Omar Khalid Shohag-
5D অপটিকাল ডেটা স্টোরেজ- লং টার্ম স্টোরেজ সলুশন
কাঁচের মধ্যে তথ্য সংরক্ষণঃ তথ্য ধারণক্ষমতা ১০০০ বছর!
আদিম যুগে মানুষ পাথরে খোদাই করে তাদের গল্প লিখে গিয়েছিল, হাজার বছর পরে আমরা সেগুলো উদ্ধার করে আমাদের ইতিহাস জানতে পেরেছি। প্রথম কাগজের আবিষ্কার, ছাপাখানার আবিষ্কার এগুলো সবই ছিল তথ্য সংরক্ষণে এক একটা নতুন মাইলস্টোন। একটু খেয়াল করলে দেখা যায় প্রাচীন যুগ থেকেই মানুষ যেটা সব সময় করতে চেয়েছে সেটা হল তথ্য সংরক্ষণ, নিজেদের তথ্য পরবর্তি জেনারেশনে পৌঁছে দেওয়া। খ্রিস্টের বাইবেল হোক অথবা প্রাচীন মিশরের পিরামিডে লিখা হায়ারোগ্লিফিক্স, সেই ইতিহাস আমরা পেয়েছি, জেনেছি কেবল মাত্র তথ্য সংরক্ষণের জন্য, কোন না কোন ভাবে মানুষ তার সভ্যতা-সংস্কৃতির গল্প লিখে গেছে। আজকের যুগের কম্পিউটার হোক, মোবাইল হোক অথবা বই পত্র, খাতা, ছবি- সব ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে জিনিস সেটা হল সংরক্ষিত তথ্য। এই তথ্য হতে পারে কোন দলিল, বই, সাহিত্য, কোন কন্ট্রাক্ট, কোন রেকর্ডিং অথবা ছবি-ভিডিও আকারে আমাদের হাজার হাজার স্মৃতি। এসব তথ্যকে অবশ্যই আমরা কখনও হারাতে চাইনা, চাইনা নষ্ট করতে। আরও চাই এসব যেন বেঁচে থাকুক শত শত বছর।
.
এক এস্টিমেশন অনুযায়ী বলা হয় বর্তমানে ইন্টারনেটে ক্লাউড স্টোরেজের ধারণ ক্ষমতা ২০০০ এক্সাবাইট (২ বিলিয়ন টেরাবাইট)। এভাবে শুনলে মনে হতে পারে এটা এক বিশাল স্টোরেজ। কিন্তু বাস্তবে আসলে চিত্র ভিন্ন। শুধু ইউটিউবের কথাই চিন্তা করলে দেখা যায় প্রতি মিনিটে ইউটিউবে প্রায় ৫০০ ঘন্টার কন্টেন্ট আপলোড করা হয়। প্রযুক্তির উন্নয়নের পথে এখন দিন দিন সবকিছু ক্লাউডভিত্তিক হয়ে যাচ্ছে। শুধু পারসোনাল ফালই নয়, বিভিন্ন সিকিউরিটি ফাইল, মেডিকেল রেকর্ড, ক্রিমিনাল রেকর্ড, পাবলিক ডেটা ইত্যাদি সব কিছুরই ঠিকানা এখন ক্লাউড। আর তাই বিশ্বব্যাপী দীর্ঘমেয়াদী ডেটা ধারণকারী ডিভাইসের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কারণ যদি নতুন কোন স্টোরেজ প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করা না হয় ধারণা করলে দেখা যায় একদিন না একদিন ইন্টারনেটের সকল স্পেস শেষ হয়ে যাবে, তা হোক আরও শত বছর পরে তা তারও পরে। সেই সাথে আর্কাইভ ডেটার জন্য বর্তমানের কোন ডিজিটাল সল্যুশনই উপযুক্ত নয়, তাদের জন্যও নতুন প্রযুক্তির দরকার হবে ভবিষ্যতে। ধারণা করা হচ্ছে ২০২৫ সালের মধ্যে বিভিন্ন ক্লাউড স্টোরেজে সংরক্ষিত ডেটার পরিমাণ ১০০ জেটাবাইট ছাড়িয়ে যাবে (১ জেটাবাইট = ১০০ কোটি টেরাবাইট)। এত বিশাল আকারের ডাটাকে সুরক্ষিতভাবে দীর্ঘস্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করার জন্য স্টোরেজ ডিভাইস নিয়ে চিন্তার শেষ নেই বড় বড় টেক জায়ান্টগুলোর। অনেক কোম্পানি নতুন নতুন স্টোরেজ সল্যুশন নিয়ে রিসার্চ করে চলেছে। এমনই এক সলুশন হতে পারে কাঁচ।
.
জিনিসটা কিঃ
জিনসটা আপাতদৃষ্টিতে সিম্পল। কাঁচের ফলকের ভেতরে লেজার দিয়ে খোদাই করে তথ্য সংরক্ষণ। বিভিন্ন গিফট শপে কাঁচের কিউবের ভেতরে খোদাই করা বিভিন্ন প্যাটার্ন (তাজমহল, আইফেল টাওয়ার ইত্যাদি) দেখেছেন নিশ্চই, মোটা দাগে কিছুটা ওরকম। কিন্তু শুধু এতটুকু অংশই সরল, বাকি সম্পূর্ণ প্রযুক্তি যথেষ্ট জটিল এবং অবাক করার মত। ২০১৩ সালে ইউনিভার্সিটি অব সাউথহ্যাম্পটনের একদল গবেষক এমন এক কাঁচের ডিস্ক উদ্ভাবন করেন যার মধ্যে সংরক্ষিত তথ্যকে 5D তে রিড করা যায়। কনভেনশনাল স্টোরেজ মিডিয়াম 3D তে ডেটা স্টোর এবং প্রসেস করে। কাঁচে সংরক্ষিত ডেটা শুধু X,Y,Z এই ৩ অক্ষেই নয় বরং সেই কাঁচের ভেতরে আলো কিভাবে, কোনদিকে কতটা বেঁকে যায় সেই তথ্যের উপরে ভিত্তি করেও ডেটা রাইট এবং রিড করতে পারে। খুব সরলভাবে এর ব্যাখ্যা দিলে এভাবে বলা যায় যে, সাধারণ ডিস্কে লেজার দিয়ে ক্ষত সৃষ্টি করা হয়, ডিস্ক রিডার ক্ষতর স্থান গুলোকে ১ এবং যেসব স্থানে ক্ষত নাই সেগুলোকে ০ হিসেবে কাউন্ট করে, মানে বাইনারির হিসাব। কাঁচের ডিস্কেও উচ্চ ক্ষমতার লেজার দিয়ে ক্ষত সৃষ্টি করা হয়, একে বলে ন্যানোগ্রেটিং। এখানে পার্থক্য হল একটা গ্লাস ডিস্কের ভেতরে একাধিক লেয়ারে এসব এনগ্রেভিং তৈরি করা যায়। সেই সাথে নতুন প্রযুক্তির লেজার শুধু কোথায় ক্ষত আছে বা নেই সেটাই না, বরং সেই ক্ষত কতটা গভীর, কোন দিকে ঘুরানো, কত বড় বা ছোট ইত্যাদি সব ধরনের তথ্য রিড করতে পারে। প্রত্যেকটা ডিস্ককে আবার ভিভিন্ন এঙেল থেকে দেখলে আলাদা আলাদা প্যাটার্ন পাওয়া যায়। বিভিন্ন দিক থেকে এই ক্ষত গুলোর আকার আকৃতি, দিক, গভীরতা ইত্যাদির জন্য এগুলো থেকে বিভিন্নভাবে আলো প্রতিফলিত, প্রতিসরিত হয়, সেই তথ্যকেও রিড করার ক্ষমতা আছে বর্তমান প্রযুক্তিতে। এর ধারণক্ষমতার কথা বললে বলা যায় এই ১টা কাঁচের ডিস্ক বাজারে পাওয়া সাধারণ সিডি ডিস্কের ৩০০০ গুণের সমান। ১টা ব্লু-রে ডিস্কের ধারণক্ষমতা ১২৮ গিগাবাইট, ১টা সিলিকন স্টোরেজ ডিস্কের ধারণক্ষমতা ৩৬০টেরাবাইট! সাউথহ্যাম্পটন ইউনিভার্সিটির গবেষকগণ ইতমধ্যে সম্পূর্ণ বাইবেল, নিউটনের অপটিক, জাতিসংঘের মানবাধিকার নীতিমালা ইত্যাদি তথ্য এসব ডিস্কে রাইট করতে সক্ষম হয়েছেন। তাদের ধারণামতে এসব ডিস্কের আয়ু হবে প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর, যা প্রায় আমাদের মহাবিশ্বের বয়সের সমান!
.
হিটাচির ফিউজড সিলিকা রেকর্ডিং টেকনোলজিঃ
এতে সন্দেহ নেই যে বর্তমান যুগের স্টোরেজ সলুশন অসাধারণ গতি, ক্ষমতা এবং অন্যান্য সুবিধা প্রদান করতে সক্ষম। কিন্তু এগুলোর কোনটিই দীর্ঘ সময় অক্ষত থাকে না। উচ্চ ধারণ ক্ষমতার সাথে সাথে দীর্ঘ মেয়াদী অক্ষত মাধ্যম এখন সময়ের প্রয়োজন। কাঁচের ভেতরে তথ্য সংরক্ষণের প্রযুক্তি নিয়ে হিটাচি গবেষণা করছে ২০০৮ সাল থেকে। হিটাচি পরীক্ষা করে দেখিয়েছে যে তাদের প্রযুক্তিতে কাঁচে সংরক্ষিত তথ্য ২ ঘন্টা ধরে ১০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উত্তপ্ত করলেও নষ্ট হয় না। এই পরীক্ষা থেকে ধারণা করা যায় যে এই কাঁচের ফলকে রক্ষিত তথ্য ৩০০ মিলিয়ন বছর পর্যন্ত অক্ষত থাকতে সক্ষম। কিন্তু যদিও আমরা লক্ষ লক্ষ বছরের জন্য তথ্য সংরক্ষণ করতে সক্ষম হই, আর আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম এই তথ্যকে পুনরুদ্ধার করতে না পারে তাহলে এই প্রযুক্তি পুরোটাই বিফলে যাবে। তাই হিটাচির লক্ষ্য যেন এই কাঁচের ডেটাকে সহজ এবং সরল যন্ত্রপাতি দিয়েই রিড করা যায়। ডেটা রাইট করার জন্য ব্যবহার করা হয় ফেমটোসেকেন্ড পালস লেজার। এই লেজার এনগ্রেভিং এর বিস্তারিত পরবর্তি অংশে বলা হয়েছে। জাপানের কিয়োটো ইউনিভার্সিটির সাথে একসাথে কাজ করে এই ব্রেকথ্রু প্রযুক্তির বিকাশ ঘটে। ফেমটো লেজার দিয়ে কাঁচের মধ্যে ক্ষত সৃষ্টি করা হয়, যেগুলো এক একটা 2D কোড হিসেবে কাজ করে। বাস্তব ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি আরও এফিশিয়েন্ট করার জন্য হিটাচি পুরু কাঁচের ফলকে একাধিক স্তরে এই লেজার এনগ্রেভিং করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত হিটাচি এক কাঁচের ফলকের ভেতরে ১০০ লেয়ারে তথ্য রাইট করতে সক্ষম হয়েছে। তাদের এই রেকর্ডিং ডেনসিটি বর্তমান সময়ের একটা ব্লু-রে ডিস্কের ধারণক্ষমতার থেকেও বেশি। এই প্রায় অবিনশ্বর স্টোরেজ সলুশন দ্রুত সকলের মনযোগ আকর্ষণ করে এবং অন্যান্য আরও অনেক কোম্পানি একই রকম প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা শুরু করে। ২০১৪ সালে শিন-এন-২ স্যাটেলাইটের পে-লোড হিটাচির এই ফিউজড সিলিকা কাঁচের ফলক নিয়ে মহাকাশে যাত্রা করে। এই ফলকে লক্ষ লক্ষ বছর পরের প্রজন্মের জন্য আমাদের শুভেচ্ছা বার্তা খোদাই করা আছে। সেই মেসেজ আমাদের মহাকাশে ভেসে চলবে বছরের পর বছর। হিটাচির এই ফলক ব্রিটিশ মিউজিয়ামের ‘১০০ জিনিসে পৃথিবীর ইতিহাস’ নামক এক্সিবিশনেও স্থান পায়।
.
মাইক্রোসফট প্রজেক্ট সিলিকাঃ
মাইক্রোসফট কাঁচে তথ্য সংরক্ষণের যে সলুশন নিয়ে কাজ করছে তার নাম প্রজেক্ট সিলিকা। কেম্ব্রিজে মাইক্রোসফট রিসার্চ ল্যাবে চলছে এই প্রজেক্টের সকল গবেষণা।
প্রজেক্ট সিলিকা হল কাঁচের মধ্যে তথ্য সংরক্ষণের একটি প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তিতে একটি কোয়ার্টজ গ্লাস শিটের ভেতরে ফেমটোসেকেন্ড পালস লেজার দিয়ে খোদাই করে ডাটা রাইট করা হয় (১ ফেমটোসেকেন্ড = ১ সেকেন্ডের ১০ লক্ষ কোটি ভাগের ১ ভাগ, ডাটা রাইট করার জন্য ১০০ ফেমটোসেকেন্ড পালস ব্যবহার করা হয়)। লেজার দিয়ে কাঁচের শিটের ভেতরে ফোকাস করা হয়, লেজার যেখানে ফোকাস করে সেই স্থানে কাঁচে স্থায়ীভাবে একটি ভক্সেল তৈরি হয় বা সহজ কথায় বললে আঁচড় পড়ে যায়। এই প্রসেসকে ন্যানোগ্রেটিং বলে আর এই ন্যানোগ্রেটিং-এ প্রত্যেক পালসে একটি করে ১ ন্যানোমিটার আকারের ভক্সেল তৈরি হয়। কম্পিউটারের ভাষায় ভোক্সেল বলতে ত্রিমাত্রিক রেফারেন্স মডেলের সমবন্টিত গ্রিডে একটি একক ডাটা পয়েন্ট বা স্যাম্পলকে বুঝায়, এই ডাটা পয়েন্টে এক বা একাধিক তথ্য সংরক্ষিত থাকতে পারে। কাঁচের ভেতর প্রত্যেক ভক্সেলের একটি নির্দিষ্ট দিক এবং নির্দিষ্ট গভীরতা আছে, যার উভয়ই লেজার দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যার ফলে বিভিন্ন ভক্সেল বিভিন্ন গভীরতার এবং বিভিন্ন দিকে মুখ করে থাকতে পারে। এই দিক ও গভীরতার উপর ভিত্তি করে প্রতিটি ভক্সেলে একাধিক ‘বিট’ সংরক্ষণ করা যায়, অর্থাৎ একটি ভক্সেল একাধিক তথ্য ধারণ করতে সক্ষম। কাঁচের ভেতরে অসংখ্য লেয়ারে এই ভক্সেল গুলো কলাম ও সারি আকারে সাজানো থাকে সব মিলে যা একে একটি ত্রিমাত্রিক আকার দেয়। এর ফলে ছোট স্থানেও অনেক বেশি পরিমাণ ডেটা রাইট করা যায়। সম্পূর্ণ সিস্টেমটি ত্রিমাত্রিক হবার কারণ শুধুমাত্র ভক্সেলের X, Y, Z অক্ষে অবস্থান, দিক ও গভীরতা নিয়ন্ত্রণ করে বহুমাত্রিক ডেটা সংরক্ষণ ডিভাইস তৈরি সম্ভব। একবার একটি শিটে ডেটা রাইট করা হয়ে গেলে সেটা সেখানে স্থায়ীভাবে সংরক্ষিত হয় এবং পরবর্তিতে শুধুমাত্র শিট থেকে রাইট করে ডেটা রিড করা যায়, কোন প্রকার মোডিফাই করার আর সুযোগ নেই। বিভিন্ন প্রযুক্তি দিয়ে কাঁচে ডেটা রাইট ও রিড করা সম্ভব। যেমন কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত মাইক্রোস্কোপ দিয়ে শিট থেকে ডেটা রিড করা সম্ভব, এটি ফেমটোসেকেন্ড পালস লেজারের মতই একটি লেজার রিডিং ডিভাইস যা কাঁচ থেকে ডেটা পুনরুদ্ধারে ব্যবহার করা হয়। X, Y, Z অক্ষে অবস্থান নির্ণয়ের মাধ্যমে দ্রুত প্রয়োজনীয় তথ্যের অবস্থান লেজার দিয়ে শনাক্ত করা হয়। এরপর রিডিং হেড (রিডিং লেজার পয়েন্টার) যে লেয়ারে তথ্যটি রয়েছে সেই লেয়ারে ফোকাস করানো হয়, সেই লেয়ারের ভক্সেল গুলোর পোলারাইজেশন (দিক) ও গভীরতা রেকর্ড করা হয়। এভাবে রিডিং হেড পরবর্তি লেয়ারগুলো স্ক্যান করে ও সবশেষে সবগুলো ছবি একত্রে প্রসেস করে সংরক্ষিত ডেটা উদ্ধার করা যায়।