পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব সম্পর্কিত সাতটি তত্ত্ব
পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ৩০০ কোটি বছর আগে। প্রথমে ছিল অতিক্ষুদ্র অকোষীয় প্রাণি, পরে ধীরে ধীরে বৃহৎ বৈচিত্রের প্রাণিদের উৎপত্তি ঘটে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে প্রথম প্রাণের উদ্ভব কীভাবে ঘটেছিল? পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বে পৃথিবীটাই হচ্ছে এখন পর্যন্ত জানা একমাত্র জায়গা যেখানে প্রাণের উদ্ভব ঘটেছে। এখানে আমরা কিছু সমর্থনযোগ্য সম্ভাবনার দিকে দৃষ্টিপাত করবো—কীভাবে প্রাচীন পৃথিবীর বৈরী প্রকৃতিতে প্রথম প্রাণের উদ্ভব ঘটেছিল।
১. বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ
প্রথম যে সম্ভাবনার কথা বলা হয় সেটি হচ্ছে বজ্রপাত। প্রাচীন পৃথিবীর পরিবেশ ছিল খুব উত্তপ্ত, তাপমাত্রাও ছিল অনেক বেশী। পরিবেশ ছিল অত্যন্ত বৈরী প্রকৃতির, সবসময় ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাত লেগেই থাকতো। সেসময়ের পরিবেশে প্রচুর পরিমাণে মিথেন, অ্যামোনিয়া এবং হাইড্রোজেন গ্যাস ছিল, প্রচন্ড বজ্রপাতের সময় পানির সাথে এই রাসায়নিক উপাদানগুলো যুক্ত হয়ে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একক অ্যামিনো এসিড এবং সুগার তৈরী করলো। এখানে বলে রাখা ভালো প্রাণির কোষ গঠিত হয় প্রোটিন দিয়ে এবং প্রোটিন আসলে অসংখ্য অ্যামিনো এসিডের সমন্বয়েই তৈরী হয়। আর সুগার হচ্ছে প্রাণির DNA ও RNA তৈরীর প্রধান উপাদান, যা রেপ্লিকেশনে ব্যবহৃত হয়। অর্থ্যাৎ বংশবৃদ্ধির মূল উপাদান-ও তৈরী হয়ে গেল।
এই সম্ভাবনার কথা বহুদিন মানুষের কাছে অজানা ছিল। কিন্তু ১৯৫৩ সালে মিলার উরে পরীক্ষার মাধ্যমে দেখানো হয় যে প্রাচীন পৃথিবীর মূল উপাদানের সাথে বৈদ্যুতিক সংযোগের ফলে জীবনে মূল উপাদান তৈরী সম্ভব, এবং পরবর্তীতে মূল উপাদান থেকে অপেক্ষাকৃত জটিল জৈবিক অণু তৈরী-ও সম্ভব। ফলে লক্ষ বছরের ব্যবধানে প্রাণের উদ্ভব খুব বিস্ময়কর কিছু না।
প্রাচীন পৃথিবীতে বৈদ্যুতিক বজ্রপাত
অবশ্য প্রাচীন পৃথিবীতে প্রাণ তৈরীর উপযোগী হাইড্রোজেন ছিল অনেক কম তাই ধারণা করা হয় ভস্মীভূত মেঘই মূলত হাইড্রোজেন গ্যাসকে ধরে রাখতো। অর্থ্যাৎ এই তত্ত্ব আমাদেরকে বলে—প্রাচীন পৃথিবীর জলাশয়েই মূলত প্রাণের প্রথম কণা তৈরী হয়েছিল।
২. গোষ্ঠীভুক্ত কাদাময় পরিবেশ
কাদার মাঝে আটকে থাকা জৈবিক অণু
দ্বিতীয় তত্ত্ব আমাদের বলে প্রাণের প্রথম উপাদান জলাশয়ে নয় বরং জল ও মাটির মিশ্রণে যে কাদা তৈরী হয়, সেরকম কোন একটা জায়গায়। স্কটল্যান্ডের গ্ল্যাসগো ইউনিভার্সিটির জৈব রসায়নের অধ্যাপক আলেক্সান্ডার গ্রাহাম ক্রেইন্স স্মিথ প্রাণের উদ্ভব সম্পর্কিত এই মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করেন।
তিনি বলেন যে কাদাময় মাটির গঠন প্রাণের গাঠনিক উপাদান গুলোকে শুধুমাত্র একত্র করেছে তাই না বরং একটি আকার দান করেছে এর উপাদান সমূহকে, যেভাবে DNA আমাদের দেহ গঠনে অণুগুলো কীভাবে একের সাথে অন্য অণু সজ্জিত হবে তার নির্দেশ দান করে।
DNA-এর মূল কাজ হচ্ছে অনুগুলো কীভাবে বিন্যস্ত হবে তার তথ্য ধরে রাখা। ঠিক একইভাবে প্রাচীন পৃথিবীর পৃষ্ঠে স্তরে স্তরে সজ্জিত কাদামাটির ছাঁচ অ্যামিনো এসিডগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করেছে একটি নির্দিষ্ট সন্নিবেশে। সময়ের পরিক্রমায় জৈব অণুগুলো নিজেরাই নিজেদের সন্নিবিষ্ট করে জটিল জৈবিক অণু সৃষ্টির সূচনা করে।
৩. গভীর সাগরের গহ্বরে
এই তত্ত্ব আমাদের বলে যে সাগরের নিচে যেসব আগ্নেয়গিরি ছিল সেখানে তাপমাত্রা ছিল অনেক বেশী। আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ দিয়ে অনেক হাইড্রোজেন সমৃদ্ধ পদার্থ বেরিয়ে আসতো। সাগরের তলদেশে নুড়িপাথরের কণাগুলো এইসব হাইড্রোজেন সমৃদ্ধ কণাগুলোকে বিক্রিয়ার মাধ্যমে একত্র করতে সাহায্য করে। এই একত্রিত বহুসংখ্যক হাইড্রোজেন সমৃদ্ধ অণু পরবর্তীতে জটিল জৈবিক অণুর সৃষ্টি করে। সাগরের নিচে এই জ্বালামুখগুলো এখনও সক্রিয় এবং এখানে সৃষ্ট এই জটিল জৈবিক অনুগুলো সেখানকার বাস্তসংস্থানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
গভীর সাগরে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ
৪. মেরু অঞ্চলের বরফের অভ্যন্তরে
প্রাচীন পৃথিবী পৃষ্ঠের তাপমাত্রা অনেক বেশী হলেও ৩০০ কোটি বছর আগে সূর্যের উজ্জ্বলতা ছিল এখনকার সূর্যের উজ্জ্বলতার প্রায় তিনভাগের একভাগ। মেরু অঞ্চলের বরফের গভীরতা ছিল ১০০ ফুট বা তারও বেশী। এখানে বরফের কণার ফাকে ফাকে আটকে পড়া জৈবিক অণু সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি এবং কসমিক রশ্মি থেকে নিজেদের রক্ষার সুযোগ পায়। এই আটকে পড়া অণুগুলো পরে একত্রিত হয়ে জটিল জৈবিক অণুর সৃষ্টি করে।
মেরু অঞ্চলের বরফ
৫. RNA-র পৃথিবী
বর্তমান সময়ে দেখা যায় যে, DNA তৈরী করতে প্রোটিন দরকার হয় আবার প্রোটিন তৈরী করতে দরকার হয় DNA. অর্থ্যাৎ এরা একে অপরের প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। তাহলে প্রাচীন পৃথিবীতে কীভাবে এরা একে অন্যের সাহায্য ছাড়া তৈরী হলো?? এর উত্তর হচ্ছে RNA. RNA একই সাথে DNA-এর মত তথ্য ধরে রাখতে পারে এবং একই সাথে প্রোটিনের মত এনজাইম হিসেবে কাজ করতে পারে। এই RNA-ই পরবর্তীতে DNA এবং প্রোটিন তৈরী করে। অর্থ্যাৎ এই তত্ত্ব আমাদের বলে যে প্রাচীন পৃথিবীতে DNA এবং প্রোটিনের আগে শুধুমাত্র RNA সমৃদ্ধ প্রাণ ছিল। পরে DNA এবং প্রোটিন সমৃদ্ধ প্রাণের জন্ম হয় কারণ এরা RNA-র চেয়ে বেশী কার্যকরী। প্রাণির দেহে RNA এখনও বিদ্যমান এবং এখনও এরা প্রাণির দেহে অবস্থান করে কিছু জিনকে সচল অথবা অচল করার কাজ করে। অর্থ্যাৎ এরা কিছু জিনের কার্যক্রমের সুইচ হিসেবে কাজ করে।
প্রাচীন পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির সূচনায় ছিল RNA
৬. সরলীকৃত শুরু
এই তত্ত্ব মনে করে পৃথিবীতে প্রাণ RNA-র মত জটিল অণু দিয়ে শুরু হয়। অর্থ্যাৎ প্রথমেই জিন সৃষ্টি হয়নি। অর্থ্যাৎ রেপ্লিকেশনের ব্যাপারটা প্রথমদিকের প্রাণীদের ছিল না। অতি সাধারণ কিছু রাসায়নিক বিক্রিয়ায় একত্রিত কিছু অণু প্রাণের মূল উপাদান সৃষ্টি করে। কিন্তু একে ছড়িয়ে দেয়ার কোন পদ্ধতি প্রাচীন পৃথিবীর অণুগুলোর ছিল না। সাধারণ এই অনুগুলোই পরে সময়ের পরিক্রমায় বংশবৃদ্ধির পদ্ধতি, অর্থ্যাৎ জিনভিত্তিক প্রাণের সূচনা করে।
অতি সাধারণ কিছু রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে প্রাণ সৃষ্টি সূচনা বলে ধারণা করা হয়।
৭. পৃথিবীর বাইরের প্রাণ
এই তত্ত্বটি সবচেয়ে রোমাঞ্চকর। এমনকি হতে পারে না–প্রাচীন পৃথিবীর বৈরী পরিবেশে কোন প্রাণের উদ্ভব ঘটেনি। এটি ঘটেছিল পৃথিবীর বাইরে, মহাকাশের অন্য কোথাও, যেখানকান পরিবেশ আমাদের অজানা।
মঙ্গলের পৃষ্ঠে উল্কার আঘাতে ছড়িয়ে পড়া প্রস্তরখণ্ড পৃথিবীতেও আঘাত হানে। ভূতত্ত্ববিদ প্রাচীন পৃথিবীর পাললিত শিলা পরীক্ষা করে পৃথিবীর বুকে মঙ্গল গ্রহের প্রস্তরখণ্ড পেয়েছেন। সেই প্রস্তরখণ্ডে কিছু অতিক্ষুদ্র প্রাণির দেহাবশেষ খুঁজে পাওয়া গেছে। এমন হতে পারে ঐ প্রস্তরখণ্ডই পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির নিয়ামক। সেক্ষেত্রে আমাদের আদি বাসস্থান পৃথিবী না, বরং মঙ্গল!!
পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির সূচনা মহাকাশ থেকে আসা কোন উল্কার আঘাতেও হতে পারে।
কিছু কিছু বিজ্ঞানী ধারনা করেছেন পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে অন্য কোন সৌরজগৎ থেকে আসা উল্কার আঘাতে।
কিন্তু এই তত্ত্বটি যদি সত্যও হয়, তাহলে প্রাণ সৃষ্টির প্রশ্নটা প্রাচীন পৃথিবীর পরিবেশে না থেকে চলে যাবে অন্য কোন নক্ষত্রের অন্য কোন গ্রহে। তবুও প্রশ্নটি থেকেই যাবে, সন্দেহাতীত প্রাণ সৃষ্টির কোন প্রমাণ পাওয়ার আগ পর্যন্ত।