প্রথমেই উল্লেখ করে রাখা দরকার, মানুষের ভবিষ্যৎ জীবনযাপন কেমন হবে তা অনেকগুলো বিষয়ের উপর নির্ভর করে। এদের কোনো একটাতে সামান্য পরিবর্তন হলে সামগ্রিকভাবে বড় ধরনের এদিক-সেদিক হয়ে যায়। অনেকটা আবহাওয়ার পূর্বাভাসের মতো। আবহাওয়া কেমন হবে তা পরিবেশের অনেকগুলো উপাদানের উপর নির্ভর করে। এসব উপাদান বিশ্লেষণ করে আবহাওয়া সম্পর্কে আনুমানিক একটা ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়। কিন্তু উপাদানের কোনো একটায় সামান্য এদিক-সেদিক হলে পুরো প্রক্রিয়াটাই উলট-পালট হয়ে যায়। সেজন্যই আবহাওয়ার কোনো ভবিষ্যদ্বাণীই নিখুঁতভাবে দেয়া যায় না। অনেকটা বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব বা কেওস থিওরির মতো। কেওস থিওরিতে ‘বাটারফ্লাই ইফেক্ট’ নামে মজার একটি বিষয় আছে। পৃথিবীর এক প্রান্তে যদি একটি প্রজাপতি ডানা ঝাপটায় এবং সেই ঝাপটা উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত ফিডব্যাক পায় তাহলে সেটি পৃথিবীর অপর প্রান্তে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের জন্ম দিতে পারে। উদ্দেশ্যহীন বিক্ষিপ্ত ও ক্ষুদ্র কিছু ঘটনা উপযুক্ত সময়ে পজিটিভ ফিডব্যাক পেলে তা থেকে জন্ম নিতে পারে বিশাল কিছু।
আবহাওয়া আজ শান্ত আছে, কাল আপাতদৃষ্টিতে কোনো কারণ ছাড়াই অশান্ত হয়ে যেতে পারে। ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আসবে বলে সবাই ভয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে গেছে, কিন্তু পরে দেখা গেল হুট করেই ঘূর্ণিঝড় উধাও কিংবা ইউ টার্ন নিয়ে ফিরে গেছে উল্টো দিকে। মানুষের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনুমান করাও অনেকটা কেওস থিওরি কিংবা আবহাওয়ার পূর্বাভাসের মতো। তারপরেও অনুমান করতে তো আর কোনো সমস্যা নেই। বর্তমান প্রযুক্তির প্রেক্ষাপটে সেরকমই কিছু অনুমান করা হয়েছে এক হাজার বছর পরের মানুষ সম্পর্কে।
মানুষের মাঝে সদা পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে শরীরেও পরিবর্তন সংঘটিত হয়। কোনো অঞ্চলে যদি সূর্যের উত্তাপের পরিমাণ বেশি হয়, তাহলে রোদের সাথে খাপ খাইয়ে নেবার জন্য ত্বকে মেলানিনের পরিমাণ বেড়ে যায়। ত্বকে মেলানিনের উপস্থিতি বেশি থাকলে ত্বক কালো হয়ে যায়। সেজন্যই দেখা যায়, যে অঞ্চলে গরম বেশি সে অঞ্চলের মানুষ অপেক্ষাকৃত কালো হয়। কোনো অঞ্চলে শীতলতার পরিমাণ বেশি হলে ত্বকের নীচে শীত প্রতিরোধক চর্বির স্তর বেড়ে যায়।
ইতিহাসের পথে পথে পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেবার জন্য অনেক ভাঙা-গড়া ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আসতে হয়েছে মানুষকে। এবং এই প্রক্রিয়া থেমে যায়নি, এখনো চলমান আছে। প্রক্রিয়া যেহেতু চলমান, তাই একটি প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে- ভবিষ্যতে মানুষের মাঝে কী কী পরিবর্তন সাধিত হবে? দেখতে-শুনতে, আকার-আকৃতিতে কেমন হবে ভবিষ্যতের মানুষ? কেমন হবে এক হাজার বছর পরের মানুষের রূপ?
মানুষ বর্তমানের তুলনায় অনেকখানি লম্বা হবে। গাণিতিক বাস্তবতা এমনই বলে। গত ১৩০ বছরে মানুষের উচ্চতা বেড়েছেও বেশ খানিকটা। ১৮৮০ সালের দিকে আমেরিকার পুরুষদের গড় উচ্চতা ছিল ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি। এখন তাদের গড় উচ্চতা ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি। এক হাজার বছর সময়ের ব্যবধানে উচ্চতার এই পরিবর্তন উল্লেখযোগ্য হিসেবেই দেখা দেবে বলে ধারণা করা হয়।
কানের মাধ্যমে শোনা, চোখের মাধ্যমে দেখা, নাকের মাধ্যমে ঘ্রাণ অনুধাবন করা সহ দেহের অন্যান্য কার্যপ্রণালীতে পরিবর্তন আসবে। যেমন বর্তমানে ‘হিয়ারিং এইড’ নামে একটি যন্ত্র আছে যেটি কানে সমস্যা সম্পন্ন মানুষদেরকে শুনতে সাহায্য করে। এই যন্ত্র সাধারণ শব্দ রেকর্ড করে সেটিকে ক্ষতিগ্রস্ত কানের উপযোগী শব্দে রূপান্তরিত করতে পারে। এমনকি এর সাথে সংযুক্ত মোবাইলে তা লিখিতরূপেও প্রদান করতে পারে।
চোখের কথা বিবেচনা করতে পারি। আগে কোনো দাতা ব্যক্তি চোখ দান করলে তা দিয়ে অন্য কারো চোখের চিকিৎসা করা হতো কিংবা অন্ধের চোখে লাগানো হতো। ক’দিন পরে এই সীমাবদ্ধতা আর থাকবে না। ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ‘বায়োনিক চোখ’ নামে একধরনের যন্ত্র তৈরি করছেন যার মাধ্যমে অন্ধরাও দৃষ্টি ফিরে পাবে। যন্ত্রের মাধ্যমে একজন জলজ্যান্ত মানুষ দেখতে পাচ্ছে এই ব্যাপারটা কম অভাবনীয় নয়।
এতটুকু যেহেতু সম্ভব, হয়েছে এটির দৃষ্টির পরিব্যাপ্তি বাড়ানোও অস্বাভাবিক বা অসম্ভব কিছু নয়। মানুষের চোখ তড়িৎচুম্বক বর্ণালীর খুবই ক্ষুদ্র একটি অংশ দেখতে পায়। বর্ণালীর ‘দৃশ্যমান আলো’র বাইরে অনেক বড় একটা অংশ অধরাই থেকে যায় সবসময়। এমনও হতে পারে বায়োনিক চোখের উন্নতির মাধ্যমে দৃশ্যমান আলোর বাইরের আলোও মানুষ দেখতে পারবে। যেমন ইনফ্রারেড কিংবা এক্স-রে। এই দুই ধরনের আলোতে মানুষের চোখ সংবেদনশীল হলে জগতের অনেক অজানা রাজ্য, অচেনা ভাণ্ডার মানুষের সামনে চলে আসবে। যে জিনিসগুলো মানুষের চোখে আজকে অদৃশ্য সেগুলো তখন হয়ে যাবে দিনের আলোর মতো সত্য। যেমন ইনফ্রারেড রশ্মি বা অবলোহিত আলোর প্রতি চোখ সংবেদনশীল হলে মানুষ অন্ধকারেও দেখতে পাবে।
শুধু দেহের বাইরের দিক থেকেই নয়, ভেতরের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর পর্যায়েও পরিবর্তন আসবে। জীবনকে টিকিয়ে রাখার জন্য আণুবীক্ষণিক পর্যায়ে আমাদের জিনও পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেবে। যেমন- অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক আফ্রিকায় এমন কিছু শিশুর সন্ধান পেয়েছেন যারা HIV-তে আক্রান্ত হয়েও দিব্যি সুস্থ জীবন পার করছে। তাদের জিনে এমন কিছু প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে যেটি HIV ভাইরাসকে প্রতিহত করে দেয় এবং দেহ থেকে এইডসকে দূরে রাখে।
বিজ্ঞানের কল্যাণে মানুষ ল্যাবরেটরিতেও জিনের কলকব্জা নাড়াচাড়া করতে পারে। জিনের কোন অংশে কোন ধরনের সম্পাদনা করলে কোন রোগ প্রতিহত হবে এটা জানতে পারলে মানুষ নিজেরাই দেহের মাঝে অনেক নিশ্চিত প্রাণঘাতী রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে। এই প্রক্রিয়া ব্যবহার মানুষের বৃদ্ধ হবার প্রক্রিয়াকেও থামিয়ে দেয়া সম্ভব। তখন সকল মানুষ হবে চির তরুণ। সম্ভাবনাময় এই প্রযুক্তির নাম হচ্ছে CRISPR।
এটা ছাড়া এমনিতেও মানুষের অসুস্থ হবার হার কিংবা অসুস্থ হয়ে মারা যাবার হার কমে যাবে। তখন মানবদেহের চিকিৎসায় চলে আসবে ন্যানো রোবট বা সংক্ষেপে ন্যানোবট। শরীরের ভেতরে যে অংশটি ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা যে অংশটি জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত সে অংশে ক্ষতি পূরণ করতে কিংবা জীবাণুদের সাথে যুদ্ধ করতে পাঠিয়ে দেয়া হবে এদেরকে।
মানুষ যদি ক্রমান্বয়ে পরিবেশের দূষণ ঘটাতেই থাকে তাহলে পৃথিবীর ওজোন স্তরের বাধ ভেঙে পড়বে। এই স্তর সূর্যের ক্ষতিকর বিকিরণকে শোষণ করে নেয়। এটি না থাকলে সূর্যের ক্ষতিকর বিকিরণের প্রভাব পড়বে মানুষের উপরে। অন্যান্য পরিবর্তনের পাশাপাশি মানুষের ত্বক কিছুটা কালচে হয়ে যাবে।
পৃথিবীর গণ্ডি পেরিয়ে অন্য কোনো গ্রহে মানব বসতি স্থাপন করা এখন কল্পনার গণ্ডি ছাড়িয়ে বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। এক হাজার বছরের মাঝে গ্রহে গ্রহে ভ্রমণ হয়ে যাবে আজকের দিনে পিকনিক স্পটে ভ্রমণের মতো। বেশি দূরে না গিয়ে মঙ্গল গ্রহের কথাই বিবেচনা করি। মঙ্গল গ্রহে মানুষ বসবাস করার জোর সম্ভাবনা আছে। সেখানে বসবাসকারী মানুষের শারীরিক পরিবর্তন, পৃথিবীতে বসবাসকারী মানুষের শারীরিক পরিবর্তনের চেয়ে ভিন্নভাবে হবে।
মঙ্গলে সূর্যের আলোর পরিমাণ কম। পৃথিবীর আলোর প্রায় তিনভাগের একভাগ আলো পড়ে সেখানে। যার মানে হচ্ছে এই গ্রহে দেখতে সমস্যা হবে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য চোখের মণি বড় হবে। মণি বড় হলে চোখে বেশি আলো প্রবেশ করবে। বেশি আলো প্রবেশ করলে কোনোকিছুকে স্পষ্টতর দেখা যাবে। মঙ্গলের অভিকর্ষীয় টানও পৃথিবীর তুলনায় কম। সেখানে কেউ গেলে পৃথিবীর অভিকর্ষীয় টানের মাত্র ৩৮% অনুভব করবে। তাই সেখানে যারা জন্মগ্রহণ করবে তাদের উচ্চতা হবে অনেক বেশি। নীচের দিকে টান কম থাকাতে শিশু লম্বা হয়ে উঠবে তরতরিয়ে।
মেরুদণ্ডের কশেরুকাগুলোর মধ্যবর্তী স্থানে একধরনের অর্ধ-তরল পদার্থ (fluid) থাকে। এরা কশেরুকাগুলোকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন রাখে। পৃথিবীর অভিকর্ষীয় আকর্ষণে এরা ভালোই চাপে থাকে। কেউ যদি মহাকাশে বা মঙ্গল গ্রহে যায় তাহলে এদের মাঝে প্রযুক্ত চাপ কম পড়ে এবং এরা স্ফীত হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়ায় একজন স্বাভাবিক মানুষের উচ্চতাও কয়েক ইঞ্চি পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। মঙ্গলে যারা জন্মগ্রহণ করবে তাদের উচ্চতা যে বেশি করে বাড়বে তা বলাই বাহুল্য।
এক হাজার বছরের ভেতরে এসবের চেয়েও অনেক বড় এবং অনেক আকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসতে পারে। অমরত্ব, এটি অর্জনের প্রথম ধাপ হতে পারে মানুষের চেতনা বা কনশাসনেসকে বিশেষ উপায়ে যান্ত্রিকভাবে সংগ্রহ করা। চেতনাকে যান্ত্রিক ভাষায় রূপ দিতে পারলে সেটিকে পরবর্তীতে কোনো যন্ত্রে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হবে। ইতালি ও চীনের বিজ্ঞানীরা এর সাথে সম্পর্কিত কাজে অগ্রগতিও অর্জন করেছেন। এক প্রাণীর মাথা আরেকটি প্রাণীর দেহে স্থাপন করে দেখছেন সেসব প্রাণীর মস্তিষ্ক বা চেতনা ঠিকঠাক মতো কাজ করছে কিনা। তারা আশা করছেন, মানুষের মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন হবে তাদের কাজের পরবর্তী লক্ষ্য।
যেরকম বলা হয়েছে মানুষের পরিবর্তন হয়তো ভবিষ্যতে সেরকমই হবে কিংবা এর কাছাকাছি রকম হবে কিংবা হয়তো একদমই ভিন্নরকম হবে! তবে যেরকমই হোক, মানুষের মাঝে পরিবর্তন সংঘটিত হবেই। বিবর্তনের অমোঘ নীতি অনুসারে পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেবার জন্য যে যত দ্রুত পরিবর্তিত হতে পারবে সে তত সফলভাবে টিকে থাকতে পারবে। যারা খাপ খাওয়ানোর জন্য নিজেদের মাঝে পরিবর্তন আনতে পারবে না, তারা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। পরিবেশে টিকে থাকার জন্য দেহে পরিবর্তন সাধিত হওয়া খারাপ লক্ষণ নয়। এরা নিজেদের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখার সুখবরই বহন করে।
[লেখক : Sirajam Munir Shraban]