"Tenet" মাস্টারপিস এই সাইন্স ফিকশন মুভিটি দেখার আগে বিজ্ঞানের যে টপিকগুলো সম্পর্কে জানা প্রয়োজন!
ক্রিস্টোফার নোলান যেন মাস্টারপিস বানানোর দক্ষ কারিগর! তার হাত ধরেই আমরা পেয়েছি Interstellar, Inception, The Dark Knight সিরিজের মতো কিছু মাস্টারপিস। এরই ধারাবাহিকতায় এবার তিনি হাজির হলেন "Tenet" নিয়ে।
আরেকবার মাথা নষ্ট করার জন্য এখনই মুভিটি দেখে ফেলতে পারেন। কিন্তু তার আগে এর সাথে জড়িত থাকা বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা নেওয়া যাক। তাহলে না বুঝতে পারার কষ্টটা অন্তত থাকবে না। এখানে কোনো স্পয়লার নেই। কারণ সিনেমাটি কেমন বা কাহিনির ব্যাখ্যা এখানে করা হবে না। শুধুমাত্র সিনেমাটির সাথে জড়িয়ে থাকা বিজ্ঞান সম্পর্কিত তথ্য গুলো নিয়েই আলোচনা হবে। তাই লিখাটি পড়ে সিনেমা দেখলে আপনার তেমন ক্ষতি হবে না বরং মাথা নষ্ট হওয়া থেকে একটু হলেও রক্ষা পাবেন।
টেনেট নিয়ে কথা বলতে গেলে ৩টি বিষয় নিয়ে কথা বলা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এগুলো হচ্ছে গ্রান্ডফাদার প্যারাডক্স, এনট্রপি এবং রিভার্স এনট্রপি। ট্রেইলার দেখে ইতোমধ্যে বুঝে যাওয়ার কথা সিনামাটির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে রয়েছে Time বা সময়। সেইজন্য এই ৩টি বিষয়ে জানলেই আপনি সিনেমার বেশির ভাগ অংশ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাবেন৷ science bee
▪️গ্রান্ডফাদার প্যারাডক্সঃ-- এটি সম্ভবত টাইম ট্রাভেল বিষয়ক প্যারাডক্স গুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়। তো এখানে কাহিনিটা কী? ধরুন আপনি টাইম ট্রাভেল করে অতীতে চলে গেলেন এবং আপনার গ্রান্ডফাদারকে শিশু অবস্থায় গুলি করে মেরে ফেললেন। ইংরেজিতে গ্রান্ডফাদার বলতে আমরা বুঝি মায়ের বাবা বা বাবার বাবা। এখন তিনি যদি শিশু অবস্থায় মারা গিয়ে থাকেন তবে আপনার মা বা বাবা কেউই পৃথিবীতে জন্ম হবেনা। তাহলে আপনার মা অথবা বাবা পৃথিবীতে না থাকলে আপনি জন্মালেন কীভাবে? আর আপনি না জন্মালে আপনার গ্রান্ডফাদারকে মারলো কে? আপনি আসলেন কোথা থেকে? অতীত পরিভ্রমণ সম্পর্কিত এই সমস্যাকেই বলে গ্রান্ডফাদার প্যারাডক্স।
তাহলে এর সমাধান কী? সহজ ভাষায় এর কোন প্রমাণিত সমাধান নেই। এই প্যারাডক্স সামনে আসার পর বিজ্ঞানীরা এর আপাত সমাধান হিসেবে প্যারালাল ইউনিভার্স থিওরি ও অল্টারনেট টাইমলাইনের কথা বলেছেন। তবে এই দুটো থিওরিই হাইপোথিসিস। science bee
▪️এনট্রপিঃ-- কোন ভৌত ব্যবস্থায় বিদ্যমান বিশৃঙ্খলার মাত্রাকে এনট্রপির সাহায্যে প্রকাশ করা হয়। এর কোনো পরম মান আজ পর্যন্ত আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় স্বীকার্যে বলা হয়েছে যে, কোনো বিক্রিয়াতে কখনোই মোট এনট্রপির মান হ্রাস পায় না। সহজভাবে বলতে গেলে, কোনো এক সিস্টেমের বিশৃঙ্খলাই হচ্ছে এন্ট্রপি। অর্থাৎ, সহজ অর্থে এনট্রপির মান বাড়বে বৈকি কমবে না।
সহজ উদাহরণ ভাবা যাক, গরমের দিনে লেবুর শরবত বা ঠাণ্ডার দিনে চা বা কফি আমরা সবাই খেয়েছি! শরবতে বা চায়ে চিনি গুলিয়ে নেওয়ার পরে কিন্তু সাধারন অর্থে আর চিনি আলাদা করা সম্ভব না। আপনি হয়ত কোন রসায়ন ল্যাবে গিয়ে পুনরায় পরিস্রুত করে দ্রবণ থেকে চিনি আলাদা করে ভাববেন যে এনট্রপিকে তো উল্টা দিকে চালনা করা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবে কিন্তু তা হবে না। কারন ইনভার্স এনট্রপি অর্জনের জন্য কিন্তু আপনি ঠিকই কাজ করে এনট্রপি বাড়িয়েছেন। গোলমেলে মনে হলে সিগারেটের কথা ভাবুন । সিগারেট খাওয়ার পরে কি সিগারেটকে আর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারবেন? দুনিয়ার সবচাইতে বড় ল্যাবরেটরিতে গেলেও কিন্তু তাকে আর আগের রূপে ফিরিয়ে আনা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। science bee
একইভাবে আমাদের মহাবিশ্বেও নক্ষত্ররা প্রতিনিয়ত শক্তি উৎপন্ন করছে, গ্রহরা নক্ষত্রদের প্রদক্ষিণ করছে , ব্লাকহোলরা গিলছে। আর এতে এনট্রপি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আসলে বিগ ব্যাং এর পর থেকে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ হয়ে চলেছে, মহাবিশ্বের তাপমাত্রাও হ্রাস পেতে পেতে একসময় পরমশূন্য তাপমাত্রা লাভ করবে। তখন মহাবিশ্বের তাপীয় মৃত্যু ঘটবে। বিগ ব্যাং এর পর থেকেই মহাবিশ্ব সৃষ্টি থেকে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ বিশৃঙ্খলার মাত্রা (এনট্রপি) বাড়ছে, মহাবিশ্বের সিস্টেমটাই এমন। এই সিস্টেমে ধ্বংস হয়ে গেলেই কেবল এনট্রপি সাম্যাবস্থায় থাকতে পারে৷ ধরুন, আপনার কাছে দুইটি তাপীয় উৎস আছে। একটি ৯০° সেলসিয়াস তাপমাত্রায়, আরেকটি ৫০° সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। এদের দ্বারা ইঞ্জিন বানালে যতক্ষণ পর্যন্ত তাপের পার্থক্য বজায় থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত ইঞ্জিনটি চলবে। কিন্তু তাপীয় পার্থক্য যখন আর থাকবে না তখন ইঞ্জিনটি বন্ধ হয়ে যাবে। অর্থাৎ, এনট্রপির মান সাম্যাবস্থায় স্থির থাকবে।
▪️রিভার্স এনট্রপিঃ-- এতক্ষণ তো এনট্রপি নিয়ে কথা বললাম এবার না হয় এর বিপরীত দিকটা নিয়ে কথা বলি। এনট্রপি মানে বিশৃঙ্খলা। সবকিছু বিশৃঙ্খলার দিকে যেতে থাকে। কিন্তু কোনোভাবে যদি ঘটনাটিকে উল্টে দেওয়া যায়, অর্থাৎ রিভার্স করা যায় তাহলে দেখা যাবে সবকিছু আবার শৃঙ্খলাতে ফিরে যাচ্ছে। একটা সহজ উদাহরণ দেওয়া যাক।
মনে করি, এক টুকরো বরফ আপনি স্বাভাবিক তাপমাত্রায় বাইরে রাখলেন। তাহলে সেটি তাপ শোষণ করে পানিতে পরিণত হবে৷ আপনি হাজার বছর ধরে, হাজার চেষ্টা করলেও ঘরের তাপমাত্রায় সেটাকে পানি থেকে আর বরফে পরিণত করতে পারবেন না৷ এখানেই এনট্রপি কাজ করে। যেখানে অনু-পরমাণু সব বিশৃঙ্খল ভাবে ছড়িয়ে পরে। কিন্তু কোনোভাবে যদি এটিকে উল্টে দিতে পারতেন? ধরুন এখন আর বরফ পানিতে পরিণত হচ্ছে না। বরং পানি বরফে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। এটা ঘটার জন্য বাহ্যিক পরিবেশের তাপমাত্রাও পরিবর্তিত হওয়া লাগবে। তাছাড়া কখনই পানি নিজে থেকে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় তাপ ছেড়ে বরফে পরিণত হবে না। এটাই রিভার্স এনট্রপি।
রিভার্স এনট্রপি আরো সহজ ভাবে বুঝতে "Cause and Effect" বুঝতে হবে। ধরুণ আপনার কাছে একটি বন্দুক আছে। আপনি যতক্ষণ না পর্যন্ত বন্দুক থেকে গুলি করছেন ততক্ষণ বন্দুক থেকে নিজে নিজে গুলি বের হবে না। এখানে আপনি হচ্ছেন "Cause" আর আপনার বন্দুকে ট্রিগার চাপার মাধ্যমে গুলি বের হওয়া হচ্ছে "Effect"। এনট্রপির ক্ষেত্রে এটাই ঘটে এবং ঘটবে। কিন্তু রিভার্স এনট্রপির বেলায় "Cause and Effect " উল্টিয়ে "Effect and Cause" এ পরিণত হয়। অর্থাৎ, আমাদের সময় অনুযায়ী গুলি পুনরায় বন্দুকে ফিরে আসাটা এখন Cause আর এর ফলে আমাদের ট্রিগার আগের জায়গায় ফিরে আসাটা "Effect"। সহজ ভাষায় এখন ঘটনাটি উল্টে গেল৷
টেনেট মুভিতে টাইম ট্রাভেল এভাবেই রিভার্স এনট্রপির সাহায্যে করা হয়। যেখানে দুইটি সরল সময় পাশাপাশি চলে। একটি সামনের দিকে যাচ্ছে অন্যটি পিছনের দিকে। আমাদের এখানে যেমন ১৫ তারিখের পর ১৬ তারিখ আসে, সেখানে ১৬ তারিখের পর ১৫। তাদের কাছে সময় আমাদের মতই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা তাদের সময়ে চললে আমাদের জন্য সময় উল্টে যাবে। ফলে সবকিছু পিছনে যেতে শুরু করবে৷ আর এভাবে সময় ভ্রমণ করাও সম্ভব হবে৷
এই পর্যন্তই ছিলো টেনেট মুভির বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা৷ লিখাটি পড়া হয়ে গেলে মুভিটিও দেখে ফেলতে পারেন। ২ ঘন্টা ৩০ মিনিট অপচয় হবে না এই নিশ্চয়তা দিয়ে বিদায় নিলাম।
©সায়েন্স বী