কোনো শিশু যখন তার সমবয়সীদের তুলনায় কম উচ্চতাসম্পন্ন হয়, তখন অভিভাবকরা বিষয়টি নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে যান। ঠিকমতো বৃদ্ধি না হলে একটি শিশু নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়। অনেক সময় এই বৃদ্ধি প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে যৌবনপ্রাপ্ত না হওয়ার সমস্যাও দেখা দেয়। পরবর্তী সময়ে বিবাহবন্ধন, সন্তান ধারণ বা পারিবারিক জীবন ব্যাহত করে।
এ ছাড়া কিছু শিশু ট্রিজিং ও বুলিংয়ের শিকার হয়ে একঘরে হয়ে পড়ে। ভালো মেধা থাকা সত্ত্বেও অনেকে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে।
কারণ
শিশুর শারীরিক ও মানসিক উভয়ই বৃদ্ধি জিনগত ও পরিবেশগত বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। পাশাপাশি নির্ভর করে তার সার্বিক সুস্থতা ও হরমোনের ওঠা-নামার ওপর।
আবার একেক এলাকায় ও একেক পরিবারে উচ্চতা বৃদ্ধির প্রবণতা একেক রকম। অনেক সময় শৈশবে কোনো দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা, যেমন—কিডনি বা ফুসফুসের রোগ, অপুষ্টি, হজমের গোলমাল ইত্যাদি কারণে শিশুর বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। শরীরে প্রায় সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বৃদ্ধি যে হরমোনগুলো নিয়ন্ত্রণ করে, তার মধ্যে থাইরয়েড ও গ্রোথ হরমোন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ হরমোনগুলোর অভাবে শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি থেমে যেতে পারে বা ধীরে ধীরে হতে পারে।
টার্নার বা ডাউনস সিনড্রোমের মতো জেনেটিক সমস্যায়ও মানুষ খাটো হতে পারে।
কোন বয়সে কেমন উচ্চতা?
একেক বয়সে মানুষের উচ্চতা বৃদ্ধির হার একেক রকম। দুই বছর বয়স পর্যন্ত শিশুটি বছরে ২০ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। এরপর বৃদ্ধির হার কমে আসে এবং পাঁচ-ছয় বছর বয়স পর্যন্ত এই হার বছরে ১০-১২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়। ছয়-সাত বছরে আরো কমে বছরে পাঁচ-ছয় সেন্টিমিটার হারে বাড়ে।
আবার বয়ঃসন্ধিকালে হঠাৎ করে লম্বা হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায় এবং বছরে ১০-১৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়তে থাকে। ১৪-১৫ বছরের পর থেকে বৃদ্ধির হার আবারও কমতে থাকে। তখন গড়ে এক সেন্টিমিটার হারে বাড়তে থাকে, যা চলে ১৯ থেকে ২১ বছর বয়স পর্যন্ত। এরপর দৈহিক বৃদ্ধি থেমে যায়।
দৈহিক উচ্চতা তত দিনই বাড়ে, যত দিন পর্যন্ত আমাদের কাঠামো বা কঙ্কাল বৃদ্ধি পেতে থাকে। হাড়ের শেষ মাথায় অবস্থিত তরুণাস্থি বা প্লেটটি হাড়ের সঙ্গে মিশে না যায়। যৌবনপ্রাপ্ত হলে হরমোনের প্রভাবে এ প্লেট মূল হাড়ের সঙ্গে মিশে যায় বা ফিউশন হয়ে যায়, এরপর আর হাড় লম্বায় বাড়তে পারে না। সাধারণত এ ফিউশন ছেলেদের ১৬ বছর ও মেয়েদের ১৪ বছরের মধ্যে ঘটে। যদিও ১৯ থেকে ২১ বছর পর্যন্ত আরো কিছুটা উচ্চতা বৃদ্ধি পেতে পারে, তবুও ফিউশন হয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসা করালে তেমন কোনো ফল পাওয়া যাবে না।
চিকিৎসা
কৃত্রিম গ্রোথ হরমোন আবিষ্কৃত হওয়ার আগে খর্বাকৃতির শিশুদের চিকিৎসা বেশ কঠিন ছিল। কেননা তখন মৃতদেহের পিটুইটারি গ্রন্থির হরমোন নির্যাস সংগ্রহ করা হতো এবং এতে প্রায়ই প্রতিক্রিয়া ও নানা রোগের আশঙ্কা থাকত। ১৯৮৫ সালে এ পদ্ধতি বাতিল হয়।
বর্তমানে কৃত্রিম গ্রোথ হরমোন সোমাটোট্রোপিন বা নরডিট্রোপিন দিয়ে সাফল্যের সঙ্গে বামনত্ব বা উচ্চতা বৃদ্ধিজনিত সমস্যার চিকিৎসা করা হচ্ছে। তবে বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত শিশু, যার গ্রোথ হরমোন অপর্যাপ্ত, টার্নার সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশু, কম ওজন ও ছোট আকার নিয়ে ভূমিষ্ঠ শিশু এবং কিডনি জটিলতাসংক্রান্ত কারণে যাদের বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে—তাদের ক্ষেত্রে গ্রোথ হরমোনথেরাপি ব্যাহত হয়।
এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট বা হরমোন বিশেষজ্ঞের পরামর্শে নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত প্রতিদিন রাতে নির্দিষ্ট মাত্রার গ্রোথ হরমোন ইনজেকশন দেওয়া হয় ও পর্যবেক্ষণ করা হয়। গ্রোথ হরমোনের সমস্যা ছাড়া বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হওয়ার অন্য কারণ থাকলে সঠিক কারণটি নির্ণয় করে সে অনুযায়ী দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা নিতে হয়। তবে সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় ও পরামর্শ নেওয়া এবং যত কম বয়সে চিকিৎসা শুরু করা যায়, ততই ভালো ফল পাওয়া যায়।