প্রথমে মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার কাকে বলা হয়?
~~মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার (Multiple Personality Disorder) বা বহুব্যক্তিত্ব মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে একটি মানসিক রোগ যা রোগীর ব্যক্তিত্বে দ্বৈততা আনয়ন করে থাকে। ফলে একে দ্বৈতসত্তাজনিত সমস্যাও বলা হয়ে থাকে। রোগী নিজের স্মৃতি, ব্যক্তিত্ব ও বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলে সাময়িককালের জন্য পরিচিত অথবা সম্পূর্ণ অলীক কোন স্মৃতি, ব্যক্তিত্ব বা বৈশিষ্ট্য ধারণ করে থাকে। একাধিক ব্যক্তিত্বের বেলায় এই রোগকে বর্তমানে Dissociative Identity Disorder বলা হয়।
ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিসর্ডার আক্রান্ত ব্যক্তির জীবনে ঘটা কোনও ট্রমা থেকে বা কোন মারাত্মক ঘটনা থেকে সুত্রপাত হয় বলে মনে করা হয়। আক্রান্ত ব্যক্তির আচরণের এই দিকটি মস্তিষ্কে তাদের প্রতিরক্ষা মূলক আচরণ ব্যবস্থা হিসাবে কাজ করে। ব্যক্তি আক্ষরিকভাবে নিজেকে এমন পরিস্থিতি বা অভিজ্ঞতা থেকে বিরত বা বিচ্ছিন্ন করে দেয় যা তার পক্ষে মেনে নেওয়া অত্যন্ত বেদনাদায়ক।
♦️রোগের লক্ষণ ♦️
Dissociative Identity Disorder-এর রোগীদের মাঝে বেশ কিছু অন্যান্য মানসিক সমস্যাও দেখা যায়। এই রোগের লক্ষণগুলোর মাঝে রয়েছে-
১। রোগীর মাঝে একের অধিক ব্যক্তিত্বের দেখা পাওয়া যাবে। প্রতিটি ব্যক্তিত্বের আলাদা আলাদা বয়স, লিঙ্গ ও গোত্র থাকবে। এমনকি তাদের স্বতন্ত্র ভঙ্গিমা, অঙ্গভঙ্গি ও কথা বলার ধরন থাকবে। অনেক সময় কাল্পনিক ব্যক্তিত্বটি কোনো প্রাণীরও হতে পারে!
২। ব্যক্তিত্বগুলোর রোগীর উপর আধিপত্য দেখা যায়, ফলে ব্যক্তি সেই অলীক সৃষ্ট ব্যক্তির আরোপিত আচরণ সমূহ পালন কোরতে থাকে।
৩। রোগী অনেক সময়ই অন্য ব্যক্তিত্বগুলোকে মনে রাখতে পারে না।
৪। রোগী অনেক সময় অনুভব করে সে তার শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেছে ।
৫। সে তার ব্যক্তিগত জিনিসগুলো ভুলে যেতে থাকে, যা সাধারণ ভুলে যাওয়ার আওতায় পড়ে না ।
৬। আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পায় ও প্রচুর পরিমাণে হতাশা, অবসাদ, বিষণ্ণতা তৈরি হয়।
৭। মেজাজের দ্রুত পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়।
৮। ঘুমের সমস্যা দেখা যায়, যেমন- ঘুম হয় না, ঘুমের মাঝে ভয় পাওয়া, ঘুমের মাঝে হাঁটা ইত্যাদি ।
৯। অস্থিরতা, প্যানিক অ্যাটাক ও বিভিন্ন ধরনের ফোবিয়া দেখা যায়; যেমন- পুরনো স্মৃতি মনে পড়া এবং সেগুলোর প্রতি বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখানো।
১০। বিভিন্ন ড্রাগের প্রতি আসক্তি দেখা যায়। অনেক সময় হ্যালুসিনেশন হতে দেখা যায়
১১। খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়ম।ক্ষিদের বোধ না থাকা। বা কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে বিকৃত খাবারের ইচ্ছা তৈরি হওয়া, যেমন- কাঁচা মাংস খাওয়া, রক্ত খাওয়ার ইচ্ছা প্রভৃতি।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই রোগ নির্ণয়ের জন্য এই ৫ ক্রাইটেরিয়া থাকা আবশ্যক:
১) দুই বা তার বেশি পার্সোনালিটির উপস্থিতি। তাদের প্রত্যেকের পৃথক ও নিজস্ব নাম, পরিচয় ও স্বভাব থাকা।
২) রোগী তার মধ্যে অন্য পার্সোনালিটির উপস্থিতি মনে রাখতে না পারা এবং সেই সময়ে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা সম্পর্কে জ্ঞান না থাকা।
৩) এই রোগের জন্য রোগীর প্রতিদিনের কাজের ক্ষতি হওয়া, বিশেষ করে কোন কাজের মাঝে যদি তার উপর অন্য পার্সোনালিটি আক্রমণ করে সেই ক্ষেত্রে রোগী কি কাজ করছিল তা ভুলে যাওয়া।
৪) ব্যক্তি তার প্রাত্যহিক জীবনে খুবই ক্ষুব্ধ এবং পীড়িত থাকবে ।তার সমস্যাগুলো স্বাভাবিক জীবনের সাথে মেলানো যাবে না ।
৫) এই লক্ষ্মণ গুলো কোন কিছুর দ্বারা প্রভাবিত হয় না। যেমন মদ বা অন্য নেশা গ্রহণ করার পর ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন ঘটবে না।
আক্রান্ত ব্যক্তির বিভিন্ন পার্সোনালিটিগুলো তাকে জীবনের বিভিন্ন বাধা অতিক্রম করতে মানসিক ভাবে সহায়তা করে। রোগের শুরুর দিকে দুই থেকে চার জন পার্সোনালিটি চিহ্নিত করা হয় যা পরবর্তী সময় ১৩ থেকে ১৫ জন পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। পরিস্থিতিগত পরিবর্তন আর জীবনের বিভিন্ন ঘটনা এই রোগীদের মধ্যে থেকে অন্যান্য পার্সোনালিটিগুলো বের করে আনে৷
♦️চিকিৎসা♦️
মাল্টিপল পারসোনালিটি ডিজঅর্ডারের চিকিৎসার মূল লক্ষ্য হচ্ছে বিচ্ছিন্ন সত্ত্বাগুলোকে একটি সত্ত্বায় একীভূত করা। কিন্তু Dissociative Identity Disorder কখনই সম্পূর্ণভাবে নিরাময়যোগ্য নয়। তাই আজীবন মানসিক চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকাই এর একমাত্র চিকিৎসা। এর কার্যকরী চিকিৎসাগুলো হচ্ছে talk therapy অথবা psychotherapy, hypnotherapy, adjunctive therapies অথবা art or movement therapy। মাল্টিপল পারসোনালিটি ডিজঅর্ডাররের নির্ধারিত কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি নেই এবং কোনো ওষুধের মাধ্যমে এর নিরাময় সম্ভব নয়। এর উপসর্গ হিসেবে যে রোগগুলো দেখা দেয়; যেমন- ডিপ্রেশন, অস্থিরতা, ট্রমা- এগুলোর চিকিৎসার মাধ্যমে এবং নিয়মিত কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে এর কিছুটা নিরাময় পাওয়া যায়।
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, ডিল্যুশনের চরম মাত্রায় কিছু রোগীদের সাথে এমন ঘটনা ঘটে থাকে। রোগী নিজেকে অন্য কেউ ভাবতে শুরু করে। কথা বার্তা, চালচলন, আচার আচরণ ইত্যাদি সবকিছুতেই ভিন্নতা আসে।[2]
প্রসঙ্গত অবসরপ্রাপ্ত এনএফএল তারকা হার্চেল ওয়াকার।
ওয়াকার তার ডিআইডি এর লক্ষ্মণ নিয়ে একটি বইও লিখেছেন। তার আত্মহত্যার চেষ্টা, বিভিন্ন পার্সোনালিটির সাথে তার সংগ্রাম। তিনি উল্লেখ করেন অনেক ছোট থেকেই তার ব্যক্তিত্বের কিছু অদ্ভুত দিক ছিল। তিনি পেশাদার লীগগুলো থেকে নিজেকে সবসময়ই বিচ্ছিন্ন ভাবতেন। খেলায় ভালো করার জন্য তিনি এমন একজন ব্যক্তিত্বের রূপ নিয়েছিলেন যে কখনো একাকিত্ব বোধ করতেন না৷ তিনি আরও উল্লেখ করেন তার মধ্যে সবসময় কোন একটা রাগ চাপা থাকতো৷ সঠিক চিকিৎসা ওয়াকারকে তার অন্যান্য ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে জানান দেয়। তিনি বুঝতে পারেন তার মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার বা ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিসর্ডার রয়েছে।
ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিসর্ডারে কেউ আক্রান্ত হয়েছে কিভাবে বুঝবেন?
ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিসর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তির ভিতর দুটি বা তার বেশি স্বতন্ত্র বা বিভক্ত পরিচয় বা ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি দেখা যায় যা আক্রান্ত ব্যক্তির আচরণের উপর ক্রমাগত ক্ষমতা রাখে। রোগী প্রতিদিনের খুব সহজে মনে রাখার বিষয়গুলো ভুলতে শুরু করে এবং অনেক সময় তাদের মন গড়া কথা বা স্মৃতি বলতে দেখা যায়।
এই রোগে আক্রান্ত সবার লক্ষ্মণ এক হয়না। অনেকের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে থাকা অন্যান্য অস্তিত্বের থাকে আক্রান্ত ব্যক্তির থেকে আলাদা নাম, বয়স, লিঙ্গ পরিচয় এমনকি ভিন্ন জাতি। তাদের এক এক জনের থাকে বিভিন্ন রকম কথা বলার ধরন, হাটার ধরন, ভিন্ন শারীরিক ভঙ্গিমা এমনকি ভিন্ন ভিন্ন অভ্যাস। একজন থাকতে পারে শান্ত, অন্যজন খুব মিশুক, একজন রাগী, কেউ জোড়ে কথা বলে, কেউ অল্পতেই কাঁদে। সবচেয়ে অবাক করার মত কথা হলো এই সব পার্সোনালিটির সবগুলো মানুষ হয়না, এমনও হতে পারে একজন মানুষ সম্পূর্ণ ভাবে কোন পশুর মত আচরণ করছে।
আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে যখন অন্য পার্সোনালিটিগুলো চলে আসে তার নিজের সম্পর্কে বা অন্যান্য পার্সোনালিটিরগুলোর সম্পর্কে তার কোন ধারণা থাকে না। একজন থেকে অন্যজনে পরিবর্তন হওয়ার এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় “সুইচিং”। একজন ব্যক্তির সুইচিং হতে এক সেকেন্ড, এক মিনিট, এক দিন, এক সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে৷ এটা কেউই বলতে পারে না কেন বা কখন একজন মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের ব্যক্তির পার্সোনালিটি সুইচ হবে। কিছু কিছু মানুষ হিপ্নোসিসের চিকিৎসা নিয়ে থাকেন যাতে তাদের বিভিন্ন পার্সোনালিটিগুলো ডাক্তারের কথায় সাড়া দেয়।
অন্যান্য ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিসর্ডারের লক্ষ্মণ গুলোর মধ্যে রয়েছে মাথাব্যথা, অ্যামনেসিয়া, সময় জ্ঞান না থাকা, মোহতে থাকা এবং এমনও মনে হতে পারে তারা তাদের শরীরের বাইরে অবস্থান করছে। কিছু ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিসর্ডারে ভোগা মানুষের নিজের প্রতি সহিংস আচরণ করার প্রবনতা দেখা যায়, এই সহিংসতা মাঝে মাঝে অন্য ব্যক্তির দিকেও পরিচালিত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ একজন ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিসর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেদের এমন কিছু করতে দেখবে যা সাধারণত তারা কখনোই করবেন না, যেমন অনেক জোরে গাড়ি চালানো, বা কোন বন্ধু অথবা সহকর্মীর থেকে কিছু চুরি করা। তাদের এমন আচরণের সময় তারা সেই কাজটি করতে অনেকটা বাধ্য হোন। কিছু কিছু রোগী তাদের নিজেদের তার শরীরে একজন যাত্রী হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যেখানে তিনি আছেন ঠিকই কিন্তু তা পরিচালনা করছে অন্য কেউ।
এটি এখন প্রমাণিত যে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে থাকা অন্যান্য অস্তিত্বগুলো জানে তারা বাস্তব মানুষ না, তারা রোগীর আসল নাম, পরিচয়ও জানে। তারা যখন রোগীর উপর চড়াও হয় তারা নিজেদের অতীতের সব ঘটনা মনে রাখেন যা আক্রান্ত ব্যক্তি কিছুই জানেন না। অন্যান্য চরিত্রগুলো রোগীর সম্পর্কে সব জানলেও, রোগী নিজে অন্য পার্সোনালিটিগুলোর সম্পর্কে কিছুই জানেন না।
এই ধরণের রুগীদের ক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার পারিবারিক সহায়তা ও সঠিক চিকিৎসা অত্যন্ত জরুরী। এটি একটি দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়া। তাই ধৈর্য ধরে রুগীর সাথে থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন।
লেখীকাঃ পারমিতা বন্ধ্যোপাধ্যায়