ওয়ালস ক্রেইট সাপ কী?
"ওয়ালস ক্রেইট" (বৈজ্ঞানিক নাম: Bungarus sindanus walli) হলো একটি বিষাক্ত সাপ, যা ভারতীয় উপমহাদেশে পাওয়া যায়, বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিম ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল এবং ভুটানের মতো এলাকায়। এটি ক্রেইট প্রজাতির একটি সাপ, যারা Elapidae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। এই প্রজাতির নামকরণ করা হয়েছে বিখ্যাত সর্পবিজ্ঞানী ফ্রাঙ্ক ওয়ালের নামে। এটি প্রায়শই "কমন ক্রেইট" (Bungarus caeruleus) এর সাথে গুলিয়ে ফেলা হয়, তবে এটি একটি স্বতন্ত্র প্রজাতি।
এটি কি বিষাক্ত?
হ্যাঁ, MIS, ওয়ালস ক্রেইট অত্যন্ত বিষাক্ত! এর বিষ প্রধানত নিউরোটক্সিন (neurotoxin) ধরনের, যা স্নায়ুতন্ত্রের ওপর আঘাত করে। এই বিষে আছে বিটা-বাঙ্গারোটক্সিন (β-bungarotoxin) নামক একটি উপাদান, যা স্নায়ু ও পেশির মধ্যে সংযোগ বন্ধ করে দেয়। ফলে শরীরের পেশি অবশ হয়ে যায়, শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়, এবং চিকিৎসা না করলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
এই বিষ প্রি-সিনাপটিক (pre-synaptic) এবং পোস্ট-সিনাপটিক (post-synaptic) উভয় ধরনের নিউরোটক্সিন ধারণ করে। প্রি-সিনাপটিক টক্সিন স্নায়ু থেকে এসিটাইলকোলিন (acetylcholine) নামক রাসায়নিক নিঃসরণ বন্ধ করে, যা পেশি সংকোচনের জন্য দরকার। আর পোস্ট-সিনাপটিক টক্সিন পেশির রিসেপ্টরে এসিটাইলকোলিনের কাজ বন্ধ করে দেয়। এই দুইয়ের সম্মিলিত প্রভাবে শরীর পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
এটি দেখতে কেমন?
ওয়ালস ক্রেইট সাধারণত মাঝারি আকারের সাপ, যার দৈর্ঘ্য ১৬৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। এর শরীর চকচকে নীলাভ-কালো বা গাঢ় চকোলেট বাদামি রঙের হয়, এবং এতে সাদা বা দুধের মতো সাদা ব্যান্ড থাকে। এই ব্যান্ডগুলো অন্যান্য ভারতীয় ক্রেইটের তুলনায় বেশি সংখ্যায় থাকে, যা এটিকে চেনার একটি বড় লক্ষণ। ছোটবেলায় এর পেট সাদা থাকে, কিন্তু বড় হলে সেটা হালকা হলুদ বা ধূসরাভ হয়ে যায়। মাথাটা গোলাকার এবং ছোট কালো চোখ থাকে।
এটি কোথায় থাকে?
এই সাপটি বৈচিত্র্যময় পরিবেশে বাস করে—জঙ্গল, কৃষি জমি, গ্রামীণ এলাকা এবং এমনকি শহরের কাছাকাছি। এটি রাতে বেশি সক্রিয় (nocturnal), তাই দিনের বেলা এটিকে দেখা যায় না। বাংলাদেশে, এটি গ্রামাঞ্চলে বা কৃষি এলাকায় পাওয়া যেতে পারে, বিশেষ করে যেখানে অন্য সাপ বা ছোট প্রাণী আছে, কারণ এটি ওফিওফ্যাগাস (ophiophagous), অর্থাৎ অন্য সাপ খায়।
এর বিষ কতটা বিপজ্জনক?
ওয়ালস ক্রেইটের বিষ খুবই শক্তিশালী। এটি যদি কামড়ায়, তবে প্রথমে ব্যথা না হলেও ধীরে ধীরে লক্ষণ দেখা দেয়—প্রথমে পেটে ব্যথা, তারপর পেশি অবশ হওয়া, চোখের পাতা ঝুলে পড়া (ptosis), এবং শ্বাস নিতে কষ্ট। যদি চিকিৎসা না করা হয়, তবে ৬-১২ ঘণ্টার মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যু হতে পারে। বাংলাদেশে ক্রেইটের কামড় থেকে মৃত্যুর হার অনেক, কারণ অনেক সময় রাতে লোকজন ঘুমের মধ্যে কামড় খায় এবং বুঝতে পারে না।
তবে ভালো খবর হলো, পলিভ্যালেন্ট অ্যান্টিভেনম (polyvalent antivenom) দিয়ে এর চিকিৎসা সম্ভব। এই অ্যান্টিভেনম ভারত ও বাংলাদেশে পাওয়া যায়, যা ক্রেইট সহ "বিগ ফোর" সাপের বিষের জন্য কার্যকর। তবে দ্রুত হাসপাতালে যাওয়া জরুরি।
এটি কি আক্রমণাত্মক?
না, MIS! ওয়ালস ক্রেইট সাধারণত লাজুক এবং শান্ত। দিনের বেলা এটি পালিয়ে যায় বা মাথা লুকিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকে। তবে রাতে এটি সক্রিয় থাকলে বিরক্ত করলে কামড়াতে পারে। তাই গ্রামে থাকলে রাতে সাবধানে চলাফেরা করা উচিত।
মজার তথ্য—ক্রেইটের বিষ এত শক্তিশালী যে গবেষকরা এটি থেকে নিউরোটক্সিন নিয়ে স্নায়ুতন্ত্রের গবেষণা করছেন। এটা বোঝার চেষ্টা করছে যে আমাদের শরীরের স্নায়ু কীভাবে কাজ করে। তাই এই সাপ শুধু ভয়ের নয়, বিজ্ঞানের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ!