নোবেল প্রাইজ হিসেবে বিশাল অঙ্কের টাকার সঙ্গে একটা ঝাঁ চকচকে সোনার মেডেল পান বিজ্ঞানীরা। সেই সোনা তরল হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু নোবেল তো চুরিও হতে পারে। চুরি যাওয়া সেই নোবেল সুপুত্তুরদের হাতে পড়লে সেটা যে আর আস্ত থাকবে না, তা বলাই বাহুল্য। সুপুত্তুরা সেটা গলিয়ে স্রেফ সোনার দরে বা তার চেয়েও কম দামে চোরা বাজারে বিক্রি করে ফেলবে।
২০০৪ সালে এশিয়ার প্রথম নোবেল, যেটা উঠেছিল বাঙালির গর্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে, সেটা বগলদাবার করেছিলেন এক চোর বাবাজি। তারপর খোঁজ--সারা দেশে, সারা দুনিয়ায় সাড়া পড়ে গেল। ‘হেন করেঙ্গা, তেন করেঙ্গা’ বলে ডন-বৈঠক দিয়ে মশা মারতে কামান দাগাতে শুরু করলেন ভারতবর্ষের পুলিশের দল। লাল বাজারের বুদ্ধিমান, চৌকস গোয়েন্দারা বললেন, নোবেল রহস্যের মীমাংসা করা সাধারণ পুলিশের কম্ম নয়। আমাদের এই লাল দালানের লালবাবুদের মগজাস্ত্রই পারে রবীন্দ্রনাথের নোবেল যথাস্থানে ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু ষোল বছর পেরিয়ে এসেও রবীন্দ্রনাথের চুরি যাওয়া সেই নোবেলের হদিস মেলেনি। নিশ্চয়ই সেটা গলিয়ে শরবত বানিয়ে গিলে ফেলে ফেলেছেন চোরা কারবারীরা! গলিত নোবেল আসলে ফেরত পাওয়া কঠিন। কিন্তু কাদের তৃষ্ণার জলের অভাব পূরণ করল রবিঠাকুরের নোবেল, সে রহস্যের কুল-কিনারাও করতে পারেননি লাল বাজারের বিখ্যাত সত্যান্বেষীরা।
রবীন্দ্রনাথের নোবেল গলানো হয়েছে কিনা কিংবা কোনো অ্যান্টিক সংগ্রাহক সেটাকে সিঁধেল চোর দিয়ে চুরি করিয়েছেন কিনা, সে রহস্যের কুল-কিনার আজও হয়নি। কিন্তু তরল সোনার নোবেল নিয়ে যে ইউরোপে ধুন্দুমার কাণ্ড ঘটে গিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, তা আজও হাস্যরসের খোরাক জুগিয়ে চলেছে বিজ্ঞানের ইতিহাসে।
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় ডেনিস বিজ্ঞানী নীলস বোরের হাতে দু-দুখানা নোবেল আসে। না, সুইডেনের নোবেল কমিটি এই নোবেল দুটি বোরকে দেননি। নোবেল তিনি আগেই পেয়েছিলেন। এই দুখানা নোবেল আসে জার্মানি থেকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজছে তখন। হিটলারের প্রচণ্ড রাগ ইহুদিদের ওপর। যেখানে ইহুদি পাচ্ছে ধরে ধরে মেরে ফেলছে নাৎসি বাহিনী। এমনকি নিজ দেশ জার্মানির বিজ্ঞানীরাও রেহাই পাচ্ছে না তাদের হাত থেকে। আলবারর্ট আইনস্টাইন ইহুদি ছিলেন। হিটলারের ভয়ে তিনি পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। যুদ্ধের ডামাডোলে আটকা পড়েন দুই আরও পদার্থবিজ্ঞানী ম্যাক্স ফন লাউ (মতান্তরে লিউ বা লু) ও ম্যাক্স ফ্রাঙ্ক। দুজনই নোবেল পেয়েছেন। দুজনই ইহুদি। নোবেল দেওয়া হয় সুইডেন থেকে। সুইডেন আবার হিটলারের শত্রু দেশ। শত্রুদের কাছ থেকে তাঁর দেশের দুই ইহুদি বিজ্ঞানী নোবেল নিয়েছেন! হিটলার সেটা মুখ বুজে সহ্য করবেন কেন। লু আর ফ্রাঙ্ককে ধরার জন্য কোমর বেঁধে নেমে পড়ল নাৎসি বাহিনী। অন্যদিকে বিজ্ঞানীদ্বয় ভাবলেন, ধরা পড়লে নির্ঘাত মরতে হবে। সেই সঙ্গে নোবেল প্রাইজটাও কেড়ে নিয়ে নষ্ট করে ফেলবে হিটলারের সৈন্যরা। তাঁরা নিজেদের চেয়ে নোবেল প্রাইজ নিয়েই বেশি চিন্তিত হয়ে পড়লেন। প্যাকেটে ভরে মেডেল দুটো পাঠিয়ে দিলেন ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে। বন্ধু নীলস বোরের কাছে।
বোর মেডেল দুটো যত্ন করে লুকিয়ে রাখলেন। কিন্তু বেশি দিন নয়। কারণ, নাৎসি বাহিনী ডেনমার্কেও হামলা করেছে। যেকোনো সময় বোরের গবেষণাগারেও হামলা চালাতে পারে। তখন মেডেল দুটো বাঁচানোই মুশকিল হবে। বোর প্রথমে ভাবলেন, মেডেল দুটো মাটিতে পুঁতে রাখবেন। কিন্তু নাৎসিদের বিশ্বাস নেই। ওরা ঠিক মাটি খুঁড়ে বের করে ফেলবে। বোরের এক সহকারী ছিলেন। হাঙ্গেরিয়ান রসায়নবিদ জর্জ হাভেসি। তিনি বোরকে বুদ্ধি দিলেন সোনাগুলো গলিয়ে তরল করে ফেলতে। যে-সে তরলে সোনা গলে না। সোনা গলাতে লাগে রাজ অম্ল বা অ্যাকোয়া রেজিয়া। অত্যন্ত শক্তিশালী অ্যাসিড। বোর আর হাভাসি তখন মডেল দুটো অ্যাকোয়া রেজিয়ার ভেতর ফেলে গলিয়ে ফেললেন। সোনা আর অ্যাসিড মিশে তখন হলুদ রঙের এক তরলে পরিণত হয়েছে। বোর সেই হলুদ তরল একটা বোতলে ভরে রেখে দিলেন আলমারিতে।
শেষশেষ বিজ্ঞানীদের আশঙ্কাই বাস্তবে রূপ নিল। হিটলারের নাৎসি বাহিনী রে রে করে তেড়ে এলো ডেনমার্কেও। আক্রান্ত হলো রাজধানী ডেনমার্কও। সুতরাং পাততাড়ি ফেলে বোর-হাভেসিও পারিয়ে বাঁচলেন। পড়ে রইল তাঁদের সাধের ল্যাবরেটরি। আর সেই ল্যাবরেটরি একোকোণে জীর্ণ এক তাকে পড়ে রইল দুবোতল হলদে তরল।
শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে হিটলার হেরে যান। বোর আর হাভেসি আবার কোপেনহেগেনে ফিরে আসেন। তাঁদের ল্যাবরেটরি লন্ডভন্ড করে রেখে গেছে নাৎসি সৈন্যরা। কিন্তু আলমারির কোণে সেই হলুদ তরলের বোতল একেবারে অক্ষত! মাথামোাটা নাৎসিরা ওর মর্ম কী বুঝবে! পরে নীলস বোরের ছেলে অ্যাগেই বোর অ্যাকোয়া রেজিয়া থেকে আবার সোনাগুলো পুনরুদ্ধার করেন। নীলস বোর সেই সোনা পাঠিয়ে দেন সুইডেনের নোবেল কমিটির কাছে।
নোবেল কমিটি সেই সোনা নিয়ে আবার ঘষামাজা করে, কারগির দিয়ে নতুন করে তৈরি করে পুরোনো নোবেল। হুবহু আগের মতো করে তৈরি সেই নোবেল পাঠিয়ে দেয় বোরের কাছে। যথা সময়ে সে দুটো পৌঁছে গেল লাউ আর ফ্রাঙ্কের কাছে।
সূত্র: নোবেল প্রাইজ ডট অর্গ, ফিজিকস ওয়ার্ল্ড