ক্রিপ্টোকারেন্সি বলতে আমরা প্রথমেই বিটকয়েন বুঝি। যারা ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে কাজ করে, তারা হয়তো খুব ভালোমতো বুঝতে পারে ইথেরিয়াম কী! বিটকয়েনের পর ইথেরিয়াম হলো দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনপ্রিয় ক্রিপ্টোকারেন্সি। 2015 সালে Vitalik Buterin এবং Gavin Wood ইথেরিয়াম এর প্রতিষ্ঠা করেন।
কিন্তু ইথেরিয়াম শুধু যে বিটকয়েনের মতো আদান-প্রদানযোগ্য ক্রিপ্টোকারেন্সি না, বরং ইথেরিয়াম হল ব্লকচেইন প্রযুক্তির উপর নির্মিত একটি ডিসেন্ট্রালাইজড কম্পিউটিং নেটওয়ার্ক।
এখানে জানার জন্য সংক্ষেপে দুইটা বিষয় সম্পর্কে ধারণা দেওয়া দরকার- ডিসেন্ট্রালাইজড ও ব্লকচেইন।
১. ডিসেন্ট্রালাইজড- ডিসেন্ট্রালাইজ এর সোজা বাংলায় অর্থ হলো বিকেন্দ্রীকরণ। আমরা যখন ব্যাংকে আদানপ্রদান করি, আমাদের প্রত্যেকটা তথ্য একটা কেন্দ্রে জমা থাকে, সেটা ধরলাম বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু ব্লকচেইনের ক্ষেত্রে কোনো একটা নির্দিষ্ট কম্পিউটারে তথ্য সংরক্ষণ করা হয় না, বরং এই একটা কেন্দ্রে প্রত্যেকটা তথ্য একীভূত না করে ব্লকচেইনে নেটওয়ার্কে যুক্ত অনেকগুলা কম্পিউটারে তথ্যগুলো সংরক্ষণ করা হয়। অনেকগুলো কম্পিউটারে একই ধরনের তথ্য ব্লক আকারে সংরক্ষণ করা হয়, এতে হ্যাকিং এর সম্ভাবনাও নেই। কারণ একটা কম্পিউটার হ্যাক করলেও বাকি কম্পিউটারে তথ্য থেকে যাচ্ছে, আর অন্যান্য কম্পিউটারগুলোও সেসময় সতর্কবার্তা পেয়ে যায়।
২. ব্লকচেইনঃব্লকচেইনকে বলা হয় বিটকয়েন এর বাই প্রোডাক্ট। যদিও ব্লকচেইন অলরেডি এক্সিজটিং টেকনোলজির সমন্বয়েই তৈরি- Cryptography+ Proof of work+ decentralised network.বিটকয়েন উৎপত্তির আগে ব্লকচেইন নামে কোনো শব্দ ছিলো না। বিটকয়েন যখন সকলের সামনে আসলো, তখন এর উৎস, কাজের উপায় খুঁজে তারা এই তিনটার সন্ধান পায়- নামকরণ করে "ব্লকচেইন"। যদিও বিটকয়েনের ফাউন্ডার হোয়াইটপেপারে এটাকে " চেইন অব ব্লক" হিসেবেও অভিহিত করেছিলেন। মূলত ব্লকচেইন টেকনোলজি- যেখানে সব তথ্য স্টোর করে রাখা যায়৷ এখানে ব্লকচেইন ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেন, কিংবা NFT মালিকানা, Defi- স্মার্ট কন্ট্রাক্ট সম্পর্কে তথ্য রেকর্ড রাখে।
প্রচলিত ডাটাবেস এর সাথে এর পার্থক্য হলো- ব্লকচেইন সম্পূর্ণ ডিসেন্ট্রালাইজড। এখানে নেটওয়ার্ক জুড়ে ছড়িয়ে থাকা একাধিক কম্পিউটারে ব্লকচেইন ডাটাবেসের অনেকগুলি অভিন্ন কপি রাখা হয়। একেকটা কম্পিউটারকে নোড হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
পাবলিক ব্লকচেইনে, যে কেউ অংশগ্রহণ করতে পারে- তারা ব্লকচেইনের ডেটা পড়তে, লিখতে বা অডিট করতে পারে।পাবলিক ব্লকচেইনে লগ ইন করা, লেনদেন পরিবর্তন করা খুবই কঠিন কারণ কোনো একক কর্তৃপক্ষ নোডগুলি নিয়ন্ত্রণ করে না।
আর প্রাইভেট ব্লকচেইন কোনো একক সংস্থা বা গ্রুপ দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয়-শুধুমাত্র তারাই ডিসাইড করবে কে সিস্টেমে ঢুকতে ও পরিবর্তন করতে পারবে, কে পারবে না। প্রাইভেট ব্লকচেইন এর কার্যক্রম অনেকটা ইন-হাউজ ডাটা স্টোরেজ সিস্টেম এর মতো, খালি এখানে এক্সট্রা সিকিউরিটি হিসেবে একাধিক নোড যুক্ত থাকে।
এখন সেই প্রথম জায়গায় ফিরে যাই, ইথেরিয়াম আসলে কী?
Ethereum হল অর্থ লেনদেন, ও নতুন এপ্লিকেশনের জন্য গ্লোবাল, ডিসেন্ট্রালাইজড প্ল্যাটফর্ম, যেখানে হাজার হাজার গেম এবং আর্থিক অ্যাপ Ethereum ব্লকচেইনে চলমান।
ইথেরিয়াম এতই জনপ্রিয় যে অন্যান্য ক্রিপ্টোকয়েনও এখানে রান করা হয়। কোনো একটা সিস্টেম সম্পূর্ণ ডিসেন্ট্রালাইজড করতে হলে অনেকগুলো কম্পিউটার নেটওয়ার্কে রানিং থাকতে হয়। এর আগে বিটকয়েন ছিলো সবথেকে বড় নেটওয়ার্ক।বিটকয়েন এর পিছনে রয়েছে Turing incomplete ল্যাংগুয়েজ, যা শুধু লেনদেনের হিসাব নিকাশ টাই রান করতে পারতো। কিন্তু আরও কমপ্লেক্স সিস্টেমের জন্য আরও শক্তিশালী প্রোগ্রাম দরকার। ঠিক এই জায়গা থেকেই ইথিরিয়াম নেটওয়ার্কের উৎপত্তি। ইথিরিয়াম ২০১৪ তে লাঞ্চ করা হয়। ইথিরিয়াম ডিসেন্ট্রালাইজড প্রোগ্রামের জন্য একধরনের "Do it yourself" প্ল্যাটফর্ম বা Dapps- ডিসেন্ট্রালাইজড অ্যাপস। এইদিক থেকে ইথেরিয়াম ওয়ার্ল্ড ওয়াইডে Dapps রান করার একটি অবকাঠামো- আপনাকে যা করতে হবে, ইথেরিয়াম এর কোডিং ল্যাংগুয়েজ "solidity" দিয়ে ইথেরিয়াম নেটওয়ার্কে প্রোগ্রাম ইনপুট করা। এটা কোনো কারেন্সি না, এটা একটা প্ল্যাটফর্ম। ইথেরিয়াম এর মূল লক্ষ্য হলো পুরো ইন্টারনেটকে ডিসেন্ট্রালাইজ করা। কথাটা একটু অন্যরকম হতে পারে। এ নিয়ে পরে কথা হবে।ইথেরিয়াম প্ল্যাটফর্মে আপনি একে অন্যের সাথে নিজে যোগাযোগ করতে পারবেন, লেনদেন করতে পারবেন কোনো সেন্ট্রাল অথোরিটির সাহায্য ছাড়াই।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, ইথেরিয়াম কাজ করে কীভাবে? ইথেরিয়াম আসলে Dapps রানিং এর জন্য স্মার্ট কন্ট্রাক্ট তৈরি করে থাকে। ইথেরিয়াম ডেভেলপাররা Dapps রানিং এর জন্য কন্ডিশন লিখে, আর ইথেরিয়াম নেটওয়ার্ক তা এক্সেকিউট করে- একে বলা হয়ে থাকে স্মার্ট কন্ট্রাক্ট। একটা স্মার্ট কন্ট্রাক্ট ইথেরিয়াম নেটওয়ার্ক এ ইনপুট করা হলে তা এডিট করা যায় না, বা কারেকশন আনা যায় না, এমনকি এডিটর বা ডেভেলপাররাও তা চেঞ্জ করতে পারবে না।এখান থেকেই ইথেরিয়াম একটা অলিখিত ঘোষণা দিয়ে দেয়- "The code is law".
কিন্তু এই কাজগুলো করার জন্য তো টাকা লাগবে, এই টাকা কোথা থেকে আসবে? সেই টাকার জন্যই ইথার এর আগমন। অবশ্যই এটা রসায়নের ইথার না, এটা ইথেরিয়ামের নিজস্ব কারেন্সি "ইথার"। মানুষ যখন ইথেরিয়ামের মূল্য জিজ্ঞাসা করে, তখন মূলত ইথারকেই বুঝায়। বিটকয়েন মাইনারসরা যেমন বিটকয়েন ব্লকচেইন মেইনটেইনের জন্য পারিশ্রমিক পায়, তেমনি ইথেরিয়াম প্রটোকল তাদের কম্পিউটারে রান করার জন্য " ইথার" কারেন্সিতে পারিশ্রমিক পায়। একটা স্মার্ট কন্ট্রাক্ট ইথেরিয়াম প্ল্যাটফর্মে ইনপুট করার জন্য ক্লায়েন্টকে পে করতে হয়, পেমেন্ট হয় "ইথার" এর মাধ্যমে। ২০১৪ সালে ইথারের প্রবর্তন হয়, এবং এর মূল্য হয় চল্লিশ সেন্ট এর মতো, বর্তমানে এই ইথারের মূল্য হাজার ডলারের কাছাকাছি৷
লেখায়ঃ Metheela Farzana Melody