পরমাণুর ইলেক্ট্রন এক স্তর থেকে অন্যস্তরে স্থানান্তরের সময় আলোকরশ্মি হিসাবে শক্তি শোষিত বা বিকিরিত হয়। এর ফলে এর ফলে বর্ণালি র সৃষ্টি হয়। শক্তি শোষিত হওয়ার জন্য সৃষ্ট বর্ণালি কে বলা হয় অনুজ্জ্বল বর্ণালি (dark spectrum) বা শোষিত বর্ণালি (absorption spectrum) । পক্ষান্তরে শক্তি বিকিরিত হওয়ার জন্য সৃষ্ট বর্ণালি কে বলা হয় বিকিরণ বর্ণালি (emission spectrum) বা উজ্জ্বল বর্ণালি (hight spectrum)।
সকল ধরনের বর্ণালি মানুষ শনাক্ত করতে পারে না। মানুষের যে সকল তড়িৎ-চুম্বকীয় বর্ণালি দেখতে পারে তাদেরকে বলা হয় দৃশ্যমান বর্ণালি (visibale spectrum)। উল্লেখ্য মানুষের চোখ ৭৯০ টেরাহার্জ থেকে ৪০০ টেরাহার্জ কম্পাঙ্ক এবং ৩৮০ থেকে ৭৫০ ন্যানোমিটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্যে সাড়া দেয়। মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণী এর বাইরের রঙ দেখতে পারে। যেমন— মৌমাছি, অনেক পাখি অতিবেগুনী আলো দেখতে পারে।
রঙ (colour, color)
দৃশ্যমান বর্ণালি সারণীতে আমরা যে রঙের নমুনা পাই, তার সবই আমরা কোনো বস্তুর রঙ হিসাবে দেখতে পারি। কোনো বস্তু দেখার জন্য প্রয়োজন তিনটি মৌলিক উপাদান। এই তিনটি বিষয় হলো—
১. যে বস্তুটি দেখা হবে তার উপস্থিতি
২. দেখার জন্য আদর্শ দৃষ্টিশক্তি
৩. দেখার উপযোগী পর্যাপ্ত আলো
প্রথম দুটি শর্ত পূরিত হলে তৃতীয় শর্তটি বিবেচনায় আসবে। রঙের প্রকৃতি নির্ভর করে আলো এবং বস্তুর প্রকৃতির উপর। একটি আপতিত আলো কোনো সুনির্দিষ্ট রঙের হতে পারে। দৃশ্যমান আলোর আদর্শ রূপ হলো- দৃশ্যমান বর্ণালি র সকল সদস্য মিলে যে আলো তৈরি করে, তার মিশ্র রূপ। এই বিচারে সূর্যের আলোকেই আদর্শ আলো হিসাবে বিবেচনা করা হয়। আমাদের দর্শনেন্দ্রিয়ের বিচারে এর নাম সাদা।
কোনো বস্তু থেকে আলো প্রতিফলিত হয়ে— চোখে এসে পড়লে, তখন উক্ত বস্তু দেখা যায়। আর একটি আদর্শ আলো কোনো বস্তু দ্বারা প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে পড়লে, তখন ওই বস্তু যে রঙে দেখাবে, তাই হবে ওই বস্তুর রঙ। অর্থাৎ বস্তুর রঙই হলো— প্রতিফলিত আলোর রঙ। প্রকৃতিতে আমার বিভিন্ন বস্তু বিভিন্ন রঙে দেখি, এর মূলে রয়েছে বস্তুর নিজস্ব ধর্ম। প্রতিটি দৃশ্যমান বস্তুর আলো প্রতিফলন ও শোষণের ক্ষমতা আছে। যখন একটি আদর্শ আলোর কিছু রঙকে কোনো বস্তু শোষণ করে এবং কিছু রঙকে প্রতিফলিত করে এবং ওই প্রতিফলিত রঙ যখন আমাদের দর্শনেন্দ্রিয়ে অনুভূতি জাগায়, তখন প্রতিফলিত রঙের বিচারে আমরা বস্তুকে ওই রঙে দেখে থাকি। ধরা যাক, একটি বস্তু একটি আদর্শ আলোর নীল রঙ ছাড়া বাকি সকল রঙ শোষণ করছে। এক্ষেত্রে নীল আলো উক্ত বস্তু থেকে প্রতিফলিত হয়ে চোখে এসে পড়বে। সে কারণে উক্ত বস্তুকে নীল রঙ হিসাবে দেখা যাবে। কোনো রঙই যখন প্রতিফলিত হয় না, তখন তার রঙ হয় কালো। আর সকল রঙের প্রতিফলনে যে অনুভূতির তৈরি হয়, তাকে বলা হয় সাদা।
মূল লাল =FF0000
|
পরিবর্তিত লাল=FE0000 |
আরও একটু পরিবর্তিত লাল=FD0000 |
|
|
|
মানুষ তার দর্শনেন্দ্রিয়ের ক্ষমতার দিয়ে যত রঙ দেখে, তার সবগুলোকে পৃথক পৃথকভাবে নামকরণ করতে পারে না। রঙের সামান্য হেরফের চোখ গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু অত্যন্ত কাছাকাছি দুটি রঙের পার্থক্য মানুষ বুঝতে পারে না। পাশের চিত্রে কাছাকাছি মানের লাল রঙের তিনটি নুমনা দেখানো হলো।
চোখের দেখায় যে সকল রঙকে একই রঙ মনে হয়, বর্ণালি বিশ্লেষণে তা এক নয়। এমন কি একই রঙ ছাপনো কাপড় বা কাগজের রঙ সর্বত্র একই মানের নাও হতে পারে। তারপরেও মানুষ বহু রঙকে আলাদা আলাদা নামে চিহ্নিত করে থাকে। চোখের দেখায় মানুষ মূলত একটি রঙের গড় মানকেই বিচার থাকে। বিভিন্ন ভাষায় এই সকল রঙকে নানা রকম নামে অভিহিত করা হয়। সাধারণভাবে লাল, সবুজ, হলুদ, নীল ইত্যাদি নামে রঙের নামকরণ করার পাশাপাশি কোনো বস্তুর রঙের সাথে তুলনা করে রঙের নামকরণ করা হয়ে থাকে। যেমন- কাঠ রঙ, জলপাই রঙ, সোনালি রঙ ইত্যাদি।
রঙচক্র (colour wheel)
বর্ণালি অনুসারে রঙের ক্রম পরিবর্তনের ধারায় যত রঙ পাওয়া যায়, এদের খুব কাছাকাছি রঙ মানুষ আলাদা করে শনাক্ত করতে পারে না। কিন্তু এই ধারায় অনেকখানি দূরত্ব পেরিয়ে মানুষ আলাদা আলাদা রঙ হিসেবে শনাক্ত করতে। অবশ্য কিছু কিছু বর্ণান্ধ মানুষ অনেক রঙকে দেখতেই পায় না। মানুষের দেখার গড় মান অনুসারে রঙের ক্রম পরিবর্তনের ধারাকে চক্রাকারে সাজালে রঙচক্র পাওয়া যায়। রঙ চক্রে সমদূরত্বে ৩টি রঙ পাওয়া যায়। এই রঙ তিনটি হলো নীল, হলুদ ও লাল। এই কারণে এই তিনটি রঙকে বলা হয় প্রাথমিক রঙ। বাকি সকল রঙকে বলা হয় মিশ্র রঙ। হলুদ আর নীল রঙ মিলে তৈরি হয় সবুজ রঙ। অন্যদিকে লাল আর হলুদ মিলে তৈরি হয় কমলা।
রঙিন টেলিভিশনে মৌলিক রঙ হিসেবে বিবেচনা করা হয় তিনটি রঙকে। এই রঙ তিনটি হলো লাল-সবুজ-নীল [RGB (Red-Green-Blue)]। এইমান বিচার করা হয় ২৫৬টি গাণিতিক মানে। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মানটি হলো—২৫৫, আর সর্বনিম্ন মান হলো ০। ষোড়শাঙ্কিক (Hexadecimal) মানে এই সঙ্কেত ধরা হয়, যথাক্রমে 0 1 2 3 4 5 6 7 8 9 A B C D F। প্রতিটি রঙের জন্য মোট ৬ অঙ্কের মান ব্যবহার করা হয়। এর ভিতর ৩ জোড়া অঙ্ক ব্যবহার করা হয়, মৌলিক রঙের জন্য। এক্ষেত্রে রঙের সর্বোচ্চ মান ধরা হয় FF। রঙের শূন্যতা অর্থে ব্যবহার করা হয় 00। এক্ষেত্রেও RGB (Red-Green-Blue) সূত্রই অনুসরণ করা হয়।
©onushilon