বাস্তব জীবনে আমরা সবাই স্পিড লিমিটের সাথে পরিচিত। সাধারনত পৃথিবীতে কোনকিছুই আনলিমিটেড স্পিডের হয়না। আমরা রাস্তায় যে গাড়ি বা বাইক চালাই, যে অ্যারোপ্লেনে ভ্রমন করি এবং এমনকি লাইটের যে ফোটন কণাগুলো আমাদের চোখে পৌঁছায়, সেই সবকিছুরই একটি নির্দিষ্ট স্পিড লিমিট আছে। তবে বর্তমান সময়ে মানুষ সবথেকে বেশি যে স্পিড নিয়ে মাথা ঘামায়, তা হচ্ছে ইন্টারনেট স্পিড। বর্তমানে সবাই অন্যদের থেকে আরো একটু হলেও বেশি ইন্টারনেট স্পিড চায়।
আমাদের দেশে ১ মেগাবিট প্রতি সেকেন্ড থেকে শুরু করে ১০০ মেগাবিট এবং কোথাও কোথাও ৫০০ মেগাবিট ইন্টারনেটেরও দেখা পাওয়া যেতে পারে এবং আমরা NASA তে ৯১ গিগাবাইট ইন্টারনেট স্পিডের গুজবও শুনেছি সোশ্যাল মিডিয়াতে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এর শেষ কোথায়? ইন্টারনেট সর্বোচ্চ কতটা ফাস্ট হতে পারে এবং ভবিষ্যতে হওয়া সম্ভব? আজকে এই বিষয়টি নিয়েই আলোচনা করবো।
প্রথমত জানা যাক যে, এখন এই মুহূর্তে সবথেকে ফাস্ট ইন্টারনেট স্পিড কোথায় আছে। আপনি যদি মনে করে থাকেন যে, আমেরিকা বা অন্যান্য প্রযুক্তিগত দিক থেকে উন্নত দেশগুলোতে থাকা লোকেরা যারা ১ গিগাবিট বা ২ গিগাবিট ইন্টারনেট ব্যবহার করে কিংবা এস্টোনিয়াতে থাকা ইন্টারনেট ইউজার যারা ১০ গিগাবিট ইন্টারনেট ব্যবহার করে, তারাই সবথেকে ফাস্ট ইন্টারনেট ব্যবহার করে, তাহলে আপনি ভুল জানেন।বর্তমানে ইন্টারনেটের সবথেকে ফাস্ট স্পিডের কাছে এসব স্পিড কিছুই না।
সবথেকে ফাস্ট ইন্টারনেট স্পিড খুঁজতে হলে আমাদেরকে সম্পূর্ণ ইন্টারনেটের মেরুদন্ডকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে, অর্থাৎ ইন্টারনেটের মেইন হাইওয়েকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে যেটি সাড়া পৃথিবীর ইন্টারনেটকে পরিচালনা করে। এই মেইন লাইনগুলোর মধ্যে এমন অনেক লাইন আছে যেগুলো আক্ষরিক অর্থেই ১০০ গিগাবিট প্রতি সেকেন্ড স্পিডে ডেটা ট্রান্সফার করে, তবে এগুলোও পৃথিবীর সবথেকে ফাস্ট ইন্টারনেট স্পিড নয়। বরং ইন্টারনেটের সবথেকে অ্যাডভান্সড ইনফ্রাস্ট্রাকচারের কাছে এই স্পিড কিছুই না।
এই মুহূর্তে ইন্টারনেটের মেরুদন্ডের সবথেকে ফাস্ট অংশটি হচ্ছে একটি আন্ডার-সি ক্যাবল যেটির নাম হচ্ছে ম্যারেয়া। আন্ডার-সি ক্যাবল সেগুলোকেই বলা হয় যেগুলো সমুদ্রের তলদেশে থাকে এবং ইন্টারনেটের মেইন ডেটা ট্রান্সফারের কাজটি করে থাকে, যেগুলোকে আমরা সমুদ্রের নিচে থাকা ফাইবার অপটিক ক্যাবল হিসেবে চিনি। এই ম্যারেয়া নামের আন্ডার-সি ক্যাবলটি ভার্জিনিয়ার সমুদ্র থেকে স্পেনের বিলবাও শহর পর্যন্ত গিয়েছে। আর এই আন্ডার-সি ক্যাবলটি অবিশ্বাস্যরকম দ্রুতগতিতে ডেটা ট্রান্সফার করতে পারে যা প্রায় ১৬০ টেরাবিট প্রতি সেকেন্ড স্পিডে। ম্যারেয়ার মতো বড় আন্ডার-সি ক্যাবলগুলো অপটিক্যাল অ্যামপ্লিফায়ার ইউজ করে যাতে ক্যাবলের ভেতর থেকে যাওয়া সিগনালগুলো সবসময় একইরকম স্ট্রং থাকে। আপনার যদি অপটিক্যাল ফাইবার নিয়ে কিছুটা ধারনাও থাকে তাহলে আপনি জানেন যে, অপটিক্যাল ফাইবারে ডেটা ট্রান্সফার করা হয় আলোর সাহায্যে এবং আলোর প্রতিফলনের সাহায্যে। তবে সাধারন আন-অ্যামপ্লিফাইড ফাইবার অপটিক ক্যাবল আলোকে সবসময় পারফেক্টভাবে রিফ্লেক্ট করেনা। কিছুটা শোষণ হয়ে যায় এবং অন্য অনেক কারনেই আলো পারফেক্টভাবে প্রতিফলিত হতে পারেনা।
তবে যখন অ্যামপ্লিফায়ার ব্যবহার করা হয় তখন এই আলোর সাহায্যে আসা ডেটাগুলো কোনভাবেই শোষণ হয়ে যায়না এবং দুর্বল হয়ে পড়েনা। এই সব ডেটাগুলো তাদের যাত্রাপথের প্রত্যেক সেকেন্ডেই একইরকম স্ট্রং থাকে যেমনটা প্রথমে ছিলো। এছাড়া এই শক্তিশালী ফাইবার অপটিক ক্যাবলগুলোতে একইসাথে অনেকগুলো ফাইবার এবং প্রত্যেকটি ফাইবারে আবার প্রত্যেকটি ফাইবারে আবার মাল্টিপল ওয়েভ লিংক ব্যবহার করার সাহায্যে এই ম্যারেয়ার মতো ফাইবার অপটিক ক্যাবলগুলো বিপুল পরিমান ডেটা ক্যারি করার মতো ক্ষমতা রাখে। তবে এখন প্রশ্নটি হচ্ছে, এর থেকে বেশি স্পিডও কি ভবিষ্যতে পাওয়া সম্ভব? সম্ভব হলে কতোটা স্পিড পাওয়া সম্ভব? কিভাবেই বা পাওয়া সম্ভব?
প্র্যাক্টিক্যালি বলতে হলে, ইন্টারনেট প্রতিনিয়ত যেভাবে আরও বেশি উন্নত হচ্ছে এবং হয়েই চলেছে, আমরা প্রতিনিয়ত আরও অনেক উন্নত ম্যাটেরিয়াল তৈরি করছি যেগুলো আলোকে আরও পারফেক্টভাবে প্রতিফলিত করতে পারে। এই ধরনের সব ম্যাটেরিয়াল এবং টেকনোলজিকে কাজে লাগিয়ে আমরা আরও অনেকভাবে ফাইবার অপটিক ক্যাবলকে অপটিমাইজ করতে পারি , যেমন- হয়তো একটি সিঙ্গেল ফাইবারের মধ্যে আরও বেশি ওয়েভ লিংক থ্রো করার ব্যাবস্থা করে কিংবা আরও ভালো অ্যামপ্লিফায়ার ব্যবহার করে।
এই সবধরনের টেকনোলোজি কাজে লাগিয়ে আশা করা যায় যে, আমরা হয়তো ভবিষ্যতে ফাইবার অপটিক ক্যাবল ব্যবহার করে ১ পেটাবাইট (১০০০ টেরাবাইট) প্রতি সেকেন্ড পর্যন্তও স্পিড পেতে পারি কিংবা হয়তো তার থেকেও বেশি, শুধুমাত্র একটি ফাইবারে। আবার এই ফাইবারটিকেও অনেকগুলো একসাথে একটি ক্যাবলে রাখার মাধ্যমে এই স্পিডটিকেও বহুগুণে বাড়ানোর সুযোগ থাকছে, যতক্ষন পর্যন্ত সম্পূর্ণ ইনফ্রাস্ট্রাকচারটি এইসকল বিপুল পরিমান ডেটাগুলোকে প্রোসেস করতে পারে এবং সেপারেট করতে পারে।
এছাড়া এটা মনে রাখতে হবে যে, প্রায় সব মডার্ন অপটিক্যাল নেটওয়ার্কগুলো ইনফ্যারেড লাইট ব্যবহার করে থাকে যা খুবই লো ফ্রিকুয়েন্সির সিগনাল। তাই ইনফ্যারেড লাইট খুব বেশি ডেটা ক্যারি করতে পারেনা। যেহেতু এটি হাই এনার্জিটিক এবং হাই ফ্রিকুয়েন্সির রেডিয়েশন নয়। হয়তো ভবিষ্যতে আমরা অতিবেগুনী রশ্মির (UV Light) সাহায্যেও ডেটা ট্রান্সফার করতে পারি যা আমাদেরকে আরও অনেক ফাস্ট স্পিড এবং আরো স্ট্যাবল কানেকশন দিতে সক্ষম হবে। তবে এটা আমরা তখনই পারবো যদি আমরা উপযুক্ত ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করে ডেটা ট্রান্সমিট করার মতো ব্যাবস্থা করতে পারবো যদি ম্যাটেরিয়ালগুলো এতো হাই ফ্রিকুয়েন্সি সহ্য করতে পারে আর ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। যদিও আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, আমরা ওয়াইফাই এর ক্ষেত্রে UV লাইট ব্যবহার করতে পারবো না, কারন এতে আমাদের শরীরের ক্ষতি হবে।