স্ট্রিং থিওরিঃ সবকিছু সমাধানের থিওরি?
প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের অদম্য এক কৌতুহল ছিলো "মহাবিশ্ব কিভাবে কাজ করে?" তা জানার। এই প্রশ্ন থেকেই প্রথমে জন্ম নেয় "দর্শন শাস্ত্র" এবং পরে "পদার্থ বিদ্যা"। এই বিষয়গুলোকে ব্যাখ্যা করতে নানা মুনি নানা মত দিলেও প্রথম "গানিতিক যুক্তি" প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যাখ্যা দেন আইজাক নিউটন। তার নিউটনীয় বলবিদ্যা জড়বস্তুর পরিবর্তনশীলতা এবং মহাকর্ষ সূত্র মহাবিশ্ব কিভাবে কাজ করে তার ব্যাখ্যা দেয়। তবে তার এই ব্যাখ্যায় একটা সমস্যা হচ্ছে মহাকর্ষ সূত্রগুলো স্থির বা খুব কম গতিতে গতিশীল বস্তুর ক্ষেত্রে কাজ করলেও যে কোন স্থান কালে একই ভাবে কাজ করে না। অর্থাৎ এটিকে স্বার্বজনীন বলা যায় না। এই সমস্যার সমাধান নিয়ে এলেন আইনস্টাইন তার সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের মাধ্যমে। অন্যদিকে নিউটনীয় বলবিদ্যা দৃশ্যমান জড়বস্তুর ক্ষেত্রে কাজ করলেও পরমাণুর অভ্যন্তরে মৌলিক কনিকা সমুহের বেলায় কাজ করে না। এই সমস্যার সমাধান করলেন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক তার কোয়ান্টাম বলবিদ্যার মাধ্যমে। আইনস্টাইনের হাত ধরেই প্রথম মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যার একটি স্ট্যান্ডার্ড মডেল প্রনয়নের কাজ শুরু হয়। কিন্তু ব্যাপারটা সম্ভব হচ্ছিলো না কারণ কোয়ান্টাম বলবিদ্যা আর মহাকর্ষীয় সাধারণ আপেক্ষিকতা নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও এই দুইটিকে সমন্বয় করা যাচ্ছিলো না। কেন যাচ্ছিলো না তা বুঝতে হলে প্রথমে আমাদের চারটি মৌলিক বল সম্পর্কে ধারণা নিতে হবে। চারটি মৌলিক বল হচ্ছে যথাক্রমে মহাকর্ষ বল, তড়িৎ চৌম্বকীয় বল, সবল নিউক্লিয় বল এবং দূর্বল নিউক্লিয় বল।
১. মহাকর্ষ বলঃ এটি সবচেয়ে দূর্বল বল। তবে এর আওতা বা নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চল সবচেয়ে বড়। মহাবিশ্বের সর্বত্রই এই বল বিরাজমান। মহাবিশ্বের গ্রহ নক্ষত্র অবস্থান ও ঘুর্নন সব কিছুই বলের মাধ্যমে হয়।
২. তড়িৎ চৌম্বকীয় বলঃ এটি মূলত চার্জিত দুইটি বস্তুর একটির প্রতি অন্যটির আকর্ষণ বল। এটিও সর্বত্র বিরাজমান তবে শুধু চার্জ আছে এমন বস্তু বা কনার ক্ষেত্রে কাজ করে।
৩. সবল নিউক্লিয় বলঃ এটি পরমাণুর অভ্যন্তরে ক্রিয়াশীল একটি বল। পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রোটন আর নিউট্রনকে স্থিতিশীল রাখে মূলত এই বল। তবে এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে প্রোটন এবং নিউট্রন মৌলিক কণা নয়। বরং তিনটি কোয়ার্কের সমন্বিত রুপ। কোয়ার্ক মৌলিক কনা। ইলেকট্রনও মৌলিক কনা। সবল নিউক্লিয় বল মূলত কোয়ার্কের উপর কাজ করে নিউক্লিয়াসে প্রোটন এবং নিউট্রনকে ধরে রাখে।
৪. দূর্বল নিউক্লিয় বলঃ এটিও পরমাণুর অভ্যন্তরে ক্রিয়াশীল একটি বল। এটিই পরমাণুর তেজস্ক্রিয় ভাঙনের জন্য দায়ী। তবে এটি অত্যন্ত দূর্বল হওয়ায় কেবল তেজস্ক্রিয় মৌল ছাড়া অন্য মৌলে এর প্রভাব তেমন নেই।
এই জগতে যা কিছু আছে তা মূলত ফিল্ড বা ক্ষেত্রের উপর পার্টিক্যাল বা কণার বিচরণ। আর কণার এই বিচরণ নিয়ন্ত্রণ করে বল বা শক্তি। প্রকৃতিতে যত বল কাজ করে তা মূলত এই চারটি বলের সমন্বয় মাত্র।
দুইটি সাধারণ বিজ্ঞান বইয়ের তথ্য আমরা কম বেশি সবাই জানি। প্রথমত বিগ ব্যাং এর মাধ্যমেই সব কিছুর সূচনা আর দ্বিতীয়ত মহাবিশ্বের সব কিছুই ১০০'র কিছু বেশি মৌলিক পদার্থ দিয়ে তৈরি আর এই মৌলিক পদার্থ তৈরি কিছু মৌলিক কণা দিয়ে। তার মানে যদি এই মৌলিক কণাগুলোর আচরণকে আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি তাহলে মহাবিশ্বকে আমরা ব্যাখ্যা করতে পারবো। আর এখান থেকেই "থিওরি অব এভরিথিং" ধারণাটির জন্ম। চারটি মৌলিক বলকে একত্রিত করে মহাবিশ্ব সম্পর্কে একটি স্ট্যান্ডার্ড মডেল প্রনয়ন করাই আধুনিক পদার্থ বিদ্যার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। প্রশ্ন হচ্ছে কেন চারটি বলকে একত্রিত করে স্ট্যান্ডার্ড মডেল প্রনয়ন করা যাচ্ছে না?
কারণ অভিকর্ষ বল মহাবিশ্বের সর্বত্র কাজ করলেও পরমাণুর অভ্যন্তরে কাজ করে না আবার বাকি তিনটি বল পরমাণুর অভ্যন্তরে কাজ করলেও মহাবিশ্বের সর্বত্র কাজ করে না। অর্থাৎ গ্রহ নক্ষত্রের ঘুর্নন ও অস্তিত্বের ব্যাখ্যা দিতে পারে না। এছাড়াও মহাকর্ষ ছাড়া বাকি তিনটি মৌলিক বলের বহনকারী কণা আছে। তড়িৎ চৌম্বকীয় বল বহনকারী কণা হচ্ছে ফোটন, সবল নিউক্লিয় বল বহনকারী কণা গ্লুয়োন এবং দূর্বল নিউক্লিয় বল বহনকারী কণা W&Z বোসন। মহাকর্ষ বল বহনকারী কণা হিসেবে গ্র্যাভিটনের কথা বলা হলেও এটির বাস্তব কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তাই মহাকর্ষ বলের কণা ধর্ম নেই। অর্থাৎ কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় চাইলেও জোর করে মহাকর্ষ বলকে ঢোকানো যায় না।
এবারে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সবাইকে মনে করিয়ে দেই বিগ ব্যাং এর পরবর্তী সময়ে সবকিছু ছিলো অত্যন্ত উত্তপ্ত। তাই সেখানে ফিল্ড বা ক্ষেত্র হিসেবে বিদ্যমান ছিলো হিগস ফিল্ড। আর সর্বত্র ছড়িয়ে ছিলো হিগস বোসন কণা। পরে ধীরে ধীরে তাপমাত্রা কমে এলে হিগস বোসন কণা ভেঙে যায় হিগস বোসন কণার সাথে পারস্পরিক ক্রিয়ায় একেকটি মৌলিক কণা এক এক রকম ভর লাভ করে। আবার ফোটন হিগস বোসনে বাধাপ্রাপ্ত না হওয়ায় সৃষ্টির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আলোর বেগে চলাচল করতে পারে। আবার সেই মৌলিক কণাগুলো বিভিন্ন ভাবে তিনটি মৌলিক বলের মাধ্যমে সমন্বিত হয়ে বিভিন্ন পরমাণু গঠন করে।
আমরা আমাদের আগের আলোচনায় ফিরে যাই। কিভাবে মহাকর্ষ বলের সাথে বাকি তিনটি বলকে সমন্বয় করা যায়? কোয়ান্টাম লেভেলে গ্র্যাভিটি কাজ করে না কারণ কণার কোন দৈর্ঘ্য, প্রস্থ তথা কোন মাত্রা নেই। মানে কোন স্থান দখল করে না। অর্থাৎ স্থান কাল কাজ না করলে গ্র্যাভিটিও কাজ করে না। এই সমস্যা নিরসনে আশির দশক থেকে বিজ্ঞানীরা কাজ শুরু করেন "স্ট্রিং থিওরি" নিয়ে। স্ট্রিং শব্দের অর্থ সুতা। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার "সবকিছু কণা দিয়ে তৈরি" ধারণা বাদ দিয়ে স্ট্রিং থিওরি বলল "সব কিছু স্ট্রিং দিয়ে তৈরি"। কিভাবে?
কণা বা পার্টিক্যালের কোন মাত্রা নেই। অন্যদিকে স্ট্রিং একমাত্রিক যার দৈর্ঘ্য আছে। স্ট্রিং থিওরি অনুযায়ী সব মৌলিক কণাই স্ট্রিং বা সুতার মতো কিছু দিয়ে তৈরি তবে প্রাপ্ত বলের উপর ভিত্তি করে স্ট্রিং এর কম্পাংক ভিন্ন ভিন্ন হয়। আর এই ভিন্ন ভিন্ন কম্পাঙ্কের জন্য ভিন্ন ভিন্ন মৌলিক কণা যেমন ইলেকট্রন, কোয়ার্ক, নিউট্রিনো ইত্যাদির জন্ম হয়। গিটারের তারের ভিন্ন ভিন্ন কম্পনের ফলে যেমন ভিন্ন ভিন্ন সুর তৈরি হয় অনেকটা সেরকম।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে কিভাবে স্ট্রিং থিওরি অভিকর্ষ বল সমস্যার সমাধান দেয়? আসলে যেহেতু স্ট্রিং গুলোর একটি মাত্রা আছে তাই এটি কণা বা পার্টিক্যালের মতো স্থান কাল নিরপেক্ষ নয় অর্থাৎ স্থান কালের ইন্টারেকশন এতে বিদ্যমান তাই প্রতিটি স্ট্রিং অবশ্যই মহাকর্ষ বল অনুভব করে যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে " কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি"। তার মানে স্ট্রিং থিওরি দিয়ে মহাকর্ষ বলের সাথে বাকি তিনটি বলকে সমন্বয় করে একটি স্ট্যান্ডার্ড মডেল প্রনয়ন সম্ভব। স্ট্রিং থিওরি যদিও বাস্তবিক প্রমাণ এখনো সম্ভব হয়নি তবে গানিতিক মডেল প্রমাণিত হয়েছে। স্ট্রিং থিওরির পেছনে আছে অকাট্য গানিতিক প্রমাণ। তাই এটি পরবর্তী কোন এক সময় প্রমাণিত হবে বলেই বিজ্ঞানীদের প্রত্যাশা। আবার কোন কারণে গ্র্যাভিটন কণা সনাক্ত করা গেলে স্ট্রিং থিওরি বাতিল হয়ে যেতে পারে। এছাড়াও স্ট্রিং থিওরি অনুযায়ী মাল্টিপল ইউনিভার্স থাকতেই হবে। এসব দূর্বলতার কারণে স্ট্রিং থিওরি নিয়ে অনেকের আপত্তিও আছে।
বিঃদ্রঃ স্ট্রিং থিওরি অত্যন্ত জটিল একটি বিষয়। আমি যা লিখেছি তা খুবই ভাসাভাসা একটা ধারণা মাত্র। এই থিওরি সম্পূর্ণ বুঝতে হলে গনিত এবং পদার্থ বিদ্যার উপর উচ্চতর দক্ষতা লাগবে। এখানে অনেক কিছুই আমি গোজামিল এবং অসম্পূর্ণ তথ্য দিয়েছি। কিছু আমার না জানার কারণে আর কিছু বিষয় পদার্থ বিদ্যার জটিল বিষয়গুলো টেনে আনলে সরাসরি পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র নয় এমন পাঠকের অসুবিধা হবে বলে। পদার্থ বিজ্ঞানে যাদের একাডেমিক নলেজ আছে তারা আরও উচ্চতর এবং নির্ভুল ধারণা পেতে Joseph Conlon এর "Why string theory" বইটি পড়তে পারেন।
Science Bee Family Group থেকে Sajal Araf