প্রাণীদেহে নির্দিষ্ট উত্তেজনার প্রভাবে যে তাত্ক্ষনিক, স্বতঃস্ফুর্ত ও অনৈচ্ছিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, তাকে প্রতিবর্ত ক্রিয়া বলে । প্রতিবর্ত ক্রিয়ার দুটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল —
(i) এই ক্রিয়া অনৈচ্ছিক এবং (ii) এটি সুষুম্নাকান্ড দ্বারা নিয়ন্ত্রিত । সুতরাং সুষুম্নাকান্ড দিয়ে নিয়ন্ত্রিত প্রাণীদের অনৈচ্ছিক সাড়াকে প্রতিবর্ত ক্রিয়া বলা হয় ।
উদাহরণ :- কোনও গরম বস্তুতে আচমকা হাত ঠেকে গেলে, সঙ্গে সঙ্গে হাতটির সরে আসা হল প্রতিবর্ত ক্রিয়ার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ ।
প্রতিবর্ত ক্রিয়ার শ্রেণিবিভাগ (Classification of reflex action):
রুশ বিজ্ঞানী প্যাভলভ [Pavlov] প্রতিবর্ত ক্রিয়াকে দু-ভাগে ভাগ করেছেন; যথা -
(1) সহজাত বা শর্তবিহীন প্রতিবর্ত ক্রিয়া
(2) অভ্যাসগত বা শর্তাধীন প্রতিবর্ত ক্রিয়া ।
(1) সহজাত বা শর্তবিহীন প্রতিবর্ত ক্রিয়া [Congenital or Unconditional reflex action]:- যে সমস্ত প্রতিবর্ত ক্রিয়া জন্মগত অর্থাৎ জন্মের সঙ্গে সঙ্গে বংশগত সুত্রে পূর্বপুরুষ থেকে প্রাপ্ত হয়, তাকে সহজাত প্রতিবর্ত ক্রিয়া বলে । এই প্রতিবর্ত ক্রিয়া শর্ত নিরপেক্ষ হওয়ায় একে শর্তবিহীন প্রতিবর্ত ক্রিয়াও বলে ।
জন্মের সঙ্গে সঙ্গে শিশুর স্তন্যপানের ইচ্ছা, উজ্জ্বল আলোকে চোখ বন্ধ হওয়া, লোভানীয় খাদ্যের উপস্থিতিতে লালা নিঃসরণ বিশেষ সময়ে মল-মুত্রের বেগ অনুভব করা ইত্যাদি সহজাত বা শর্তবিহীন প্রতিবর্ত ক্রিয়ার উদাহরণ । উত্পত্তি অনুসারে সহজাত প্রতিবর্ত ক্রিয়া দু'রকমের হয়, যেমন : [i] উপরিগত বা সুপারফসিয়াল প্রতিবর্ত ক্রিয়া এবং [ii] গভীর বা ডীপ প্রতিবর্ত ক্রিয়া ।
[i] উপরিগত বা সুপারফসিয়াল প্রতিবর্ত ক্রিয়া [Superficial reflex action]:- প্রতিবর্ত ক্রিয়ার উদ্দীপনা যখন দেহের প্রান্তদেশ অর্থাৎ ত্বক, চোখ ইত্যাদি থেকে আসে ।
উদাহরণ : উজ্জ্বল আলোতে চোখ বন্ধ হওয়া, পায়ের তালে সুড়সুড়ি দিলে পায়ের পাতা সংকুচিত হওয়া ইত্যাদি ।
[ii] গভীর বা ডীপ প্রতিবর্ত ক্রিয়া [Deep reflex action]:- প্রতিবর্ত ক্রিয়ার উদ্দীপনা যখন দেহাভ্যন্তরস্থ কোনো পেশি, টেনডন ইত্যাদি থেকে উৎপন্ন হয় । যেমন: হাঁটু ঝাঁকুনি, চোয়াল ঝাঁকুনি, বাইসেপস ঝাঁকুনি ইত্যাদি ।
(2) অভ্যাসগত বা শর্তাধীন প্রতিবর্ত ক্রিয়া [Habitual or Conditional reflex action]:- যেসব প্রতিবর্ত ক্রিয়া জন্মের পর বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জিত হয়, তাকে অভ্যাসগত প্রতিবর্ত ক্রিয়া বলে । যেমন: কোনো কাজ বারবার অনুশীলন করলে কিছুদিন পর মস্তিষ্কের সাহায্য ছাড়াই ওই কাজটি করা সম্ভব হয় । এই রকম প্রতিবর্ত ক্রিয়া শর্ত সাপেক্ষ হওয়ায় একে শর্তাধীন প্রতিবর্ত ক্রিয়াও বলে । বিজ্ঞানী প্যাভলভ প্রতিদিন নির্দিষ্ট এক সময়ে ঘন্টাধ্বনি করে একটি কুকুরকে খাবার দিতেন । এইভাবে কয়েকদিন অনুশীলনের পর কুকুরটিকে খাবার না দিয়ে কেবল ঘন্টাধ্বনি করে দেখলেন যে, কুকুরটির লালা নিঃসরণ হয়েছে । এরকম প্রতিবর্ত ক্রিয়াকে তিনি অভ্যাসগত প্রতিবর্ত ক্রিয়া বা শর্তাপেক্ষ প্রতিবর্ত ক্রিয়ারূপে অভিহিত করেন । শিশুদের হাঁটতে শেখা, কথা বলতে শেখা ইত্যাদি এই জাতীয় প্রতিবর্ত ক্রিয়ার উদাহরণ ।
সহজাত প্রতিবর্ত এবং অভ্যাসগত প্রতিবর্তের পার্থক্য
SL | সহজাত প্রতিবর্ত | অভ্যাসগত প্রতিবর্ত |
1 | এই প্রতিবর্ত জন্মগত । | এই প্রতিবর্ত জন্মগত নয়, অভ্যাসের দ্বারা অর্জিত । |
2 | এই প্রতিবর্ত শর্তনিরপেক্ষ । | এই প্রতিবর্ত শর্ত সাপেক্ষ । |
3 | এই রকম প্রতিবর্তের জন্য পূর্ব অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয় না । | এই রকম প্রতিবর্তের জন্য পূর্ব অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয় । |
4 | এই রকম প্রতিবর্তের স্নায়ুপথ সরল | এই রকম প্রতিবর্তের স্নায়ুপথ অপেক্ষাকৃত জটিল । |
উৎস অনুসারে প্রতিবর্ত ক্রিয়ার শ্রেণিবিভাগ : উত্স অনুসারে প্রতিবর্ত ক্রিয়াকে দু'ভাবে ভাগ করা হয়েছে, যেমন -
[i] সরল প্রতিবর্ত ক্রিয়া [Simple reflex action]:- যে প্রতিবর্ত ক্রিয়া কেবলমাত্র সুষুম্নাকান্ড দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, এবং প্রতিবর্ত পথ অল্প সংখ্যক স্নায়ুকোষ দিয়ে গঠিত থাকে তাকে সরল প্রতিবর্ত ক্রিয়া বলে । যেমন : চোখে কিছু পড়ার উপক্রম হলে চোখ দুটি আপনা থেকেই বুজে যায় ।
[ii] জটিল প্রতিবর্ত ক্রিয়া [Complex reflex action]:- যে প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় সুষুম্নাকান্ড ছাড়াও মস্তিষ্কের সাহায্যের প্রয়োজন হয়, এবং প্রতিবর্ত পথে বহুসংখ্যক স্নায়ুকোষ থাকে, তাকে জটিল প্রতিবর্ত ক্রিয়া বলে । যেমন: হাঁটা-চলা, সাইকেল চালানো ব্যাঙের শিকার ধারা ইত্যাদি ।
Source :www.BengalStudents.com