পড়তে বসে ঘুমানোর ভয়াবহ সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায়ঃ-
১. পড়ার ঘরকে আলোকিত রাখুন :
অনেক শিক্ষার্থীই পড়তে বসে সবচেয়ে বড় যে ভুলটি করে তা হলো, কেবল একটি টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে রাখে। হ্যাঁ, বইয়ের পাতায় কী লেখা আছে তা দেখার জন্য টেবিল ল্যাম্পের আলোই হয়তো যথেষ্ট, এবং ঘরের অন্যান্য বাতি জ্বালিয়ে রাখাকে নিতান্তই বিদ্যুতের অপচয় মনে হতে পারে। কিন্তু বিষয়টি হলো, আপনি যখন কেবল টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে পড়বেন, তখন ঘরের বেশিরভাগ অংশই অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকবে, যা একটি আরামদায়ক পরিবেশের জন্ম দেবে, এবং আপনার মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করবে বিশ্রাম গ্রহণের জন্য। এজন্য পড়ার সময় প্রয়োজনের বাইরেও পুরো ঘর আলোকিত করে রাখা জরুরি।
২. বিছানায় নয়, চেয়ারে বসে পড়ুন :
আপনি কোন আসনে বা ভঙ্গিতে বসে পড়ছেন, সেটিও কিন্তু খুবই জরুরি। কারণ পড়াশোনা সামান্য কিছু সময়ের কাজ নয়, অনেক ক্ষেত্রে আপনাকে ঘন্টার পর ঘন্টাও পড়তে হতে পারে। তাই আপনার উচিৎ পেছনে হেলান দেয়া যায় এমন একটি চেয়ারে বসে, সামনের টেবিলে বই রেখে পড়া, যা আপনাকে সবসময় সতর্ক রাখবে, আপনার মনোযোগ বিঘ্নিত হতে দেবে না। অপরদিকে আপনি যদি বিছানায় বসে, শুয়ে কিংবা আধশোয়া হয়ে পড়েন, আপনার স্নায়ুগুলো ক্রমশ নিশ্চল থেকে নিশ্চলতর হতে থাকবে, এবং একসময় আপনার ঘুম চলে আসবে। তাই চেয়ার-টেবিলে বসেই পড়তে হবে, এবং কিছুক্ষণ পরপর হাত-পা নেড়ে স্নায়ুগুলোকে সচল করে নিতে হবে। দরকারে প্রতি আধা ঘন্টা পরপর আপনি পাঁচ মিনিটের বিরতিতে হাঁটাহাঁটিও করে নিতে পারেন।
৩. ভারি খাবার বর্জন করুন :
যেকোনো মানুষেরই ভারি খাবার গ্রহণের পর আলসেমি বোধ হয়, এবং বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতে ইচ্ছা করে। মূলত আপনি যখন পুরোপুরি পেট ভরে খাওয়া সম্পন্ন করেন, তখন আপনার মনে খানিকটা আয়েশ করে নেয়ার সাধ জাগে, এবং চোখ খোলা রাখতে আপনাকে অনেক বেগ পোহাতে হয়। অপরদিকে পেট যদি পুরোপুরি ভরা না থাকে, তাহলে শরীরের এই বাড়তি আয়েশের আকাঙ্ক্ষাও সৃষ্টি হয় না, বরং সে পূর্ণ মনোযোগ পাঠ্য বিষয়ের উপর দিতে পারে। অনেকেই বলে থাকেন, ক্ষুধাপেটে পড়া ভালো হয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে আবার আপনার মাথায় কেবল খাওয়ার চিন্তাই ঘুরপাক খেতে পারে। তাই সম্পূর্ণ না খেয়ে থাকার চেয়ে, পরিমিত খাবার খেয়ে পড়তে বসাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
৪. প্রচুর পানি পান করুন :
প্রচুর পানি পানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। পড়াশোনার ক্ষেত্রেও এটি সমান দরকারি। আপনি যদি প্রচুর পানি পান করেন, তাহলে আপনার মস্তিষ্ক আর্দ্র থাকবে, ফলে পড়া বুঝতে ও মনে রাখতে সুবিধা হবে। তবে এর পাশাপাশি প্রচুর পানি পানের একটি ব্যবহারিক দিকও রয়েছে। আপনি যত বেশি পানি পান করবেন, আপনার তত বেশি বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন হবে। এভাবে প্রতি ঘন্টায় একবার করে যদি আপনাকে বাথরুমে যেতে হয়, তাহলে আপনার শরীর চলমান থাকবে। ফলে নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়ার কোনো আশঙ্কা থাকবে না। আর ঘুমিয়ে পড়লেও, মূত্রবেগের অস্বস্তিতে দ্রুতই ঘুম ভেঙে যাবে।
৫. 'আর্লি টু বেড, আর্লি টু রাইজ' মেনে চলুন :
ছোটবেলায় সকলেই পড়েছেন, আর্লি টু বেড অ্যান্ড আর্লি টু রাইজ, মেকস এ ম্যান হেলদি, ওয়েলদি অ্যান্ড ওয়াইজ। বাস্তবিকই এর চেয়ে পরম সত্য আর কিছু হতে পারে না, এবং পড়াশোনায় মনোনিবেশের ক্ষেত্রে এটি আরো বেশি কার্যকরী। আপনি যদি রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যান, তাহলে আপনার যথেষ্ট পরিমাণ ঘুম হবে। ফলে পরদিন সকালে আপনি শারীরিক ও মানসিকভাবে তরতাজা হয়ে উঠতে পারবেন। হঠাৎ হঠাৎ ক্লান্তি জেঁকে বসবে না, আর ঘুম ভালো হওয়ায় আপনি হুট করে বিরক্ত বা বিষাদগ্রস্তও হবেন না। এতে করে আপনি আবারো পড়াশোনার প্রতি সর্বোচ্চ মনোযোগ স্থাপন করতে পারবেন।
৬. 'পাওয়ার ন্যাপ' গ্রহণ :
সারাদিন একনাগাড়ে পড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে কিছুক্ষণের জন্য ঘুমিয়ে নিলে, আপনার শরীরে আবার নতুন করে শক্তি সঞ্চার হতে পারে। এজন্যই একে বলা হয় পাওয়ার ন্যাপ। এই পাওয়ার ন্যাপ আপনি যেকোনো সময়ই নিতে পারেন, তবে সবচেয়ে ভালো হয় দুপুরে খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নিলে। অনেকেই হয়তো দুপুরে ঘুমানোর পক্ষপাতি নয়, কিন্তু তারা অবশ্যই একজন শিক্ষার্থীর টাইট শিডিউল সম্পর্কেও অবগত নয়। একজন শিক্ষার্থীকে সেই ভোরবেলা পড়া শুরু করতে হয়, এরপর অনেকগুলো ক্লাস করতে হয়। রাতে আবার তার নিজের পড়া ও পরবর্তী দিনের প্রস্তুতি গ্রহণের ব্যাপার থাকে। তাই দুপুরে বা বিকালে খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নেয়া তার জন্য কেবল সহায়কই নয়, শরীরকে টিকিয়ে রাখতে অতীব আবশ্যক। তা না হলে কারো পক্ষে ভোরবেলা থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত পড়াশোনা অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়। এভাবে টানা কয়েকদিন অবিরত পড়াশোনা করতে থাকলে স্বাস্থ্যহানি সুনিশ্চিত।
৭. শরীরের অঙ্গসমূহকে সতর্ক ও সচেতন রাখুন :
আপনি যখন একই ভঙ্গিতে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা পড়াশোনা করে যাবেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই আপনি আলসেমি বোধ করবেন, আপনার একটু একটু ঘুম আসতে থাকবে। তাই আপনার উচিৎ হবে যখনই ঘুম আসবে, সাথে সাথে চেয়ার থেকে উঠে পড়ে কিছুক্ষণ ঘরে কিংবা বাইরে গিয়ে হেঁটে আসা। তখন হালকা শরীরচর্চাও করে নিতে পারেন। আর পড়াটা যদি বেশি জরুরি হয়, তাহলে খানিকক্ষণ হেঁটে হেঁটেও কিন্তু পড়তে পারেন। হেঁটে হেঁটে পড়লে কেবল ঘুমই দূর হয় না, গবেষণায় প্রমাণিত যে এর মাধ্যমে পড়ায় মনোযোগও দেয়া যায় বেশি।
৮. জোরে জোরে পড়ুন :
ছোটবেলায় হয়তো আপনার মা আপনাকে শাসিয়ে যেতেন, এত জোরে জোরে পড়বি যেন আমি রান্নাঘর থেকে শুনতে পাই! মায়ের ভয়ে আপনি জোরে জোরে পড়তেন। কিন্তু এখন বড় হয়ে যাওয়ার পর আর জোরে জোরে পড়েন না, কারণ আপনার কাছে মনে হয় জোরে জোরে পড়া বাচ্চাসুলভ কাজ। কিন্তু জোরে জোরে পড়ার মাধ্যমেই কিন্তু ঘুমিয়ে পড়ার আশঙ্কা দূর করা যায়। আবার জোরে জোরে পড়া মানে হলো নিজের কন্ঠস্বর নিজের কানে শোনা। এটা অনেকটা ক্লাসে শিক্ষকের পড়া বুঝিয়ে দেয়ার মতো ব্যাপার। আপনি নিজেই নিজেকে পড়া বুঝিয়ে দেবেন, ফলে অনেক জটিল বিষয়ও দ্রুতই আপনার বোধগম্য হবে।
৯. পড়া বিষয় লিখে ফেলুন :
স্কুল জীবনে অনেকেই পড়ার সাথে সাথেই নতুন শেখা জিনিসটি খাতায় লিখে ফেলতেন। এখন অবশ্যই সে কাজটি করেন না। কিন্তু এটি এখনো অনেক সহায়ক হতে পারে। আপনি একটানা কেবল পড়ার বদলে, কিছুক্ষণ যদি খাতায় লেখেন, তাহলে বৈচিত্র্য আসবে। তাছাড়া পড়া বিষয়টা খাতায় যখন নিজের মতো করে শর্ট নোট আকারে লিখবেন, তখন সেটি আপনার পক্ষে মনে রাখা আরো সহজ হয়ে যাবে। আর বলাই বাহুল্য, পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যাওয়ার যে সম্ভাবনা রয়েছে, লিখতে লিখতে ঘুমিয়ে যাওয়ার সে সম্ভাবনা অনেক কম। যদি লেখার মতো কিছু না থাকে, তাহলে বই দাগিয়েও পড়তে পারেন। সেক্ষেত্রে পেন্সিল, ভিন্ন রঙের কলম বা সিগনেচার কলম ব্যবহার করতে পারেন। রঙের ব্যবহারও কিন্তু আপনার নিশ্চল হয়ে পড়া মস্তিষ্ককে উদ্দীপ্ত করতে পারে।
১০. রাতের বেলা কঠিন বিষয় পড়া থেকে বিরত থাকুন :
সারাদিন অনেক পরিশ্রম করার ফলে আপনার শরীর ও মন দুই-ই ক্লান্ত থাকে। এরকম অবস্থায় আপনার পক্ষে খুব জটিল কোনো বিষয়ে মনোনিবেশ করা ও তা বুঝে বুঝে পড়া সম্ভব না। এ কাজ করতে গেলে আরো হিতে-বিপরীত হতে পারে। ওই বিষয়ের প্রতি আপনার এতটাই বিতৃষ্ণা চলে আসতে পারে যে, ভবিষ্যতে হয়তো আর ওই বিষয়ে পড়ার কোনো আগ্রহই আর পাবেন না। অপরদিকে রাতে একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যদি ভোরবেলা চাঙ্গা হয়ে উঠতে পারেন, তাহলে তখন নির্ভার মনে কঠিন বিষয়টি পড়ে সহজেই সেটি বুঝে ফেলতে পারবেন। সুতরাং কঠিন বিষয়গুলো পরদিন ভোরবেলার জন্য তুলে রাখুন, রাতে কেবল সহজ ও আগ্রহোদ্দীপক বিষয়গুলোই পড়ুন।
১১. গ্রুপ স্টাডি করুন :
একা একা পড়া অনেকের কাছেই একঘেয়ে একটা ব্যাপার মনে হতে পারে। পরীক্ষার আগে সারারাত একা একা পড়াটা অনেকের কাছে রীতিমতো দুর্বিষহ একটি বিষয়ও বটে। তাছাড়া একা একা পড়তে গিয়ে কোনো জটিল জায়গায় আটকে গেলে পড়ার প্রতি আগ্রহ অনেকটাই কমে যায়। তখন মনে হয়, কী লাভ এই বিষয়টা পড়ে, তারচেয়ে বরং একটু ঘুমিয়ে নিই। এভাবেই একা একা পড়তে গিয়ে অনেকেরই শেষ পর্যন্ত পড়া হয়ে ওঠে না। কিন্তু এক বা একাধিক বন্ধুকে নিয়ে যদি গ্রুপ স্টাডি করা যায়, তাহলে একাকীত্ব দূর হয়, পড়াশোনাকে একঘেয়ে মনে না হয়ে বিনোদনমূলক মনে হয়, এবং একজন কোনো পড়া না পারলে দ্রুতই অন্যজনের কাছ থেকে সেটা বুঝে নেয়া যায়। আর কেউ সেটা না পারলেও কিন্তু ক্ষতি নেই। তখনো এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়া যায়, এই পড়াটা তো কেউই পারে না, তাহলে আমাকে পারতে হবে কোন দুঃখে!
১২. চুইংগাম চিবান কিংবা চা-কফি পান করুন :
পড়ার সময় খাওয়া বা পান করার ব্যাপারে অনেকেই হয়তো বিরোধিতা করে থাকে, তবে ক্ষেত্রবিশেষে এগুলো উপকারিও হতে পারে। ধরুন, পড়তে পড়তে বারবার আপনি হাই তুলছেন, যেকোনো মুহূর্তে চোখ লেগে আসতে পারে। অথচ পড়াটাও খুব জরুরি। তখন আপনি মুখে একটি চুইংগাম পুরে সেটি চিবাতে শুরু করতে পারেন। চুইংগাম চিবাতে থাকা মানে একটি সক্রিয় শারীরিক কর্মকান্ডে যোগ দেয়া, যাতে করে আপনার মস্তিষ্ক পূর্বাপেক্ষা বেশি সচল হয়ে উঠবে। এছাড়া ঘুম তাড়াতে চা বা কফি জাতীয় পানীয় পান করাও যেতে পারে। তবে মনে রাখবেন, অত্যধিক ক্যাফেইন স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই দৈনিক ৫০০-৬০০ মিলিগ্রামের বেশি ক্যাফেইন গ্রহণ করা যাবে না।
লেখক : জান্নাতুল নায়েম পিয়াল