আমরা কি এই বিশ্বভ্রম্মান্ডের(ইউনিভার্সের) একমাত্র জীবন্ত বস্তু?
দৃশ্যমান ইউনিভার্সের পরিধি ৯০ বিলিয়ন আলোকবর্ষ (৯,০০০,০০০,০০০ আলোকবর্ষ)। এরমধ্যে গ্যালাক্সির সংখ্যা কমপক্ষে ১শ বিলিয়ন
(১০০,০০০,০০০,০০০), যার প্রত্যেকটার মধ্যে নক্ষত্রের সংখ্যা ১শ বিলিয়ন থেকে ১ট্রিলিয়ন (১,০০০,০০০,০০০,০০০) পর্যন্ত।
কি? সংখ্যাটা ছোট মনে হচ্ছে?
আমাদের পৃথিবীতে যতগুলা বালুকণা আছে তাদের সবার মাঝে যদি এতোগুলো নক্ষত্র সমান ভাগে ভাগ করে দিতে চাই তাহলে প্রত্যেকটা বালুকণার ভাগে গড়ে ১০,০০০ টা করে নক্ষত্র পড়বে।
কিছুদিন আগে আমরা জেনেছি গ্রহদের সংখ্যাও কম নয়। এবং সম্ভবত আমাদের ইউনিভার্সে অগণিত বাসযোগ্য গ্রহও আছে, যার মানে হল— (প্রচুর পরিমানে এমন সম্ভাবনা থাকা উচিত যেই পরিবেশে প্রানের উন্নয়ন এবং অস্তিত্ব আছে।)
সহজ করে বলি, যদি প্রতি গ্যালাক্সিতে একটা করেও পৃথিবীর মত বাসযোগ্য গ্রহ থাকে, তবে গোটা ইউনিভার্সে একশ বিলিয়ন মানবজাতি/এলিয়েনজাতি থাকার কথা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রানের উদ্ভব যদি এত সহজই হয় তাহলে আমরা আর একা নই। কিন্তু আমরা ছাড়া বাকীরা গেল কই??
এলিয়েন যদি থেকেই থাকে তবে আমাদের মহাশুন্যে কি স্পেসশীপের ছড়াছড়ি থাকার কথা না?
চলুন একধাপ পেছনে যাই
যদি অন্য গ্যালাক্সিতে এলিয়েন বা অন্য সভ্যতা থেকেও থাকে তাহলেও আমাদের তাদের কথা কখনই জানতে পারবো না। বেসিক্যালি আমাদের গ্যালাক্সি মিল্কিওয়ে যেই লোকাল গ্রুপে অবস্থিত তার বাইরের কোন কিছুই আমরা কখনোই জানতে পারবো না। {লোকাল গ্রুপ হচ্ছে আমাদের আর আশেপাশের বেশ কিছু গ্যালাক্সির গ্রুপ।}
এর কারন হচ্ছে ইউনিভার্স বিগ ব্যাং এর সময় শুরু হওয়া প্রসারণ এখনো চলছে। গোটা ইউনিভার্সের সবকিছুই একে অন্যের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। মহাবিশ্ব যেন এক ফুলানো রঙিন বেলুন, বেলুনটা খালি ফুলছে তো ফুলছেই, থামার নাম নেই। আর বেলুনের গায়ের রঙিন ছিটের মত ছড়িয়ে থাকা গ্যালাক্সিরা ক্রমে নিজেদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে একটু একটু করে। যদি আমাদের অনেক স্পিডের স্পেসশীপও থাকতো, তারপরও সবচেয়ে কাছের গ্যালাক্সিতে পৌছাতে কয়েক বিলিয়ন বছর কেটে যেত শুধু মহাকাশের বিরান, শুন্য ভুমিতে ঘুরতে ঘুরতে।
সো, আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিটাই আগে ভালোমত খুঁজে দেখি। কেমন?
আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যলাক্সিতে নক্ষত্রের সংখ্যা ৪শ বিলিয়ন প্রায়।
এদের মধ্যে সূর্যের মত নক্ষত্রের সংখ্যা ২০ বিলিয়ন(২০,০০০,০০০,০০০)। এবং সংগৃহীত ডাটা বলে এদের কমপক্ষে পাঁচ ভাগের এক ভাগ নক্ষত্রের চারপাশে বাসযোগ্য “হ্যাবিটেবল জোন” আছে এবং সেই “হ্যাবিটেবল জোন” এ পৃথিবীর মত গ্রহ আছে। টোটাল ৪ বিলিয়ন এইরকম গ্রহ থাকার কথা। এই ৪বিলিয়নের মাত্র ০.১% গ্রহেও যদি প্রাণের উদ্ভব হয়ে থাকে, তাহলেও আমদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতেই এক মিলিওন (১,০০০,০০০) বিভিন্ন এলিয়েন প্রান থাকার কথা। বাই দ্যা ওয়ে, প্রাণের উৎপত্তি ও বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ যে অঞ্চলে পাওয়া যায় তাকে হ্যাবিটেবল জোন বলা হয়।
আরো আছে।
মিল্কিওয়ের বয়স ১৩ বিলিয়ন বছর। শুরুর দিকে অনেক অনেক নক্ষত্রের বিস্ফোরণের কারনে প্রাণের উদ্ভব না ঘটলেও ১ থেকে ২ বিলিয়ন বছর পরেই প্রথম বাসযোগ্য গ্রহের জন্ম হয়। পৃথিবীর বয়স ৪ বিলিয়ন বছর। সুতরাং আমাদের আগেও অসংখ্য গ্রহে প্রাণের উদ্ভব হবার কথা। যদি তাদের মধ্যে মাত্র একটি সভ্যতাও যসি স্পেস ট্রাভেল করা সুপার সিভিলাইজেশনে পরিণত হয় তবে তো এতদিনে আমাদের জানার কথা।
ওইরকম একটা সভ্যতা দেখতে কেমন হত?
এই রকম সভ্যতার তিনটি ক্যাটাগরি থাকে।( এই শ্রেণিবিন্যাসকে Kardashev Scale বলে।)
• টাইপ ১ সিভিলাইজেশনঃ যে সভ্যতা তার গ্রহে থাকা সব ধরনের এনার্জি বা শক্তি নিজের কাজে ব্যবহার করতে পারবে। যদি আপনার মনে প্রশ্ন জাগে যে, আমরা কোন লেভেলের?
আমরা টাইপ ১ সিভিলাইজেশন হবার ১০০% এর মধ্যে ৭৩% কাজ সম্পন্ন করেছি এবং আশা করা যায় আগামী কয়েকশ বছরের মধ্যেই আমরা টাইপ ১ সিভিলাইজেশনে পরিনত হতে পারব।
• টাইপ ২ সিভিলাইজেশনঃ যে সভ্যতা তার নক্ষত্রে থাকা সব ধরনের এনার্জি বা শক্তি নিজের কাজে ব্যবহার করতে পারবে। যদিও এটা করতে পারাটা প্রায় অসম্ভব। তবে একসময়ের যেটা ফিকশন সেটা অন্য সময়ের রিয়েলিটি হতেই পারে। তাই না? মনে করেন সূর্যের চারিদিকে কোন এক আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে একটা ঢাকনা পড়ায়ে দেয়া হল। সেই ঢাকনার নিচের দিকটা আবার সোলারে তৈরি। সো সেই ঢাকনাটা আমাকে বিশাল পরিমাণ শক্তি দিচ্ছে, যেটা দিয়ে কিনা আমি সূর্যের ঢাকনার পিঠেই থাকা সমগ্র জাতির শক্তির চাহিদা মেটাতে পারছি। এগুলো এখন পর্যন্ত শুধু কল্পনাতেই সম্ভব। (উদারনঃ ডাইসন স্ফিয়ার Dyson Sphere).
• টাইপ ৩ সিভিলাইজেশনঃ যে সভ্যতা তার গ্যালাক্সিতে থাকা সব ধরনের এনার্জি বা শক্তি নিজের কাজে ব্যবহার করতে পারবে। এই লেভেলের কোন একটা এলিয়েন প্রজাতির দেখা পেয়ে গেলে কি হবে একবার ভাবুন তো।
আমরা যদি এমন স্পেসশীপ বানাতে পারি যেটা ১০০০ বছর টানা প্রাণের সংরক্ষণ করতে পারবে তাহলে সেটার সাহায্যে পুরো মিল্কিওয়ের দখল নিতে আমাদের সময় লাগবে ২ মিলিয়ন বছর।
কি, অনেক বেশি মনে হচ্ছে? মিল্কিওয়ের সাইজটাও তো দেখতে হবে ভাই।
তো এই গেল মিল্কিওয়ের কথা। এইরকম মিলিয়ন বিলিয়ন গ্যালাক্সির অধিবাসীরা কই? আমাদের আগের সভ্যতাগুলোই বা কই গেল?
এটার নামই ফার্মি প্যারাডক্স।
এখন পর্যন্ত এসব প্রশ্নের সঠিক জবাব পাওয়া যায় নি কিন্তু এ ব্যাপারে আমাদের কিছু আইডিয়া আছে
প্রথমেই আসি ফিল্টারের ব্যাপারে। ফিল্টার বলতে এমন সব বাঁধাকে বোঝানো হয় যেটা অতিক্রম করে টিকে থাকা প্রানীদের জন্য কস্টসাধ্য হবে (উদাহরনঃ ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে ডায়নোসরের বিলুপ্তির সময় প্রাণীজগতের ৭৬% সদস্য বিলুপ্ত হয়ে যায়)। পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত এই ধরনের “ফিল্টার” এসেছে মোট ৫ বার। এদের মাস এক্সটিংশন বলে।
জটিল প্রানের উদ্ভব আমরা যতটা ভাবছি তা চেয়েও বেশি দুর্লভ হতেই পারে। যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রাণের উদ্ভব হয় সেটা এখনো সম্পূর্ণভাবে জানা যায় নি। এই প্রক্রিয়াটাতে অনেক জটিল কিছু শর্ত পালন করতে হয় প্রাণের উদ্ভবের জন্য। হয়তো অন্য গ্রহগুলো সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারছে না। হয়তোবা আগে মহাবিশ্ব বসবাসের একদম অনুপযোগী ছিল এবং কিছুদিন আগেই মাত্র সব ঠান্ডা হতে শুরু করল আর এর পরেই জটিল প্রাণের উৎপত্তি হল।যার মানে, হয়তো আমরা আমাদের গ্যালাক্সিতে/মহাবিশ্বে শুরুর দিকের অথবা একমাত্র সভ্যতা।
আবার এমনটাও হতে পারে জীবন ধ্বংসকারী ফিল্টার এখনো আমরা মোকাবেলা করিনি, আমাদের সামনের দিনগুলোতে এইসব ফিন্টারের মোকাবিলা করতে হবে। (উদাহরনঃ নিউক্লিয়ার যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন)। এমনটা হলে আসলেই খুব খারাপ হব্রে। হতে পারে আমাদের মত সভ্যতার অভাব নেই, কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময় পরে এইরকম কোন একটা ফিল্টারের পাল্লায় পড়ে সব শেষ হয়ে যায়, হতে পারে একই পরিস্থিতি আমাদের জন্যেও অপেক্ষা করছে। মনে করেন অনেক এডভান্সড ফিউচার টেকনোলোজি আপনার হাতে আসল, আপনি খুশিমনে ব্যবহার করতে গিয়ে পুরো গ্রহই ধ্বংস করে দিলেন (উদাহরণ হতে পারে ট্রাম্প, কিম জিন উন )। সেক্ষেত্রে আমাদের সবার শেষ বাক্য কি হবে বলেন তো?
আমিই বলে দিচ্ছি। সব আধুনিক সভ্যতার শেষ উক্তি হবে অনেকটা এমন,”এই নতুন ডিভাইসটার একটা বাটন প্রেস করলেই আমাদের সব সমস্যার সমাধান হয়ের যাবে”। যদি এটাই সত্যি হয় তাহলে কপালে খারাবি আছে।
আবার এটাও হতে পারে যে, কোন প্রাচীন টাইপ ৩ সিভিলাইজেশন আসলেই আছে এবং তারা আমাদের গালাক্সি নিয়ন্ত্রণ এবং পর্যবেক্ষণ করে। কোন সভ্যতা যথেষ্ট উন্নত হয়ে গেলে সেই সভ্যতাকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয় (হতেও তো পারে) এক নিমিষেই।এমন কিছুও থাকতে পারে যেটা আবিষ্কার না করাটাই বোধহয় ভালো । এখন আমাদের আসলেই জানার কোন উপায় নেই।
যাবার আগে কিছু কথা। হয়তো আমরা একাই। এখন পর্যন্ত অন্যকোথাও প্রাণের উৎপত্তির প্রমান পাওয়া যায় নি। মহাবিশ্বকে শুন্য আর মৃত বলেই মনে হয়। কেউ আমাদের মেসেজও পাঠাচ্ছে না, আমাদের কলও কেউ রিসিভ করছে না। এমনও হতে পারে আমরা একেবারেই একা এই সুবিশাল ব্রহ্মাণ্ডে।
নিজেদের একা ভাবতে ভয় লাগছে?? যদি উত্তর হ্যা হয় তবে সেটাই সঠিক ইমোশনাল রিএকশন।
যদি আমরা পৃথিবীকে মরে যেতে দেই তবে হয়তো এ মহাবিশ্বে প্রাণের আর কোন অস্তিত্ব থাকবে না। চিরকালের জন্যই হারিয়ে যেতে পারে প্রানের চিহ্ন। যদি তাই হয় তবে আমাদের উচিত যত দ্রুত সম্ভব টাইপ ৩ সিভিলাইজেশনে পরিণত হওয়া এবং প্রানের রঙিন অস্তিত্ব গোটা মহাবিশ্বের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া আর মহাবিশ্বের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার বিকাশ ঘটানো।
এই মহাবিশ্ব ভয়ংকর রকমের সুন্দর। কিন্তু কেউ যদি এই সৌন্দর্য নিজ চোখে না দেখে তবে সৌন্দর্যের অবমাননা করা হবে। এর সৌন্দর্য আমাদের দেখতেই হবে।
ভাষান্তরঃ Zahir Rahat
কৃতজ্ঞতাঃ Kurzgesagt – In a Nutshell