সময়ের হিসেব রাখার সবচেয়ে সহজ উপায় প্রকৃতি-পর্যবেক্ষণ। চাঁদের দশা, সূর্যের অবস্থান, ঋতুচক্র- এসব কিছুর উপর ভিত্তি করে ঘড়ি ও পঞ্জিকা নির্ধারণ করা হয়। সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে সূর্যঘড়ি, জলঘড়ি, যান্ত্রিক ঘড়ি আর পারমাণবিক ঘড়ির মতো প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু হয়, সময়ের হিসেব নিখুঁত হতে থাকে। কিন্তু আমরা যে সময় পরিমাপ করছি, সেটি আসলে কী?
সময়ের অস্তিত্ব আসলেই কি আছে, না-কি এটি আমাদের মস্তিষ্কের খেয়াল? এ প্রশ্নের জবাব আবশ্যিক- "সময়ের অস্তিত্ব সর্বত্র বিরাজমান আর এর অনুপস্থিতিতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে কল্পনা করা শক্ত।" কিন্তু সময় সম্পর্কে আমাদের ধারণা বর্তমানে জটিল হয়ে গেছে, আর এটি সম্পূর্ণ বিজ্ঞানী আলবার্ট আইন্সটাইনের অবদান। তাঁর সূত্র অনুযায়ী, সময় সকলের জন্যই চলমান, কিন্তু বিভিন্ন পরিস্থিতি সাপেক্ষে সকলের জন্য সমানভাবে গতিশীল না। একজন ব্যক্তি আলোর গতির কাছাকাছি বেগে চললে তার সাপেক্ষে সময়ের পরিভ্রমণ কৃষ্ণ-গহ্বর (Black Hole) প্রদক্ষিণরত একজন মানুষের সময় থেকে ভিন্ন। সময়ের সাথে স্থানের (space) সমন্বয় ঘটিয়ে তিনি স্থান-কালের (Space-time) ধারণা জন্ম দেন, সেখান থেকেই এ সূত্র প্রতিপাদ্য। স্থান-কাল বেঁকে বসতে পারে (যার কারণেই বস্তু পরস্পরকে আকর্ষণ করে), আইন্সটাইন সেটাকেও পরিমাপযোগ্য করে তুলেন। তাঁর সূত্র এটিই প্রমাণ করে, মহাবিশ্ব আসলে স্পেস-টাইমের জালে জড়িয়ে আছে।
তারপরও একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, "আমরা কেন ইচ্ছানুসারে যেকোনো স্থানেই যেতে পারি, কিন্তু সময়ের মধ্য দিয়ে পরিভ্রমণকালে একটি ডিরেকশনেই যেতে বাধ্য?" সহজ ভাষায়, সময়ের ব্যবধানে আমরা ভবিষ্যতের দিকে যত এগোই, অতীত পেছনেই পরে থাকে। অথচ উত্তর দিকে এগোলে দক্ষিণ দিকে যাওয়া কোনো ব্যাপার না। স্থান ও কাল যখন একই সত্তা, এ দুয়ের সমন্বয়ই যখন মহাবিশ্বের সাজপোশাক তৈরি; তাহলে স্থান ও কালের বৈশিষ্ট্য বিপরীতমুখী কেন? একে বলে "Arrow of time."
আপনি একটি ড্রপার থেকে গ্লাসভর্তি পানিতে এক ফোঁটা রঙ ফেললেন। কিছুক্ষণ পরেই তা পানিতে মিশে যাবে। যদি বিপরীত ঘটনা চিন্তা করেন, তাহলে রঙিন পানি থেকে রঙ উঠে ড্রপারে জমা হবে। অর্থাৎ সময়ের ডিরেকশন উলটে যাবে। আমরা এমন এক বিশ্বে বাস করি, যেখানে প্রথম ঘটনা ঘটে। পদার্থবিজ্ঞানে এ-কে বলা হয়, "সেকেন্ড ল অফ থারমোডায়নামিক্স।"এ সূত্র অনুযায়ী, সময়ের ব্যবধানে আমাদের পরিচিত বিশ্ব বিশৃঙ্খলিত হয়ে পড়বে। Arrow of time এর ডিরেকশন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এ বৈশিষ্ট্য থেকেই নির্ণয় করা হয়। সময় যদি এরকম মৌলিক বিষয় হয়, এর ব্যাখাও সবচেয়ে মৌলিক পর্যায়ের সমীকরণে থাকার কথা, তাই না?
পদার্থবিজ্ঞান রাজত্ব করে দুটি সমীকরণ: আপেক্ষিক তত্ত্ব বিশালাকার বস্তু যেমন গ্রহ-নক্ষত্র, কৃষ্ণ-গহ্বর ইত্যাদির অবস্থান, গতিপথ ব্যাখা করে। আবার, কোয়ান্টাম ফিজিক্স ক্ষুদ্রাকার কণা; অণু-পরমাণু ইত্যাদির গঠন ও আচরণ ব্যাখা করে। গত ৫০-৬০ বছর ধরে পদার্থবিদদের লক্ষ্য ছিল এ দুটোর সমন্বয় ঘটিয়ে "থিওরি অফ এভরিথিং" এ রূপ দেওয়া।
এরকম অনেক তত্ত্বই প্রণিত হয়েছে, একটিও প্রমাণিত হয়নি। সময় সম্পর্কে এদের প্রত্যেকের ধারণা একে অপরের থেকে ভিন্ন। যেমন "হুইলার ডিইউট" তত্ত্বে সময়ের উল্লেখ পর্যন্ত নেই! এরকম কোনো তত্ত্ব যদি প্রমাণিত হয়, তার মানে কি এই, সময়ের অস্তিত্ব নেই? সময় কী তাহলে মহাবিশ্বকে উপলব্ধি করার উপায়ে থাকা সীমাবদ্ধতা থেকে সৃষ্ট হেঁয়ালি? বোধহয় এভাবে চিন্তা করাই অনুচিত। আমাদের এভাবে ভাবা উচিৎ, মৌলিক ধর্ম হিসেবে সময়ের অস্তিত্ব নেই, কিন্তু "ইমার্জেন্ট প্রোপার্টি" হিসেবে এটি বিদ্যমান। একটি সিস্টেমে একক হিসেবে থাকে না, বরং সিস্টেমের জন্য সমগ্র হিসেবে থাকে, এরকম জিনিসই ইমার্জেন্ট বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। (Things that do not exist in a system as an individual, rather exist for the system as a whole)
একটি ভিডিয়ো চিত্রে একেকটি ফ্রেম থাকে, স্থির ফ্রেমগুলো সময় নির্দেশ করে না। কিন্তু খুব দ্রুততার সাথে ফ্রেমগুলো পর্দায় দেখানো হলে মনে হবে চিত্রে থাকা ঘটনাবলি সময়ের সাথে সাথে নড়ছে। আমাদের মস্তিষ্কের কাছে মুভমেন্টটা সত্যি, আবার হেঁয়ালিও বটে। সময়ও কি একইরকম হেঁয়ালি বা ইলিউশন? আইন্সটাইনের মতে হয়তো তাই, কিন্তু আজও আমরা সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা থেকে অনেক দূরে।