পদার্থবিদ্যার গাঠনিক উপাদান বা ব্লকসমূহকে ভৌত রাশি বলে যার মাধ্যমে পদার্থবিদ্যার সূত্রসমূহ প্রকাশ পায়। এই রাশি গুলোর মধ্যে রয়েছে বল, সময়, বেগ, ঘনত্ব, তাপমাত্রা, চৌম্বক সংবেদ্যতা ইত্যাদি; এদের মধ্যে বল, তাপমাত্রা ইত্যাদি পদগুলো আমরা হরহামেশাই কথাবার্তার মধ্যে বললেও আমরা এদের বৈজ্ঞানিক অর্থকে না বুঝিয়ে ভিন্ন অর্থকে বোঝাই।
পদার্থবিদ্যার ভিত্তি রাশিগুলোকে নিখুঁতভাবে এবং সুনির্দিষ্ট ভাবে সংজ্ঞায়িত করা খুবই জরুরী। কোন ভৌত রাশির সংজ্ঞা দেওয়া থাকলে রাশিটির পরিমাপ পদ্ধতি অবশ্যই দেওয়া থাকবে। এরূপ পরিমাপ পদ্ধতির সাথে গাণিতিক ক্রিয়াকলাপও অন্তর্ভুক্ত থাকে।
ভৌতভাবে উপলব্ধিযোগ্য বা পরিমাপযোগ্য বিষয়বস্তুকেই রাশি বলে। ভৌত রাশিকে সচরাচর মৌলিক (fundamenta) রাশি এবং লব্ধ (derived) রাশিতে ভাগ করা হয়। রাশির এই বিভাজন স্বেচ্ছাধীন (arbitrary) কারণ যে কোন ধরনের ক্রিয়াকলাপে (operation) একটি রাশিকে মৌলিক বিবেচনা করলে অন্য কোন ক্রিয়াকলাপে তা লব্ধ রাশি বিবেচিত হতে পারে। লব্ধ রাশি হল সেগুলো যাদের সংজ্ঞার ভিত্তি হল অন্যান্য ভৌত রাশি। বেগ, ত্বরণ, আয়তন প্রভৃতি হলো লব্ধ রাশি। মৌলিক রাশিকে অন্যান্য ভৌত রাশির মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত করা হয় না। মৌলিক রাশি হিসেবে স্বীকৃতি রাশির সংখ্যাও খুব বেশি নয়। যেমন— দৈর্ঘ্য ও সময় সহ মোট মাত্র সাতটি মৌলিক রাশি রয়েছে। মৌলিক রাশির সংজ্ঞা নির্ধারণে দুটি ধাপ রয়েছে। প্রথমত, একটি আদর্শ পছন্দ করা এবং দ্বিতীয়ত, এই আদর্শের সাথে তুলনা করে অন্য রাশির পরিমাপ পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করা যেন একটি এককযুক্ত সংখ্যা দ্বারা রাশিটির পরিমাপ পাওয়া যায়।
একটা আদর্শিক (ideal) আদর্শের দুটি মুখ্য বৈশিষ্ট্য থাকে, যা অভিগম্য এবং অপরিবর্তিত। কিন্তু এই দুটি প্রয়োজনীয়তার মধ্যে কোন সঙ্গতি এবং তাই এদের মধ্যে একটা আপোস রফার প্রয়োজন। প্রথমে অভিগম্যতা উপর অধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়। কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে অপরিবর্তিতার উপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ, সুপরিচিত গজ, ফুট ও ইঞ্চি সরাসরি মানুষের বাহু (হাত), পা ও বৃদ্ধাঙ্গুল থেকে উদ্ভূত হয়েছে। বর্তমানে দৈর্ঘ্যের এরূপ আনুমানিক পরিমাপ সন্তোষজনক নয় এবং এর বদলে সহজে পরিবর্তনীয় নয় এমন আদর্শ ব্যবহার করা হয়।
ধরা যাক, দৈর্ঘ্যের আদর্শ হিসেবে একটা দণ্ড নির্বাচন করা হলো যার দৈর্ঘ্যকে এক মিটার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায়। এখন দ্বিতীয় একটি দণ্ডের দৈর্ঘ্যকে আদর্শ দণ্ডটির সাথে সরাসরি তুলনা করে দেখা গেল যে এটার দৈর্ঘ্য প্রথমটির তিনগুন। তাহলে নিশ্চিত করে বলা যায় যে দ্বিতীয়টির দৈর্ঘ্য 3 মিটার। বাস্তবে অধিকাংশ রাশিকে প্রাথমিক আদর্শের সাথে সরাসরি তুলনা করে পরিমাপ করা যায় না। এরূপ ক্ষেত্রে পরোক্ষ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। কতিপয় স্বতঃসিদ্ধ তৈরি করে নেওয়া হয় যেগুলো প্রত্যক্ষ ক্রিয়াকলাপে পরোক্ষ পরিমাপের ফলাফলকে সম্পর্কযুক্ত করে।
উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক, কোন নির্দিষ্ট সময়ে চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে একটি রকেট লঞ্চিং স্টেশনের দূরত্ব জানা দরকার। এক্ষেত্রে দূরত্ব পরিমাপের জন্য পরোক্ষ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। পদ্ধতিটি এমন হতে পারে যে, (সচরাচর এমনটি হয়) স্টেশনে কোন প্রেরক যন্ত্র থেকে রাডার সংকেত প্রেরণ করা হলো যা চন্দ্রপৃষ্ঠ কর্তৃক প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে এবং প্রেরক স্টেশনে কোন গ্রাহক যন্ত্র কর্তৃক উদঘাটিত হয়। রাডার সংকেত প্রেরণ ও উদঘাটনের সময় ব্যবধানের অর্ধেকের সাথে সংকেতের দ্রুতি গুণ করলে রকেট স্টেশন হতে চন্দ্রপৃষ্ঠের দূরত্ব পাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে ব্যবহৃত স্বীকার্য হলঃ রাডার সংকেতের দ্রুতি ধ্রুবক এবং সংকেত সরল পথে গতি সম্পাদন করে। উপরন্তু এই সংকেতের দ্রুতি জানা থাকবে।
জ্যোতির্বিদ্যা সম্মত দূরত্ব, যেমন পৃথিবী থেকে কোন নক্ষত্রের দূরত্ব সরাসরি নির্ণয় করা যায় না। এরূপ বৃহৎ দূরত্ব পরিমাপের জন্য পরোক্ষ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। আবার অতিশয় ক্ষুদ্র দূরত্ব যেমন পরমাণু বা অণুর অভ্যন্তরীণ কণাসমূহের পারস্পরিক দূরত্ব পরিমাপের ক্ষেত্রেও পরোক্ষ পদ্ধতি ব্যবহার করতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, প্রোটনের কার্যকর ব্যাসার্ধ পরিমাপে কণা বিক্ষেপণ পরীক্ষা ব্যবহার করে 1.2× 10−15 মিটার পাওয়া যায়।