শিবের ত্রিশুলের মতো একটা চিহ্ন আছে কোয়ান্টাম বলবিদ্যায়—ψ বিজ্ঞানের ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় আর বহুল ব্যবহৃত চিহ্নগুলোর একটি। এর তুলনা শুধু মহাকর্ষ ত্বরণ g আর প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবক h-এর সঙ্গেই করা যায়। তবে এ দুটির সঙ্গে ψ তফাৎ হলো, এটা ধ্রুবক নয়। কথা হচ্ছে, ψ-এর মজেজাটা কী? মজার ব্যাপার হলো, ψ-এর যিনি জন্মদাতা, সেই আরউইন শ্রোডিঙ্গারও এর মর্ম বুঝতে পারেননি। পরে এর তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছিলেন জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স বর্ন।
Ψ কেন এসেছিল কোয়ান্টাম বলবিদ্যায়? এসেছিল, ইলেকট্রনের তরঙ্গ চরিত্রের ব্যাখ্যা দিতে। ফরাসি বিজ্ঞানী লুই দ্য ব্রগলি দেখিয়েছিলেন, ইলেকট্রনের যেমন কণা ধর্ম আছে, তেমনি এর তরঙ্গ ধর্মও আছে। কিন্তু মুশকিল হলো কণা আর তরঙ্গের ব্যাখ্যার জন্য আলাদা আলাদা গণিত ব্যবহার করতে হয়। দ্য ব্রগলি অঙ্ক কষে দেখালেন বটে, কিন্তু এর কণাচরিত্রের গাণিতিক কাঠামো কেমন হবে, সেটার ষোলআনা ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। চিরায়ত বলবিদ্যায় বস্তুর গতিপ্রকৃতি ব্যাখ্যার জন্য আছে নিউটনীয় বলবিদ্যা। আবার তরঙ্গের জন্য আছে তরঙ্গগতিবিদ্যা। কিন্তু কোনো বস্তু যখন একই সঙ্গে কণা তরঙ্গ, তখন তাদের জন্য একটা সমন্বিত বলবিদ্যা দরকার হয়। ১৯২৪ সালে ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ ম্যাট্রিক্স বলবিদ্যা প্রতিষ্ঠা করেন, যাঁর সাহায্যে ইলেকট্রনের মতো কোয়ান্টাম কণিকাদের জন্য আলাদা একটা বলবিদ্যা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলো। এর পরেই আসে শ্রোডিঙ্গারের তরঙ্গ ফাংশন এবং দু বছর পর হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি। দুজন একবারে স্বতন্ত্র পদ্ধতিতে তত্ত্ব দুটি দাঁড় করিয়েছিলেন বটে, কিন্তু দেখা গেল, সে দুটো একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ এই দুই তত্ত্ব। এ নিয়ে দুই বিজ্ঞানী প্রথম দিকে একমত ছিলেন না। কিন্তু দুই তত্ত্ব থেকে যেসব পর্যবেক্ষণমূলক ফলাফল আসছিল, সেগুলোই প্রমাণ করল গাণিতিক কাঠামো যেমনই হোক, দুই তত্ত্বের সারকথা এক।
দুই
হাইজেনবার্গ তাঁর অনিশ্চয়তা নীতিতে বলেছিলেন এক অদ্ভুত কথা। ইলেকট্রনের মতো খুদে কণাদের গতিবেগ কিংবা অবস্থান আপনি চাইলেই একই সঙ্গে নিখুঁতভাবে পরিমাপ করতে পারবেন না। গতিবেগ পরিমাপ করতে গেলে এর অবস্থান অনিশ্চিত হয়ে যাবে, আবার যদি অবস্থান পরিমাপ করতে চান সুনির্দিষ্টভাবে তাহলে এর গতিবেগ অনিশ্চিত হয়ে যাবে।
কেন এমনটা হয়?
এই প্রশ্নের জবাবের ভেতরেই রয়েছে ওয়েভ ফাংশন কলাপ্স বা ψ-এ ভাঙন ধরার উত্তর। তাই সাইয়ের পরিচয়টা জানা জরুরি।
তরঙ্গ বলবিদ্যায় তরঙ্গ ফাংশন থাকে, সাইন ওয়েভের জন্য একরকম, পানির তরঙ্গের জন্য আরেক রকম, শব্দ তরঙ্গের জন্য আরেক রকম। কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় এমন একটা বস্তুর তরঙ্গ ফাংশন দরকার ছিল, যেটার শুধু তরঙ্গ ধর্মের ব্যাখ্যা করবে না, এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে বস্তু নিজেও। ψ হলো সেই যখের ধন, যার আবিষ্কর্তা শ্রোডিঙ্গার নিজেই সেটা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। পরে বহুভাবে বহুজন এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
মূল প্রশ্নে যাওয়ার আগে বরং, আমরা দেখে আসি ψ-এর ভাঙন ধরাটা আসলে কেমন?
তিন
ধরা যাক, একটা ইলেকট্রন আছে একটা শক্তিস্তরে। ইলেকট্রনটা কোথায় আছে। ψ আমাদের জানিয়ে দেয়, সেটার অবস্থান পুরো শক্তিস্তর জুড়ে। আসলেই কী তাই? একটা বস্তু একই সঙ্গে শক্তিস্তরের পুরোটাজুড়ে থাকতে পারে?
কোয়ান্টাম জগতে সবই সম্ভব। ইলেকট্রনের মতো কণারা হলো পয়েন্ট পার্টিকেল, বাংলায় যাকে বলে বিন্দুকণা। বিন্দুকণাদের নির্দিষ্ট কোনো আকার নেই, মানে এরা বিন্দুর মতো শূন্যমাত্রিক। এরা ছোটে দূরন্ত গতিতে। সেই ছোটা যদি আপনি পর্যবেক্ষণ করতে যান, তাহলে কিছু অনিশ্চয়তা চলে আসে সে কথা আগেই বলেছি। অর্থাৎ অবস্থান বা গতিবেগ যে কোনো একটি অনিশ্চিত হয়ে যাবে।
কেন হবে? কারণ, আপনার পর্যবেক্ষণ করা যন্ত্রপাতি, কিছু যান্ত্রিক ত্রুটি আর কণাদের ওপর আলোর প্রভাব।
আলোক তড়িৎক্রিয়া নামে একটা ব্যাপার আছে পদার্থবিজ্ঞানে। বিশেষ কিছু ধাতব পদার্থের ওপর উচ্চ কম্পাঙ্কের অর্থাৎ উচ্চ শক্তির আলোক রশ্মি ছুড়ে মারলে আলোর আঘাতে সর্বশেষ শক্তিস্তরের যোজনি ইলেকট্রনগুলো ধাতব পরামাণু থেকে মুক্ত হয়। তারপর আঘাতের তীব্রতার ওপর নির্ভর করে, সেই ইলেকট্রনগুলো ছিটকে দূরে সরে যেতে পারে। আলো কণা বলেই এটা সম্ভব। শুধু তরঙ্গ হলে আলোর পক্ষে কখনোই সম্ভব হতো না একটা ইলেকট্রনকে শক্তিস্তর থেকে বিচ্যুত করা। ১৯০৫ সালে আলবার্ট আইনস্টাইন আলোক তড়িৎক্রিয়ার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাহায্যে। এই ঘটনার মাধ্যমেই আসলে প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্ব শক্ত ভীতের ওপর দাঁড়িয়ে যায়, আর এ ব্যাখ্যার জন্য ১৯২১ সালে আইনস্টাইনকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল দেওয়া হয়।
আলোক তড়িৎক্রিয়ার এই ব্যাপারটা থেকে নিশ্চিত ইলেকট্রনের চলাচলের ওপর ফোটন কণা, অর্থাৎ আলো বেশ ভালোমতোই ছড়ি ঘোরাতে পারে। এ কারণেই কোয়ান্টাম জগতে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়।
বিজ্ঞাপন
আপনি যখন কোনো ইলেকট্রনের গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করবেন, সেটা আপনি যেভাবেই করুন না কেন, আলোর দরকার হবেই হবে। আপনি যে মহূর্তে ইলেকট্রনকে পর্যবেক্ষণ করতে যাবেন, তখন এর ওপর আপনাকে আলো ফেলতে হবে। কিন্তু আলোর কারণে যদি ইলেকট্রনের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে যায়, তাহলে আপনি একেবারে সূক্ষ্ম পরিমাপ করতে ব্যর্থ হবেন। এর সমাধান ছিল অনিশ্চিয়তা নীতির মধ্যেই। যেহেতু আলোর আঘাতে ইলেকট্রনের অবস্থান বিচ্যূত হচ্ছে, তাই একই সঙ্গে একই যন্ত্র দিয়ে এর অবস্থান, ভরবেগ, শক্তি ও সময় পরিমাপ করতে না যাওয়ায় ভালো। অনিশ্চয়তার জ্বালাতন থেকে বাঁচতে হলে আলাদা আলাদা যন্ত্র নিন, আলাদা আলাদাভাবে রাশিগুলো মাপুন। দেখবেন, সবগুলো মানই ঠিকঠাক ভাবে মাপতে পারছেন। শুধু একই সময়ের সবগুলো মান পাবেন না।
এটাই ছিল অনিশ্চয়তা নীতির সারকথা। এই নীতি মানতে গেলে কিছু সমস্যা তৈরি হয়। চিরায়ত বলবিদ্যায় যেমন আগেভাগে হিসাব করে বলে দেওয়া যেত কোনো একটা সময়ে বস্তুর অবস্থান, ভরবেগ, শক্তি ইত্যাদি, ইলেকট্রনের ক্ষেত্রে সেটা আর সম্ভব নয়।
চার
অনিশ্চয়তা নীতি প্রকাশের দুই বছর আগেই ১৯২৫ সালে অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী আরউইন শ্রোডিঙ্গার ইলেকট্রনের তরঙ্গ সমীকরণ প্রকাশ করেন। তরঙ্গ ফাংশন হিসেবে ব্যবহার করেন ψ-কে। ψ আসলে একটা শক্তিস্তরে কোনো বিন্দুতে ইলেকট্রনের থাকার সম্ভাবনা কতটুকু সেটাই বলে দেয়। কোন বিন্দুতে ψ এর মান কখনো শূন্য হবে না। আবার কোনো বিন্দুতে এর মান শতভাগ হবে না। ψ বলে, পুরো শক্তিস্তর জুড়ে প্রতিটা বিন্দুতে ইলেকট্রন পাওয়ার কিছু না কিছু সম্ভাবনা আছে। অর্থাৎ শক্তিস্তর জুড়ে ইলেকট্রন থাকে মেঘের মতো। সেই মেঘের কোন বিন্দুতে ইলেকট্রন পাওয়া যাবে একেবারের কণার মতো করে, সেই হিসাবটা শ্রোডিঙ্গার মেলাতে পারেননি ψ-এর সাহায্যে। তিনি যেভাবে হিসাবটা করেছিলেন, তাতে ψ-এর মানে জটিল সংখ্যা এসে যায়। তখন জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স বর্ন হিসাবটা আরেকটু প্রসারিত করলেন। তিনি এই ফাংশনের সমাধান করলেন মডুলাস ব্যবহার করে। অর্থাৎ ψ-এর বদলে ।ψ।2 ব্যবহার করে জটিল সংখ্যা এড়াতে সক্ষম হলেন।
তরঙ্গ ফাংশন ψ-এর সাহায্যে তখন কোনো বিন্দুতে ইলেকট্রনের অবস্থান নির্ণয় করার একটা পথ তৈরি হলো। এখন কোন পর্যবেক্ষক যদি ইলেকট্রন অবস্থান নির্ণয় করতে চান, তাহলে সেটা সম্ভব। কীভাবে সম্ভব?
আসলে এই পর্যায়ে এসে শ্রোডিঙ্গারের তরঙ্গ ফাংশন আর হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি একাকার হয়ে যায়। কীভাবে হয়, সেটা জানতে হলে সুপারপজিশনের ব্যাপারটা ঝালিয়ে নিতে হবে আরেকবার।
পাঁচ
অনিশ্চয়তা নীতি বলছে, কখন আপনি একটা বস্তুর অবস্থান নিশ্চিত করে জানতে পারবেন। এর অর্থ আপনি চাইলে ইলেকট্রনকে কণা হিসেবে দেখতে পারবেন। আবার চাইলে একে তরঙ্গ হিসেবে দেখতে পারেন। সেজন্য আপনাকে আলাদা-আলাদা যন্ত্র ব্যবহার করতে হবে। ধরুন, আপনি ইলেকট্রনকে কনা হিসেবে দেখতে চান তখন ইলেকট্রনের তরঙ্গ ধর্ম অনিশ্চিত হয়ে যাবে। অর্থাৎ ইলেকট্রনের তরঙ্গ চরিত্র যখন ভেঙে পড়বে। আবার যখন তরঙ্গ পরিমাপক যন্ত্র দিয়ে ইলেকট্রনকে পর্যবেক্ষণ করবেন, তখন এর কণা ধর্ম অনিশ্চিত হয়ে যাবে। অর্থাৎ ভেঙে পড়বে। কিন্তু যখন পর্যবেক্ষণ করছেন না তখন ইলেকট্রন একই সঙ্গে কণা এবং তরঙ্গ। এই যে ইলেকট্রনের দ্বৈত অবস্থা, এটাই আসলে এর সুপারপজিশন।
এটাই একমাত্র সুপারপজিশন নয়। সুপারপজিশন পাবেন নীলস বোরের কোয়ান্টাম অ্যাটোমিক মডেল থেকেও। বোর বলেছিলেন, ইলেকট্রনেরা নির্দিষ্ট কিছু কক্ষপথেই থাকতে পারে, যে সব শক্তিস্তর কোয়ান্টায়িত।
ইলেকট্রনেরা যেমন শক্তি অর্থাৎ ফোটন শোষণ করে যেমন লাফ দিয়ে উচ্চশক্তিস্তরে যেতে পারে, তেমনি ফোটন বিকরণ করে নিম্নশক্তিস্তরে চলে আসতে পারে। এই দুই শক্তিস্তরের মাঝখানের সময়টুকুতে ইলেকট্রন কোথায় থাকে? বোর জবাব দিতে পারেননি, তবে অনেক পরে যখন কোয়ান্টাম সুপারপজিশনের ব্যাপারটা নিশ্চিত হয়, তখন জানা যায়, মাঝখানের সময় বলে কোনো সময় নেই। ইলেকট্রন যে মূহূর্তে একটা শক্তিস্তর থেকে লাফ দিচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তেই অন্য শক্তিস্তরে তার আবির্ভাব হচ্ছে। অর্থাৎ এক শক্তিস্তর থেকে অন্য শক্তিস্তরে যেতে ইলেকট্রনের কোনো সময় লাগছে না। আইনস্টাইন পরে যেটার নাম দিয়েছিলেন ‘স্পুকি অ্যাকশন টু ডিস্টেন্স’। তেমনি দুই শক্তিস্তরের মাঝখানে ইলেকট্রনের কোনো পথও নেই। এটা কীভাবে সম্ভব? সম্ভব কারণ সুপারপজিশনে থাকে ইলেকট্রনেরা। একটা পরমাণুর ভেতর কোয়ান্টায়িত সকল জায়গায়—অর্থাৎ সেগুলো কোয়ান্টাম দ্বারা অুনমোদিত—ইলেকট্রনেরা থাকে। কিন্তু আপনি সেখানেই পাবেন, যেখানে আপনি সেটাকে দেখতে চান। আর দেখতে চাইবেন যেখানে, সেখানে ইলেকট্রন থাকার জন্য এবং দেখতে পাওয়ার জন্য যেসব শর্ত প্রয়োজন, আপনি নিশ্চয়ই সেগুলোর সব পূরণ করবেন। ফলে ইলেকট্রন তখন সেখানে আপনাকে দেখা দেখে। সেখানে ψ-এর মান হবে ১। অর্থাৎ ১০০%। বাকি সব জায়গায় ইলেকট্রন তরঙ্গ ফাংশন কলাপ্স করবে বা ধসে যাবে। অর্থাৎ ψ-এর মান শূন্য হয়ে যাবে।
মোদ্দা কথা, আপনি যেখানে যখন ইলেকট্রনকে দেখতে চাইবেন, সেখানেই পাবেন, যখন কণা হিসেবে দেখতে চাইবেন তখন কণা হিসেবে দেখবেন, যখন যেখানে তরঙ্গ হিসেবে দেখতে চাইবেন, সেখানে তরঙ্গ হিসেবে পাবেন। আর এটা সম্ভব হচ্ছে, আপনি যখন যেখানে একে দেখতে চাইবেন, সেখানে সবটুকু ψ থাকার ব্যবস্থা করবেন, বাকি সব জায়গার ψ তখন ভেঙে পড়বে। কারণ একটা ইলেকট্রনের জন্য একটাই তরঙ্গ ফাংশন অর্থাৎ একটাই ψ। সেটাকে যখন একটা বিন্দুতে নিয়ে আসবেন অন্য কোনো বিন্দুতে তার থাকার সম্ভাবনা শূন্য হয়ে যাবে। অর্থাৎ তরঙ্গ ফাংশন ψ কলাপ্স করবে।
সূত্র: সায়েন্টিফিক আমেরিকান