আধুনিক প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের এক অবিশ্বাস্য বিস্ময় স্যাটেলাইট। আমাদের দৈনন্দিন জীবন ও কাজের সঙ্গে স্যাটেলাইট প্রযুক্তি বেশ ঘনিষ্ট ভাবে জড়িত। কোনোই সন্দেহ নেই যে, স্যাটেলাইট ছাড়া সম্ভব হত না অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজই। কিন্তু জানেন কি স্যাটেলাইট কিভাবে কাজ করে? আসুন জেনে নেই।
স্যাটেলাইট জিনিসটা আসলে কী? এটি কি কাজই-বা করে ? স্যাটেলাইট কিভাবে কাজ করে?
স্যাটেলাইট শব্দটা এসেছে মূলত ল্যাটিন থেকে, যার ইংরেজি অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘অনুসরণ করা’। স্যাটেলাইট হল এমন একটি অবজেক্ট(বস্তু), যা আরেকটি বড় অবজেক্টকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করে।
এখন আপনার প্রশ্ন হতে পারে পৃথিবীও তাহলে একটি স্যাটেলাইট? উত্তর হল হ্যা, পৃথিবীও একটি স্যাটেলাইট। কারন সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে ঘুরছে পৃথিবী। ঠিক একইভাবে, চাঁদও একটি স্যাটেলাইট কারণ তা পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। কিন্তু এগুলো প্রাকৃতিক।
তবে সাধারণভাবে স্যাটেলাইট শব্দটি দিয়ে আমরা বুঝি মানুষ্য তৈরি স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ। এটি এমন যন্ত্র যা মহাশূণ্যে উৎক্ষেপণ করার পর, পৃথিবী বা মহাকাশে থাকা অন্য কোন বডিকে প্রদক্ষিণ করছে। মূলত মানুষ তার নানাবিধ কাজের জন্য বিজ্ঞানের উৎকর্ষতাকে কাজে লাগিয়ে মহাকাশে এ স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ প্রেরণ করে।
বর্তমানে মহাকাশে প্রায় (সরকারী-বেসরকারী) কয়েক হাজার কৃত্রিম বা মানুষের-তৈরী স্যাটেলাইট পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে। আর এ প্রত্যেকটি স্যাটেলাইট আলাদা আলাদা কাজে নিয়োজিত। এদের মধ্যে কোনোটি পৃথিবীর ছবি তুলে, আবার কোনোটি অন্যান্য গ্রহের ছবি সংগ্রহ করে। কোনোটা আবার আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিতে এবং হারিকেনের গতিপথের উপর নজর রাখতে আবহাওয়াবিদদের সহায়তা করে। পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের আভাস দিতেও সাহায্য করছে স্যাটেলাইট।
এদের মধ্যে কিছু স্যাটেলাইট আবার গ্রহ, সূর্য, কৃষ্ণবিবর বা দূরবর্তী ছায়াপথ এর ছবি নিতে কক্ষপথে ঘুরছে। এছাড়াও এমন কিছু উপগ্রহ রয়েছে যারা মূলত যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হয়; যেমন টিভি সিগন্যাল, বিশ্বজুড়ে ফোন কল এর সংযোগ স্থাপন, ইত্যাদি কাজে ব্যাবহার করা হয়।
আর ২০টিরও বেশী স্যাটেলাইট নিয়ে গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম বা জিপিএস গঠিত। আপনার কাছে যদি জিপিএস রিসিভার থাকে তাহলে এসব স্যাটেলাইট আপনার নির্ভুল অবস্থান সনাক্ত করতে সক্ষম।
কী কী অংশ নিয়ে স্যাটেলাইট গঠিত ?
স্যাটেলাইট বিভিন্ন আকার, আকৃতি ও আয়তনের হয়। তবে প্রত্যেক স্যাটেলাইটে সাধারণত ২টি অংশ থাকে। অ্যান্টেনা এবং শক্তির উৎস (পাওয়ার সোর্স)।
অ্যান্টেনা: তথ্য গ্রহণ ও সংগ্রহের কাজ করে অ্যান্টেনা। অ্যান্টেনা মূলত পৃথিবী থেকে তথ্য আদান প্রদান করে। বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টেনা রয়েছে যেমন-মনোপোল, ডিপোল হর্ণ, প্রতিফলক, পারাবোলিক, মাইক্রোস্ট্রিপ ইত্যাদি। মূলত স্যাটেলাইটে ব্যবহৃত অ্যাপ্লিকেশনের উপর নির্ভর করে অ্যান্টেনার ধরণ।
সৌর কোষ এবং ব্যাটারি ব্যাকআপ: শক্তির উৎস হিসেবে সোলার প্যানেল এবং ব্যাটেরি থাকে। সোলার প্যানেলগুলি বিদ্যুতের মধ্যে সূর্যালোক বাঁক করে শক্তি তৈরি করে। স্যাটেলাইটে চলমান রাখার জন্য সোলার সেল এবং ব্যাটারির অত্যধিক প্রয়োজন। সূর্যালোকের উপস্থিতিতে শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে সোলার সেল। আর যদি সূর্যালোক না থাকলে ব্যাটারি শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে। নাসার অনেক স্যাটেলাইটগুলো ক্যামেরা ও বৈজ্ঞানিক সেন্সর বহন করে।
কিভাবে স্যাটেলাইট পাঠানো হয় এবং পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে?
বেশীর ভাগ স্যাটেলাইটকে রকেট বা স্পেস শাটলের কার্গো বে-এর মাধ্যমে কক্ষপথে পাঠানো হয়। পৃথিবীর অভিকর্ষ পার হতে রকেটকে ঘণ্টায় ২৫ হাজার ৩৯ মাইল ত্বরণে ছুটতে হয়। পৃথিবীর টান ও মাধ্যাকর্ষণ শক্তির মধ্যে যখন ভারসাম্য তৈরী হয় তখনই কোন স্যাটেলাইট প্রদক্ষিণ করতে পারে।
কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপনের সময় কক্ষীয় গতি ও তার জড়তার ওপর পৃথিবীর অভিকর্ষের যে প্রভাব রয়েছে, এই ভারসাম্য ছাড়া স্যাটেলাইট মহাশূণ্যে একটি সরল রেখায় উড়বে অথবা পৃথিবীতে পতিত হবে। এ জন্য কৃত্রিম উপগ্রহকে ১৫০ মাইল উচ্চতাবিশিষ্ট কক্ষপথে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১৭ হাজার মাইল গতিতে পরিভ্রমণ করানো হয়।
মূলত গতিবেগ কত হবে, তা নির্ভর করে কৃত্রিম উপগ্রহটি পৃথিবী থেকে কত উচ্চতায় রয়েছে, তার ওপর। পৃথিবী থেকে ২২ হাজার ২২৩ মাইল উপরে স্থাপিত স্যাটেলাইট ঘণ্টায় ৭০০ মাইল বেগে পৃথিবীকে আবর্তন করে। পৃথিবীর সঙ্গে কৃত্রিম উপগ্রহগলোও ২৪ ঘণ্টা ঘোরে। টিভি ও বেতারসংকেত প্রেরণ এবং আবহাওয়া পর্যবেক্ষণকারী কৃত্রিম উপগ্রহগুলো সাধারণত পৃথিবী থেকে ৩৬ হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থান করে।
স্যাটেলাইটগুলো ভিন্ন ভিন্ন উচ্চতা, গতি ও পথে প্রদক্ষিণ করে। তবে দুটি কমন কক্ষপথ হলো- জিওস্টেশনারী এবং পোলার।
জিওস্টেশনারী স্যাটেলাইট বিষুব রেখার উপর দিয়ে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ভ্রমণ করে। পৃথিবীর ঘূর্ণনের সাথে তাল রেখে এ স্যাটেলাইট একই দিকে অগ্রসর হয় বলে পৃথিবী থেকে মনে হয় জিওস্টেশনারী স্যাটেলাইট একই স্থানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
পোলার স্যাটেলাইট উত্তর থেকে দক্ষিণ অভিমুখে এক মেরু থেকে আরেক মেরুতে ভ্রমণ করে। পৃথিবী নিচের দিকে ঘোরে বলে এইসব স্যাটেলাইট দিয়ে একই সময়ে পুরো পৃথিবীর চিত্রধারণ সম্ভব হয়।
স্যাটেলাইটগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ হয় না কারণ, একটি স্যাটেলাইট যেন অন্য স্যাটেলাইটকে এড়িয়ে চলতে পারে সেজন্য উৎক্ষেপণের সময় তা নিশ্চিত করেই কক্ষপথে স্থাপন করা হয়। তবে নাসা এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা স্যাটেলাইটের গতিপথের উপর নজর রাখে। ফলে সংঘর্ষ হয় না বললেই চলে। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে মহাশূণ্যে দুটি আমেরিকান ও রাশিয়ান স্যাটেলাইটের মধ্যে সংঘর্ষ হয় যা মানুষের তৈরি স্যাটেলাইটের মধ্যে প্রথম সংঘর্ষের ঘটনা।
কিভাবে কাজ করে স্যাটেলাইট?
পৃথিবী থেকে বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করে তথ্য পাঠানো হয়, কৃত্রিম উপগ্রহ সেগুলো গ্রহণ করে এবং বিবর্ধিত (এমপ্লিফাই) করে পৃথিবীতে পুনরায় প্রেরণ করে। কৃত্রিম উপগ্রহ দুইটি ভিন্ন কম্পাঙ্কের তরঙ্গ ব্যবহার করে সিগনাল (তথ্য) গ্রহণ এবং পাঠানোর জন্য। কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে পৃথিবীতে আসা সিগনাল অনেক দুর্বল বা কম শক্তিসম্পন্ন হয়ে থাকে, তাই প্রথমে ডিস এন্টেনা ব্যবহার করে সিগনালকে কেন্দ্রীভূত করা হয় এবং পরে রিসিভার দিয়ে গ্রহণ করে প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করা হয়।
- শাকিল আহমেদ