ঞ্চলের নিকটবর্তী ম্যাগেটিক ফিল্ড সে কনাগুলোকে বিচ্যুত করে বাইরের দিকে নিক্ষেপ করে। কিন্তু চৌম্বকক্ষেত্রের প্রবলতা মেরু অন্ঞ্চলে সর্বোচ্চ হওয়ায় সে কনাগুলো মেরু অন্ঞ্চলের বায়ুস্তরে আঘাতে করে ও এজন্যে শুধু মেরু অন্ঞ্চলের দিকেই অরোরা সৃষ্টি হয়।
অরোরা কি আমাদের জন্যে ক্ষতিকর?
- না। আমাদের শরীরের জন্যে তা মোটেও ক্ষতিকর না। কারন, সেগুলো থাকে যথেষ্ট উচ্চতায় ও কনাগুলোর তড়িৎ প্রকৃতি যথেষ্ট বেশি না। কিন্তু এরা আহিত কনা হওয়ায় বিভিন্ন বৈদ্যুতিক প্রযুক্তির কিছুটা ক্ষতিসাধন করতে পারে।
অরোরা কোথায় কেথায় দেখা যায়?
অরোরা দেখা যায় মুলত উচ্চ অক্ষাংশের স্হানসমুহে যা মেরু অন্ঞ্চলের দিকের জায়গাসমুহ। অরোরার কথা আসলেই সর্বপ্রথম যে দেশটির কথা আমাদের মাথায় আসে সেটি হলো নরওয়ে। এছাড়া সুইডেন,গ্রীনল্যান্ড, উত্তর রাশিয়া,কানাডা, ফিনল্যান্ড,নিউজিল্যান্ড, তাসমানিয়া, অ্যান্টার্কটিকা।
[লেখক : শাকিল সাজ্জাদ স্যার]