হাইয়ারার্কি প্রবলেম
৪ জুলাই ২০১২। জেনেভায় এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলন চলছিল সেদিন। সেই সম্মেলনে সার্নের বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করেন, হিগস বোসন কণা প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করা হয়েছে। ওই সম্মেলনে এ কথাও বলা হয়, শতভাগ গ্যারান্টি দিয়ে বলা যাচ্ছে না নতুন আবিষ্কৃত কণাটিই হিগস বোসন কণা। তবে এই সন্দেহের কফিনে এলএইচসির বিজ্ঞানীরা শেষ পেরেক ঠোকেন পরের বছর ১৪ মার্চ, ইতালির এক সম্মেলেনে। তখন তাঁরা শতভাগ নিশ্চিত নতুন আবিষ্কৃত কণাটিই হিগস বোসন। এই আবিষ্কারে সঙ্গে সঙ্গে পদার্থবিদ্যার জগতে খুলে যায় এক নতুন দুয়ার। কারণ দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায় এই আবিষ্কারের মাধ্যমেই।
বস্তুর ভরের উত্স কী? সাদামাটা মনে হলেও প্রশ্নটা কিন্তু ওজনদার। বস্তুকে ভাঙলে একসময় অণু-পরমাণু হয়ে ইলেকট্রন আর কোয়ার্কে পরিণত হবে। ইলেকট্রন আর কোয়ার্কেরও ভর আছে। কিন্তু সেই ভরের উত্স কী? বহুদিন ধরে বিজ্ঞানীরা এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলেন। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছিল না। গত শতাব্দীর শেষ দিকে একদল বিজ্ঞানী নতুন এক কণার প্রস্তাব করেন, কণাটির নাম হিগস বোসন। যার তুমুল জনপ্রিয় নাম ঈশ্বর কণা। যে বিজ্ঞানীরা এই কণার কথা প্রথম বলেন, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত নাম স্কটল্যান্ডের এডিনবরার তত্কালীন অধ্যাপক পিটার হিগস। অন্যরা হলেন টম কিব্ল, ফিলিপ অ্যান্ডারসন, কার্ল হেগেন, ফ্রাঁসোয়া এংলার্ট, রবার্ট ব্রাউট এবং জেরাল্ড গুরালনিক।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
হিগস বোসনের কথা বললেন বিজ্ঞানীরা। সেই হিগস বোসনই বা কণাদের কীভাবে ভর দান করে? কোনো স্থির বস্তুকে বাহ্যিক কোনো বলের (Force) সাহায্যে ঠেলা দিলে সে কত তাড়াতাড়ি গতি পাবে, তা নিশ্চিত করে তার ভর। ভর যত বেশি হবে, সে গতি পাবে তত ধীরে। ধরা যাক, শুকনো স্বাভাবিক রাস্তায় একটা লোক হাঁটছে। এ ক্ষেত্রে তার হাঁটার গতি স্বাভাবিক। কিন্তু রাস্তায় যদি হাঁটু পরিমাণ পানি জমে থাকে, তবে তার হাঁটার গতি আর আগের মতো থাকবে না। বেশ কমে যাবে। আবার পানির বদলে রাস্তায় যদি মধু জমে থাকে, তবে হাঁটার গতি আরও কমে যাবে।
বিজ্ঞানীরা বললেন হিগস বোসন কণা শূন্যের মধ্যে শক্তি ছড়িয়ে রাখে, সেই শক্তি ছড়িয়ে থাকে একটা বল ক্ষেত্রের মধ্যে। কণাদের জন্মের আগেই স্থানকালজুড়ে এই বলক্ষেত্র ছড়িয়ে পড়ছে। মহাবিস্ফোরণের পর যখন মূল কণাদের জন্ম হয়, তখন এরা ভরহীন ছিল। জন্মের পরপরই সেই ভরহীন অন্য কণাদের এগোতে হয় শূন্যের মধ্যে জমাট শক্তির ওই বাধা ঠেলে। আইনস্টাইনের E=mc2 সমীকরণের ভেতরেই লুকিয়ে আছে বস্তু ও শক্তি আসলে সমার্থক বিষয়। তাই জমে থাকা শক্তি জমে থাকা বস্তুর মতো। সেই জমাট শক্তিকে ঠেলে সামনে এগোতে গেলে সব কণারই স্বাভাবিক গতি বাধাগ্রস্ত হয়। আর তাতেই বস্তুটা ভারী হয়ে ওঠে।
এই প্রক্রিয়ার বাইরে কেবল আলোর ফোটন কণা। কারণ, ফোটন শুধু তারই সঙ্গে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় অংশ নেয়, যার নিজস্ব বৈদ্যুতিক চার্জ আছে। হিগস বোসন চার্জহীন কণা। তাই তার শূন্যে ছড়ানো জমাট শক্তিও কোনো চার্জ বহন করে না, আর এ কারণেই আলোর কণা তার মধ্য দিয়ে চলতে গেলে বাধা পায় না।
২০১২ সালে শনাক্ত হয় হিগস বোসন বা ঈশ্বর কণা। এর সঙ্গে সঙ্গেই পূর্ণতা পায় পদার্থবিদ্যার স্ট্যান্ডার্ড মডেল। স্ট্যান্ডার্ড মডেলে মহাবিশ্বের সব মৌলিক কণাদের স্থান দেওয়া হয়েছে। হিগস বোসনের জন্য একটা স্থান ছিল তাতে। অন্য সব কণা তত দিনে আবিষ্কার করা হয়ে গেছে। সন্ধান মেলেনি কেবল হিগস বোসন কণার দেখা। তাই স্ট্যান্ডার্ড মডেলে হিগস বোসনের ঘরটি ফাঁকাই ছিল দীর্ঘদিন। হিগস বোসন কণা শনাক্তের ব্যাপারটা যখন নিশ্চিত হলেন বিজ্ঞানীরা, সেদিন থেকে সেই ঘরটা আর ফাঁকা রইল না। হিগস বোসন কণাকে বসানো হলো সেখানে। অর্থাৎ সম্পূর্ণরূপে পূর্ণতা পেল কণা পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে সফল মডেলটি। কিন্তু বিজ্ঞানে শেষ বলে কিছু নেই। তাই একটা সমস্যা সমাধানের সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা সমস্যা এসে হাজির হয়। কণা পদার্থবিজ্ঞানেও এল নতুন সমস্যা। সমস্যাটার নাম হাইয়ারার্কি প্রবলেম। হাইয়ারার্কি প্রবলেমটা কী?
একটা হিগস বোসনকে যদি শূন্যস্থানে রেখে দেওয়া হয়, তাহলে এরা ভার্চ্যুয়াল কণাদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়ে। ভার্চ্যুয়াল কণা আবার কী? এ প্রশ্নের জবাব দেয় কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। এই বলবিদ্যা দাঁড়িয়ে আছে অনিশ্চয়তা তত্ত্বের ওপর, গত শতাব্দীর কুড়ির দশকে যেটা দাঁড় করিয়েছিলেন জার্মান পদার্থবিদ ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ। সেই তত্ত্ব বিশ্লেষণ করেই বেরিয়ে আসে আরেকটা তত্ত্ব—কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন। এই তত্ত্ব বলে, শূন্যস্থান আসলে শূন্য নয়। তার ভেতর লুকিয়ে আছে শক্তি। সেই শক্তির জোগান দেয় ভার্চ্যুয়াল কণারা।
সাধারণ কণার আর তার প্রতিকণার ভর সমান, কিন্তু চার্জ উল্টো। ইলেকট্রন আর পজিট্রনের ভরের সমান। কিন্তু পজিট্রনের চার্জ ধনাত্মক। তেমনি প্রোটনের আর অ্যান্টিপ্রোটনের ভর সমান কিন্তু প্রোটন ধনাত্মক আর অ্যান্টিপ্রোটনের ভর ঋণাত্মক। একজোড়া কণা আর প্রতিকণা পরস্পরের সংস্পর্শে এলে দুটোই ধ্বংস হয়ে যায়। পড়ে থাকে শুধু শক্তি, আলো বা ফোটন আকারে। একটা প্রোটন আর অ্যান্টিপ্রোটন পরস্পরকে ধ্বংস করে দেয়, তেমনি ইলেকট্রন পজিট্রনকে, কোয়ার্ক অ্যান্টিকোয়ার্ককে ধ্বংস করে দেয়। শূন্যস্থানে এলে সব সময় এই কণা-প্রতিকণার সৃষ্টি আর ধ্বংসের খেলা চলছে। বিজ্ঞানীরা বলেন, প্রতিমুহূর্তে সব জায়গায় কণা আর প্রতি কণার জোড়া তৈরি হচ্ছে। কিন্তু তারা খুব ক্ষণস্থায়ী। জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই এরা পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটিয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। পড়ে থাকে শক্তি। সেই শক্তিই পরক্ষণে আবার একজোড়া কণা-প্রতিকণা তৈরি করে। এভাবেই শূন্যস্থান থেকে যেসব কণা ও প্রতিকণার জোড়া তৈরি হয়, তাদের বলে ভার্চ্যুয়াল কণা। আর হিগস বোসনের সঙ্গে এই ভার্চ্যুয়াল কণাদের মিথস্ক্রিয়া ঘটে।
ভার্চ্যুয়াল কণাদের কথা এখন থাক। ফিরে আসি হাইয়ারার্কি প্রবলেমে। হিগস বোসন কণাদের ভার্চ্যুয়াল কণাদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার ফলে এদের ভরের পরিবর্তন ঘটার কথা। শূন্যস্থানে বা শূন্য শক্তিমাত্রায় হিগস বোসনের ভর ১২৫ জিইভি (গিগা ইলেকট্রো ভোল্ট)। গ্র্যান্ড ইউনিফিকেশন থিওরির যে শক্তিমাত্রা সেই শক্তিমাত্রায় হিগস বোসনের ভর হওয়ার কথা অনেক বেশি। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে জিইউটি শক্তিমাত্রাতেও হিগস বোসনের ভর একটুও বাড়ে না। আটকে থাকে সেই ১২৫ গিগাইলেকট্রো ভোল্টে। ভর কেন বাড়ে না? ভর হিসাব অনুযায়ী না বাড়ার এই সমস্যাকেই বলে হাইয়ারার্কি প্রবলেম।
জিইউটি শক্তিমাত্রা কী? জিইউটি হলো সেই বিখ্যাত গ্র্যান্ড ইউনিফেকশন থিওরি। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে স্টিভেন ওয়েনবার্গ, আবদুস সালাম আর শেলডন গ্ল্যাশোরা বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় বল আর দুর্বল নিউক্লীয় বলকে একীভূত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই দুই একীভূত বলের নাম হয় তড়িৎ-দুর্বল বল। তারপর থেকে বিজ্ঞানীরা আজও চেষ্টা করে যাচ্ছেন সবল নিউক্লীয় বল আর তড়িৎ-দুর্বল বলকে একীভূত করার। অর্থাৎ সবল, দুর্বল নিউক্লীয় আর বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় বলকে একত্র করার চেষ্টা চলছে। যে তত্ত্বের সাহায্যে এই তিনটি বলকে একত্র করার চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা, সেই তত্ত্বকে বলে গ্র্যান্ড ইউনিফিকেশন থিওরি। যার সংক্ষিপ্ত রূপ হলো জিইউটি। যে শক্তিমাত্রায় এই তিন বলকে একত্র করা সম্ভব সেই শক্তিমাত্রাকে বলে জিইউটি শক্তিমাত্রা।
হাইয়ারার্কি প্রবলেমের ব্যাখ্যা কী?
বিজ্ঞানীরা দুটি কারণ দাঁড় করিয়েছেন এর ব্যাখ্যায়। প্রথমটিতে ভার্চ্যুয়াল কণাদের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ভার্চ্যুয়াল কণাদের ওপর হিগস বোসনের প্রভাব পরস্পর বিপরীতধর্মী। ভার্চ্যুয়াল কণাদের অর্ধেক হিগস বোসনের ভর বাড়িয়ে দেয়। বাকি অর্ধেক কমিয়ে দেয় সেই ভর। সুতরাং শক্তিমাত্রা যতই বাড়ুক হিগস বোসনের ভর একই থেকে যায়। দ্বিতীয় ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে, কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ভার্চ্যুয়াল কণাদের সঙ্গে হিগস বোসনের মিথস্ক্রিয়া অল্প শক্তিতেই থেমে যায়। এ কারণে হিগস বোসনের ভর বাড়ার আর অবকাশ পায় না।
হাইয়ারার্কি প্রবলেমের একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। সেটা সুপারসিমেট্রির নামের একটা তত্ত্ব দিয়ে। কিন্তু সুপারসিমেট্রিই পদার্থবিজ্ঞানে ঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সত্যি বলতে কী, সুপারসিমেট্রিতে একঝাঁক নতুন কণাদের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। সেসব কণার একটিরও হদিস মেলেনি। তাই সুপারসিমেট্রি এখনো হাইপোথিসিস পর্যায়ে আছে। এ জন্য হাইয়ারার্কি সমস্যার সমাধান হয়েছে, এ কথা বড় গলায় বলতে পারছেন না বিজ্ঞানীরা।