Nishat Tasnim-
রাজা হওয়ার জন্য যে বিষয়টা সিংহকে সবচেয়ে এগিয়ে রেখেছে সেটা হলো তার চেহারা। আগে দর্শনধারী তারপর গুণবিচারী কথাটা এক্ষেত্রে একদম ফলে যায়। সিংহের কোমর পর্যন্ত বিস্তৃত কেশর যেন বারবার তার রাজকীয়তার জানান দেয়। নিঃসন্দেহে কোমর পর্যন্ত বিস্তৃত কেশরের কারণে জঙ্গলের যেকোনো প্রাণীর থেকে সিংহের চেহারা বেশি রাজকীয়। সেই সাথে সিংহের চলাফেরাতেও একটা রাজকীয় হালচাল আছে। সিংহের ভয়ডরহীন চাহনী ও চলাফেরা নিঃসন্দেহে একটি রাজকীয় বৈশিষ্ট্য। এছাড়াও এদের গর্জন জঙ্গলের অন্য যেকোনো প্রাণী থেকে এদের আলাদা করেছে। একেকটি সিংহের গর্জন প্রায় ৮ কিলোমিটার দূর থেকেও শোনা যায়। গর্জনের মাধ্যমে সিংহরা অন্যদেরকে নিজেদের সীমানার জানান দিয়ে থাকে। তাই রাজকীয় গর্জন কিংবা হুংকার সিংহের পশুরাজ হওয়ার পেছনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
তবে এগুলো ছাড়াও সিংহের রাজা হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান এদের পরিবারতন্ত্রের। এরা অতিশয় সামাজিক একটি প্রাণী। অন্যান্য বিড়ালের প্রজাতি থেকে এরা বেশ আলাদা। এরা দলবেধে বসবাস করে। সিংহের একেকটি দলকে বলা হয় প্রাইড। একটি প্রাইডে প্রায় ৩০টির মতো সিংহ থাকে। যার ৩-৪টি পুরুষ সিংহ, ১০-১৫টি স্ত্রী সিংহ এবং বাকিসব সিংহ শাবক। একেকটা প্রাইডের আকার নির্ভর করে খাদ্য, পানি ও শিকারের যোগানের উপর। শিকার ও পানি বেশি হলে দলের আকার বড় হয়, কম হলে দলের আকারও ছোট রাখতে হয়।
একজন রাজার যেমন নির্দিষ্ট রাজ্য থাকে, তেমনই একটি প্রাইডেরও একটি নির্দিষ্ট এলাকা বা টেরিটোরি থাকে। এই টেরিটোরি প্রায় ১০০ বর্গ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। প্রাইডের পুরুষ সিংহেরা এই টেরিটোরি রক্ষার কাজ করে থাকে। অন্য কোনো সিংহের দল যাতে তাদের সীমানায় ঢুকতে না পারে সেই কাজ করে থেকে পুরুষ সিংহেরা। পুরুষ সিংহ শাবককে একটি নির্দিষ্ট সময় পর তার বাবার এলাকা ত্যাগ করে একটি নতুন টেরিটোরিতে আক্রমণ চালিয়ে নিজের নতুন সীমানা প্রতিষ্ঠা করতে হয়।
রাজা বাদশাহদের সাথে ভোগ-বিলাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সিংহের প্রাইডেও এই বিষয়টি স্পষ্ট। সাধারণত দলের স্ত্রী সদস্যরাই শিকার ধরার কাজ করে থাকে। তবে শিকার স্ত্রীরা করলেও প্রথম অধিকার প্রাইডের নেতা পুরুষ সিংহের। তাই শিকারের পর প্রথমে পুরুষ সিংহ তার আহার শেষ করে, তারপর বাকি অংশ স্ত্রী সিংহরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়।
বাঘেদের মধ্যে এমন অসম বণ্টন নীতি দেখা যায় না। সাধারণত বাঘেরা দলবেধে শিকার করে না, এমনকি করলেও খাবারের ক্ষেত্রে সমান সমান অধিকার থাকে। তাই সিংহের পরিবারের এই প্রথা নিশ্চিতভাবে রাজতন্ত্রের কথাই সমর্থন করে।
এই রাজকীয় পরিবারতন্ত্র জঙ্গলের অন্য কোনো প্রাণীর মধ্যে দেখা যায় না। একজন রাজার বেশভূষা ও পরিবারতন্ত্র সিংহের মধ্যেই প্রবলভাবে ফুটে উঠেছে বলেই হয়তো প্রাচীনকাল থেকেই রাজা-বাদশাহরা তাদের রাজকীয় পতাকায় সিংহের অবয়বের আধিক্য রেখেছেন। ভারতীয় উপমহাদেশের মতো এলাকায়, যেখানে সিংহের চেয়ে বাঘ সহজপ্রাপ্য ও জনপ্রিয়, সেখানেও রাজাদের রাজকীয় পতাকায় বাঘের চেয়ে সিংহের উপস্থিতিই বেশি লক্ষ্যণীয়। সেজন্যেই হয়তো প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের মুখে মুখে 'বনের রাজা' হিসেবে চলে এসেছে সিংহের নাম!