#ইমিগ্রেশন_ডিলে_ডিজিজ// #এডার্মাটোগ্লিফিয়া
◼️পৃথিবীর প্রতিটা মানুষের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গুলের ছাপ। এমন কি কোনো মানুষ আছে যাদের আঙ্গুলে কোনো ছাপই নেই...?
সাল ২০০৭। সুইজারল্যান্ড অধিবাসী এক মহিলা কোনো এক কাজে যুক্তরাষ্ট্রে যাবেন ঠিক করেছেন। কিন্তু কাস্টমস অফিসাররা বিমানবন্দরে আটকে দিলেন তাকে। পাসপোর্ট এর ছবির সাথে মহিলার চেহারার মিল থাকলেও কাস্টমস অফিসাররা তার কোনো ফ্রিঙ্গারপ্রিন্ট রেকর্ড করতে পারলেন না। মহিলা শরণাপন্ন হলেন বিখ্যাত সুইস ডার্মাটোলোজিস্ট পিটার ইটিন এর । ব্যাপক পরিক্ষা নিরিক্ষার পর ডা. ইটিন দেখলেন মহিলার আঙ্গুলে আদো কোনো ছাপই নেই! এখানেই শেষ না। পরবর্তীতে দেখা গেলো ঐ মহিলা ও তার পরিবারের আট সদস্যের মধ্যেও রয়েছে বিরল এই রোগ। অতঃপর মহিলার বিদেষ যাত্রা পণ্ড হলো। এইযে মহিলার বিদেশ যেতে বিলম্ব হলো এজন্য ডা. ইটিন এ রোগকে "ইমিগ্রেশন ডিলে ডিজিজ(Immigration Delay Diaease) নামে অভিহিত করেন। এই রোগের একটি পোশাকি নাম রয়েছে। তা হলো এডার্মাটোগ্লিফিয়া (Adermatoglyphia)। বর্তমানে বিশ্বে হাতে গোনা কয়েকটি পরিবারে বিরল এ রোগের সন্ধান পাওয়া গেছে।
ডার্মাটোগ্লিফিয়া বা সূক্ষ ছাপ বা রেখা রয়েছে মানুষের হাতের ও পায়ের আঙ্গুলে, হাতের তালু, পায়ের পাতা প্রভৃতি স্থানে। একটি শিশুর ভ্রুনাবস্থায় নিষেকের ১০-১৭ সপ্তাহ পরে এসব রেখা দেখা যায়। আর এসব রেখার গঠনে বিভিন্ন জেনেটিক ও পরিবেশগত উপাদান দারূন ভূমিকা পালন করেন। ভ্রুণাবস্থায় বিভিন্ন জিনের সহায়তায় তৈরি সূক্ষ রেখার স্বতন্ত্র এসব প্যাটার্ন একজন ব্যাক্তির সারাজীবনই বিদ্যমান থাকে। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে আঙ্গুলের ছাপ ছাড়াও যে ব্যাক্তি রয়েছে একথাও নির্মোঘ সত্য।
#কেন_হয়_এডার্মাটোগ্লিফিয়া...?
এডার্মাটোগ্লিফিয়া মূলত SMARCAD1 নামক জিনে মিউটেশনের কারনে হয়ে থাকে। কিভাবে মিউটেশনের মাধ্যমে এই রোগটি হচ্ছে সেটি বুজার আগে DNA, জিন, মিউটেশন এসব বিষয়ে সংক্ষেপে একটু পরিষ্কার ধারনা নেওয়া যাক। ডিএনএ বা ডিওক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড হচ্ছে জীবের বংশগত বৈশিষ্টের ধারক ও বাহক। অর্থাৎ জীবের সকল বৈশিষ্ট্য নিয়িন্ত্রন ও বংশ পরম্পরায় বহন করার অন্যতম একটি মাধ্যম এটি। ডিওক্সিরাইবোস সুগার, ফসফরিক এসিড এবং এডিনিন(A), গুয়ানিন(G), সাইটোসিন(A) ও থায়ামিন(T) নামক চার ধরনের বেস(ক্ষারক) নিয়ে গঠিত। ডিএনএতে এ চার ধরনের বেস সুনির্দিষ্ট সিকোয়েন্সে সজ্জিত থাকে।
অন্যদিকে জিন হলো ক্রোমোজমের একটা নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থিত ডিএনএ অনুর সুনির্দিষ্ট সিকোয়েন্স। এই সিকোয়েন্স একটি কর্মক্ষম পলিপেপটাইড চেইন তৈরির বার্তা বহন করতে পারে। পরবর্তীতে যা প্রোটিন হিসেবে আত্বপ্রকাশ করে। আর এ প্রোটিন দেহে বিভিন্ন রকম বৈশিষ্টের বহিঃপ্রকাশে সহায়তা করে। কেননা আমরা জানি জীবদেহ নানা জৈব ক্রিয়া বিক্রিয়ার সমষ্টি মাত্র। এসব বিক্রিয়ার প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে এনজাইম। আর সকল এনজাইমই হচ্ছে প্রোটিন। আবার জীবদেহের বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রনে হরমোনের ভূমিকা অনবদ্য। অধিকাংশ হরমোনই হচ্ছে প্রোটিন। প্রোটিনের এসব বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রন করার সামর্থের কারনে একে জীবনের ভাষা বলা হয়।
আর ডিএনএ এর সুনির্দিষ্ট বেস সিকোয়েন্সের স্থায়ী কোনো পরিবর্তন ঘটাকে মিউটেশন বলে। বেস সিকোয়েন্সের এই পরিবর্তন বিভিন্নভাবে হতে পারে। ডিএনএ রেপ্লিকেশনের( ডিএনএ থেকে ডিএনএ তৈরির প্রক্রিয়া) সময় কোনো ভুলের কারনে, এক্স-রে বা অতিবেগুনি রশ্মির সংস্পর্শে আসলে বা বাহ্যিক পরিবেশের বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের কারনে ডিএনএ এর সিকোয়েন্সে স্থায়ী পরিবর্তন তথা মিউটেশন হতে পারে। এখন কথা হচ্ছে এ মিউটেশনের জন্য আসলে কি ক্ষতি হতে পারে..? একটু আগেই বলেছি যে দেহের বিভিন্ন বৈশিষ্ট প্রকাশে বা সুনির্দিষ্ট কোনো কাজে প্রোটিনের ভূমিকা অনবদ্য। আর মিউটেশনের ফলে এই প্রোটিন উৎপাদনে একটা বড়সড় ব্যাঘাত ঘটে। কখনোবা কোনো নির্দিষ্ট প্রোটিন নাও তৈরি হতে পারে মিউটেশনের কারনে। আর প্রোটিন উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটা মানেই দেহের ভ্রুনাবস্থায় বা পরবর্তীতে দেহের কোনো বৈশিষ্ট্য প্রকাশে ব্যাঘাত ঘটা।
এখন SMARCAD1 জিনের মিউটেশনে আসা যাক। SMARCAD1 জিন মূলত দুইটি সংস্করণের SMARCAD1 প্রোটিন তৈরির বার্তা বহন করে। একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য বিশিষ্ট সংস্করণ, আরেকটি স্বল্পদৈর্ঘ্য বিশিষ্ট্য সংস্করন। এই পূর্ণদৈর্ঘ্য বিশিষ্ট সংস্করনের SMARCAD1 প্রোটিনটি দেহের বিভিন্ন কোষের জেনেটিক তথ্যের স্থায়িত্ব রক্ষা করে। অন্যদিকে স্বল্পদৈর্ঘ্য বিশিষ্ট SMARCAD1 প্রোটিনটি শুধুমাত্র দেহের ত্বকে সক্রিয় থাকে এবং জন্মের পূর্বে হাতের আঙ্গুলের ছাপ বা ডার্মাটোগ্লিফ তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। প্রকৃতপক্ষে এ ক্ষুদ্রদৈর্ঘের SMARCAD1 প্রোটিনের কাজে ব্যাঘাত ঘটার কারনেই এডার্মাটোগ্লিফিয়া নামক বিরল রোগ হয়। মিউটেশনের কারনে এই প্রোটিনের উৎপাদন ব্যাহত হয়। ফলে ত্বকে এর পরিমান কমে যায়। এটি এখনো অস্পষ্ট যে কিভাবে এ জেনেটিক পরিবর্তন এডার্মাটোগ্লিফিয়ায় ভূমিকা রাখে। তবে গবেষকরা মনে করেন স্বল্পদৈর্ঘ্য এ প্রোটনের অভাবে ভ্রুণাবস্থায় দেহের স্বাভাবিক ত্বক ও আঙ্গুলের ছাপ তৈরির জন্য যে সিগ্ন্যালিং পাথ-ওয়ের প্রয়োজন হয় তাতে মারাত্বকভাবে ব্যাঘাত ঘটে। ফলে হাতের আঙুলে কোনো প্রকার ডার্মাটোগ্লিফ বা ছাপই তৈরি হয় না।
বিরল এ রোগটি অটোসোমাল ডমিনেন্ট প্যাটার্নে বংশানুক্রমে বাহিত হতে পারে। অর্থাৎ পিতামাতার যেকোনো একজনের মধ্যে এ মিউট্যান্ট জিনটি থাকলেই রোগটি পরবর্তী বংশধরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তবে আশার কথা হলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ রোগের জন্য হাতের আঙুলের ছাপহীনতা ছাড়া অন্যান্য কোনো মারাত্মক উপসর্গের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। তবে ত্বকে ঘামগ্রন্থির পরিমান কমে যাওয়া, ত্বকে ফোসকা পড়ার মতো কিছু উপসর্গ লক্ষ্য করা যায়। যেহেতু এটি একটি বিরল রোগ এখনো এ রোগ নিয়ে বিস্তর গবেষনা চলমান রয়েছে।
#বাংলাদেশে_এডার্মাটোগ্লিফিয়া
আশ্বর্যজনক হলেও সত্য যে বর্তমানে বাংলাদেশেও এই রোগটির উপসর্গের রোগির সন্ধান পাওয়া গেছে। মনে করা হচ্ছে যে এশিয়ার মধ্যে আমাদের দেশই প্রথম এমনটা দেখা গেছে। রাজশাহীর পুঠিয়ার অমল সরকারের পরিবারের বেশ কয়েকজনের আঙুলের কোনো ছাপই নেই! অমল সরকারসহ তার বাবা ও তার দুই ছেলে বিরল এ রোগে ভুগছেন। এজন্য অবশ্য কম ঝামেলা পোহাতে হয় নি তাদের। এনআইডি কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে গিয়ে বেশ বিড়ম্বনার শিকার হতে হয় অমল সরকারকে। শেষে আঙুলের ছাপ নিতে ব্যার্থ হয়ে নির্বাচন অফিস থেকে তার এনআইডি কার্ডে লিখে দেওয়া হয় 'আঙুলের কোনো ছাপ নেই'। পরবর্তীতে অবশ্য তাদের অন্যান্য বায়োমেট্রিক তথ্যসমূহের( রেটিনা, আইরিশ স্ক্যানিং) রেকর্ড করা হয়।
মজার ব্যাপার হলো পরিবারের সকলে তারা অমল সরকারের স্ত্রীর এন আইডি দিয়ে রেজিস্ট্রেশনকৃত সিম কার্ড ব্যাবহার করেন। কেননা এ রোগটি তার নেই। এ বিষয়ে বিবিসি থেকে ডা.ইটিনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান তাদের এ উপসর্গগুলো সেকেন্ডারি এডার্মাটোগ্লিফিয়ার জন্য হতে পারে। তবে এ বিষয়ে আরও বিস্তর গবেষণার প্রোয়জন বলেও জানান তিনি। শুধুমাত্র থেরাপির সাহায্যেই এ রোগের নিরাময় হওয়া সম্ভব বলে মনে করেন ডা.ইটিন।
@Abdullah al fahad | Science Bee - বিজ্ঞান গ্রুপ