বঙ্গুবন্ধু ১ স্যাটেলাইটের উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে আক্ষরিক অর্থেই মহাকাশের দিকে একধাপ পা বাড়াল বাংলাদেশ। কীভাবে উৎক্ষেপণ হলো এই স্যাটেলাইট, এর কারিগরি দিকই বা কেমন, এই স্যাটেলাইট থেকে আমরা কী সুবিধা পাব?
প্রাচীন যুগেই মানুষ জেনে গিয়েছিল চাঁদ পৃথিবীর উপগ্রহ। কিন্তু পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের ধারণায় গ্রহ-উপগ্রহের ফারাক করা মুশকিল ছিল। মধ্যযুগে পোলিশ জ্যোতির্বিদ কোপার্নিকাস বললেন, পৃথিবীসহ সব গ্রহই সূর্যের চারপাশে ঘোরে, পৃথিবীর চারপাশে নয়। তখনই অনেকটা নিশ্চিত হওয়া গেল চাঁদই পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ। এরপর ইতালিয়ান বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি মহাকাশ চিনিয়েছেন আরও স্পষ্টভাবে। তিনি সুদূর বৃহস্পতিকে দেখেছেন নিজের তৈরি টেলিস্কোপে চোখ রেখে। আবিষ্কার করেছেন গ্রহরাজের চারটি উপগ্রহ। তখনই মূলত উপগ্রহ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা তৈরি হয় বিজ্ঞানীদের কাছে। একটা গ্রহকে কেন্দ্র করে এর চারপাশে যেসব বস্তু ঘোরে, সেগুলোই হলো ওই গ্রহের উপগ্রহ। চাঁদ তেমনি পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ। প্রতিটি উপগ্রহের একটা বহির্মুখী গতিশক্তি থাকে। যেমন চাঁদের একটা বহির্মুখী গতিশক্তি আছে। এই গতিশক্তির কারণে সে পৃথিবী থেকে দূর মহাকাশে ছুটে যেতে চায়। কিন্তু পৃথিবীর মহাকর্ষীয় আকর্ষণ বল চাঁদকে সেটা করতে দেয় না। বরং এই মহাকর্ষ বল চাঁদকে পৃথিবীর বুকে টেনে আনতে চায়। চাঁদের গতিশক্তিজনিত বহির্মুখী বল আর পৃথিবীর মহাকর্ষ বল সমান। তাই এ দুই বল কেউ কাউকে হারাতে পারে না। তাই চাঁদও পৃথিবীর বুকে নেমে আসে না, অন্যদিকে চাঁদের গতিশক্তিজনিত বলও একে দূর মহাকাশে ঠেলে দিতে পারে না। এ দুই বলের টানাটানিতে চাঁদ শেষ পর্যন্ত কোনো দিকেই না গিয়ে পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে। এটাই হলো প্রতিটি গ্রহ-উপগ্রহের কক্ষপথে ঘোরার রহস্য।
চাঁদ তো প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়েছে। এখন যদি কৃত্রিম কোনো বস্তুকে আমরা পৃথিবীর কক্ষপথে স্থাপন করি। প্রথমে সেগুলোকে একটা গতিশক্তি দিতে হবে। রকেটের মাধ্যমে কৃত্রিম উপগ্রহে সেই গতিশক্তি দেওয়া সম্ভব। তারপর সেই বস্তুটাকে এমন একটা গতিশক্তি দিতে হবে, যেন তার গতিশক্তিজনিত বল পৃথিবীর মহাকর্ষ বলের সমান হয়। এ জন্য প্রয়োজন একটি কক্ষপথ। আর সেই কক্ষপথেই ওই বস্তুটা স্থাপন করলে সেটা উপগ্রহের মতো আচরণ করবে। এ জন্যই সেটাকে কৃত্রিম উপগ্রহ বলে। মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে কিছু ইলেকট্রনিকস যন্ত্র তৈরি করে পৃথিবীর চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে। সেগুলো আসলে কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইট। কৃত্রিম উপগ্রহ যদি পৃথিবীর কাছাকাছি তিন শ থেকে হাজার কিলোমিটারের মধ্যে থাকে, তবে পৃথিবীর ওপর আছড়ে পড়বে। কিন্তু যদি একটি শক্তি দিয়ে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে সর্পিল আকারে পাক খেতে খেতে পৃথিবীর দিকে আসতে থাকবে। এতে আছড়ে পড়তে সময় অনেক কম লাগবে। পৃথিবীর যত কাছাকাছি আসবে, আছড়ে পড়ার গতি তত বাড়তে থাকবে। এই আছড়ে পড়া ঠেকাতে হলে উল্টো দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য থ্রাস্টার যোগ করা হয়। এই যেমন ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন, আমাদের চারপাশে ৪০০ কিলোমিটার ওপর দিয়ে ঘুরছে, কিন্তু থ্রাস্টার দিয়ে আছড়ে পড়া ঠেকানো হয়েছে।
ইতিমধ্যে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি একটি ন্যানো-স্যাটেলাইট মহাশূন্যের লো আর্থ অরবিটে অবস্থান করছে। সেটার নাম ব্র্যাক অন্বেষা। ২০১৭ সালের জুন মাসে এটিকে ফ্যালকন-৯ রকেটে করে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে পাঠানো হয়। সে বছরের জুলাইয়ে মহাশূন্যে সেটা সক্রিয় হয়।
এতক্ষণ যা বলা হলো, তা সবই হলো পোলার অরবিটিং, অর্থাৎ চলন্ত স্যাটেলাইট নিয়ে। এবার আসা যাক জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট বা ভূস্থির উপগ্রহের ব্যাপারে। ভূস্থির স্যাটেলাইট পৃথিবীর সাপেক্ষে কখনো অবস্থান পরিবর্তন করে না। পৃথিবী যেভাবে ঘুরছে, সেগুলোও পৃথিবীর সাপেক্ষে একই গতিতে ঘুরছে। তার মানে, যদি কোনো স্যাটেলাইটকে বাংলাদেশের ওপর স্থাপন করা হয়, তাহলে সেটি সব সময়ই বাংলাদেশের ওপরই অবস্থান করছে বলে মনে হবে, চাঁদের মতো অবস্থান পরিবর্তনশীল মনে হবে না।
আমাদের বঙ্গবন্ধু-১ উপগ্রহটিও এমন ভূস্থির। এটি পৃথিবী থেকে প্রায় ৩৬ হাজার কিলোমিটার উচ্চতায় স্থির থেকে পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগের কাজ করবে। আমাদের প্রয়োজনে বিভিন্ন ধরনের কৃত্রিম স্যাটেলাইট তৈরি করা হয়েছে। যেমন পৃথিবী পর্যবেক্ষণ, আবহাওয়ার খবর নেওয়া, অবস্থান নির্ণয় ইত্যাদি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট তৈরি হয়েছে যোগাযোগ ও টিভি-বেতার সম্প্রচারে সহায়তার উদ্দেশ্যে। আমরা জানি, যোগাযোগ বা তথ্য আদান-প্রদান হয় বিভিন্ন মাপের বিদ্যুত্চুম্বক তরঙ্গ দিয়ে। এই তরঙ্গ প্রেরণ বা গ্রহণের জন্য অ্যানটেনার প্রয়োজন। তাই এই স্যাটেলাইট ভূপৃষ্ঠের গ্রাউন্ড স্টেশনের দিকে তাক করে স্থাপন করা হবে। এ জন্য থাকবে ডিশ আকৃতির কতগুলো অ্যানটেনা। তেমনি ভূপৃষ্ঠের গ্রাউন্ড স্টেশনের অ্যানটেনাগুলোও উপগ্রহের দিকে তাক করা থাকতে হবে।
যেহেতু তরঙ্গ বিভিন্ন মাপের হয়, আবার বিভিন্ন ধরনের তরঙ্গ বিভিন্ন ধরনের তথ্য বহন করে, তাই অ্যানটেনার সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয় ট্রান্সসিভার যন্ত্র, তরঙ্গের বিচ্যুতি দূর করার জন্য ফিল্টার, তথ্যের নিরাপত্তার জন্য এনক্রিপ্টর-ডেক্রিপ্টর, দুর্বল সিগন্যালকে শক্তিশালী করার জন্য পাওয়ার অ্যামপ্লিফায়ার ইত্যাদি। এই সবকিছু পরিচালিত হয় জটিল সব ইলেকট্রনিকস যন্ত্রপাতি ও সফটওয়্যার দিয়ে। স্যাটেলাইটের যোগাযোগের এই যন্ত্রপাতি ও সফটওয়্যারের সমন্বয়কে বলা হয় ট্রান্সপন্ডার। আমাদের বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটে এ ধরনের উচ্চগতির ৪০টি আলাদা ট্রান্সপন্ডার রয়েছে। এর মধ্যে ২৬টি কেইউ ব্যান্ডের আর ১৪টি সি ব্যান্ডের। এই ট্রান্সপন্ডার দিয়ে বাংলাদেশসহ আমাদের আশপাশের দেশগুলোও বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের টেলিকমিউনিকেশন সেবা পাবে। যেহেতু এটি একটি বাণিজ্যিক স্যাটেলাইট, কাজেই এর সেবা ভোগ করতে হলে আর্থিক বিনিয়োগ করতে হবে। আমাদের এই স্যাটেলাইট তৈরি করেছে ফ্রান্সের কোম্পানি থ্যালাস অ্যালানিয়া।
এ তো গেল স্যাটেলাইটের তথ্য। কিন্তু এই স্যাটেলাইট স্থাপন করতে হলে একটি রকেটের মাধ্যমে এটিকে ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩৬ হাজার কিলোমিটার উচ্চতায় মহাশূন্যে নিয়ে যেতে হবে। ইলেন মাস্কের স্পেসএক্স কোম্পানির তৈরি অত্যাধুনিক ফ্যালকন-৯ ব্লক-৫ রকেট দিয়ে আমাদের বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট স্পেসে উৎক্ষেপণ করা হবে। ব্লক-৫ হলো ফ্যালকন-৯-এর সর্বশেষ সংস্করণ। এর ক্ষমতা আগেরগুলোর তুলনায় অনেক বেশি, অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য ও সাশ্রয়ী। এই রকেটের মূলত তিনটি অংশ থাকে। একদম নিচেরটাকে বলে স্টেজ-১ বা বুস্টার স্টেজ। এটা মূলত লিফটঅফ বা ভূপৃষ্ঠ থেকে উৎক্ষেপণ করানোর কাজে ব্যবহৃত হয়। মুক্তিবেগের মাধ্যমে মূল অভিকর্ষজ ত্বরণ কাটিয়ে বঙ্গবন্ধু-১-কে লো আর্থ অরবিটে উঠিয়ে নিয়ে যাবে এটা। এরপর দ্বিতীয় স্টেজের ধাক্কায় জিওসিনক্রোনাস ট্রান্সফার অরবিটের পথ পড়ি দেবে। জিওসিনক্রোনাস ট্রান্সফার অরবিট অতিক্রমের সময়ই খুলে যাবে ড্রাগন ক্যাপসুল। তখন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উন্মুক্ত হয়ে ফ্যালকন-৯ রকেট থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যাবে। ফ্যালকন-৯ থেকে ডেপ্লয়মেন্টের পর এর নিয়ন্ত্রণ চলে আসবে এটার নির্মাতা থ্যালাস অ্যালানিয়ার হাতে। থ্যালাস অ্যালানিয়ার ফ্রান্সের কানে স্থাপিত গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে নিয়ন্ত্রণ করে আস্তে আস্তে জিওসিনক্রোনাস ট্রান্সফার অরবিট থেকে ৩৫ হাজার ৭৯০ কিলোমিটার উচ্চতার জিওস্টেশনারি অরবিটের দিকে নিয়ে যাবে। ৩৫ হাজার ৭৯০ কিলোমিটার থেকে বেশি উচ্চতার নিরক্ষীয় রেখার ওপর অবস্থিত স্যাটেলাইটের কক্ষপথগুলোকে বলা হয় জিওস্টেশনারি অরবিট। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের জন্য নির্ধারিত কক্ষপথ হলো ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রি উত্তর। গ্লোবাল পজিশন সিস্টেমে বাংলাদেশের অবস্থান ৯০ ডিগ্রি উত্তরে। তার মানে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হলে বাংলাদেশে স্থাপিত অ্যানটেনাগুলোকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ৩০ ডিগ্রি বাঁকা করে রাখতে হবে। আমরা যদি ভূপৃষ্ঠের সঙ্গে ধরি, তাহলে আমাদের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটটি ইন্দোনেশিয়ার ঠিক ওপরে অবস্থান করবে।
গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে স্যাটেলাইটকে ওই কক্ষপথে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি সহজ নয়। একজন অন্ধ লোককে শুধু মোবাইলে নির্দেশনা দিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার মতোই কঠিন। ভূপৃষ্ঠ থেকে কোনো একদিকে যাওয়ার কমান্ড স্যাটেলাইটকে পাঠানো হবে। স্যাটেলাইট সেই অনুযায়ী প্রপেলার পরিচালনা করে যেতে থাকবে। আর গ্রাউন্ড স্টেশনকে জানাতে থাকবে কতটুকু এগোল। এভাবে খুব ধীরে স্যাটেলাইটে জমানো জ্বালানি পুড়িয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে যাওয়া হবে। এটা অত্যন্ত ধীরগতির প্রক্রিয়া।
জিওসিনক্রোনাস ট্রান্সফার অরবিট থেকে আমাদের জন্য নির্ধারিত ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রি উত্তর দ্রাঘিমায় স্থাপন করা হবে। এর জন্য সময় লাগবে ৮ থেকে ১০ দিন। কক্ষপথে স্থাপনের পর এই স্যাটেলাইটের নিয়ন্ত্রণ শুরু হবে বাংলাদেশের গাজীপুরে স্থাপিত গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে। এই গ্রাউন্ড স্টেশন থেকেই প্রায় এক মাস ধরে কিছু ইন অরবিট টেস্ট করা হবে (IOT)। এরপরই এটি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করার উপযোগী হয়ে উঠবে।
গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে দুইভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে উপগ্রহটিকে। একটি হবে ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ, আরেকটি হবে কমিউনিকেশন নিয়ন্ত্রণ। ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ হবে মূলত স্বয়ংক্রিয়ভাবে, কিন্তু মাঝেমধ্যে গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হতে পারে।
এটা বাণিজ্যিক উপগ্রহ। কাজেই কাকে কতটুকু ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দ করা হয়েছে, কী ধরনের এনক্রিপশন ব্যবহার করা হয়েছে, এসব পর্যবেক্ষণ করা হবে গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে। তবে ২৪ ঘণ্টা সিগন্যালের শক্তি পর্যবেক্ষণ করে ঠিক রাখাই হবে গ্রাউন্ড স্টেশনের মূল কাজ। মূলত দুই ধরনের বাণিজ্যিক কাজে আমাদের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ব্যবহৃত হবে—টেলিভিশন সম্প্রচার আর টেলিকমিউনিকেশন। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো তাদের অনুষ্ঠানমালাকে ট্রান্সমিটার আর ডিশ অ্যানটেনা দিয়ে প্রেরণ করবে উপগ্রহের দিকে। প্রায় ৩৬ হাজার কিলোমিটার পাড়ি দেওয়া সেই সিগন্যালে অপ্রয়োজনীয় ও অবাঞ্ছিত তরঙ্গ ঢুকে পড়তে পারে। উপগ্রহ সেগুলোকে ফিল্টার করবে, তারপর আবার এমপ্লিফাই করে সেই সিগন্যালকে পৃথিবীর দিকে প্রেরণ করবে কৃত্রিম উপগ্রহ। এবার স্যাটেলাইট টিভি ব্যবসায়ীরা তাঁদের ভিস্যাট অ্যানটেনা দিয়ে এই সিগন্যাল গ্রহণ করে তা আমাদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবেন। তবে এখন ক্ষুদ্রাকৃতির কিছু ডিশ অ্যানটেনা এসেছে। সেগুলো দিয়ে সরাসরি সেট-টপ বক্সের মাধ্যমে টিভিতে দেখতে পাই। এই সার্ভিসকে বলা হয় ডাইরেক্ট টু হোম (DTH)।
স্যাটেলাইট টিভি রিসিভারে এ ধরনের ডেক্রিপশনের অপশন রেখেই তৈরি করা হয়। টিভি স্টেশন থেকে কৃত্রিম উপগ্রহ ঘুরে আমাদের টিভিতে সিগন্যাল পৌঁছানো পর্যন্ত প্রায় ৭২ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। কিন্তু পুরো প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন হতে সময় লাগে মাত্র সেকেন্ডের তিন ভাগের এক ভাগ। স্যাটেলাইট ব্যবহার করে ইন্টারনেটের ডেটা আদান-প্রদানের কাজও প্রায় একই রকমভাবে হয়। এ ক্ষেত্রে দুই জায়গাতেই ট্রান্সিভার বা একই সঙ্গে আদান ও প্রদান দুটি কাজেরই উপযোগী যোগাযোগব্যবস্থা থাকতে হবে। স্যাটেলাইটের সঙ্গে যোগাযোগে সক্ষম যেকোনো কমিউনিকেশন সিস্টেমই এই স্যাটেলাইটের দৃষ্টিসীমানায় থাকা অন্য যেকোনো কমিউনিকেশন সিস্টেমের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হবে। সরকার যদি চায় স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বা হাসপাতালে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দূরশিক্ষণ বা টেলিচিকিত্সার প্রবর্তন করা সম্ভব এই উপগ্রহের মাধ্যমে। যদিও সেটা হবে অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কারণ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই একটি করে ভিস্যাট স্থাপন করতে হবে। স্যাটেলাইট কমিউনিকেশনের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো নিরবচ্ছিন্নতার নিশ্চয়তা ও বিস্তৃত কাভারেজ। আর সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো ব্যয়বহুল এবং ধীরগতি।
গাজীপুরের জয়দেবপুরে থ্যালাস অ্যালানিয়া কোম্পানির সহায়তায় মূল গ্রাউন্ড স্টেশনটি ইতিমধ্যে স্থাপিত হয়েছে। এখান থেকেই এই সমস্ত কমিউনিকেশন ও নিয়ন্ত্রণ করা হবে। একই রকম আরেকটি আপত্কালীন গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে রাঙামাটির বেতবুনিয়ায়। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের সার্ভিসগুলো হলো ভিস্যাট অ্যানটেনা ব্যবহার করে ডাইরেক্ট টু হোম (DTH), টিভি সম্প্রচার এবং ইন্টারনেট সেবা পাওয়া যাবে। কাজেই এই উপগ্রহ বাংলাদেশের টেকনোলজির ইতিহাসে এক অনন্য উদাহরণ হতে যাচ্ছে।
স্যাটেলাইট হলো প্রযুক্তির সর্বোচ্চ চূড়া। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট এবং ব্র্যাক অন্বেষা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে আমরা প্রযুক্তির উত্কর্ষের অভিজ্ঞতাই শুধু অর্জন করলাম তা নয়; প্রযুক্তির জ্ঞানও আমরা অর্জন করলাম। ভবিষ্যতে আরও স্যাটেলাইট বা অন্য যেকোনো প্রযুক্তি বিকাশে এই ভাবমূর্তি আমাদের ভীষণ কাজে আসবে। আমাদের তরুণ প্রজন্ম শুধু এই প্রযুক্তির জ্ঞান আহরণ ও ব্যবহারে আগ্রহী হবে। সঙ্গে সঙ্গে তারা নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতেও বিরাট ভূমিকা রাখতে সমর্থ হবে। অন্যদিকে বিশ্বদরবারে একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হবে আমাদের। বিজ্ঞান ও প্রকৌশল প্রযুক্তির বাণিজ্যিক ব্যবহারকারী হিসেবে আজ আমরা এই প্রযুক্তির বাজারে প্রবেশ করছি। কিন্তু আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, একদিন আমরা স্যাটেলাইট, রোবটিকস, আইওটিসহ অন্যান্য উচ্চ প্রযুক্তির নির্মাতা হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াব। আমাদের সেই সক্ষমতা আছে, এখন দরকার আত্মবিশ্বাস ও প্রস্তুতি।