জেনোবট : যে রোবট জীবন্ত!
____________
রোবট তৈরী হয় কি দিয়ে? সাধারণত বিভিন্ন ধাতু-অধাতুর সমন্বয়ে, তাই না? কিন্তু এমন যদি হত যে রোবট তৈরী হচ্ছে জীব কোষ দিয়ে!
হ্যাঁ, এমনই এক ধরনের রোবট আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানীরা। নাম তার 'জেনোবট'। পৃথিবীর প্রথম জীবন্ত রোবট। বিশেষ প্রজাতির ব্যাঙের ভ্রূন থেকে স্টেম সেল নিয়ে এই রোবট তৈরি করা হয়েছে এবং সেই ব্যাঙের নাম থেকেই জেনোবট নামটি এসেছে।
শুক্রাণু এবং ডিম্বাণু মিলে একটি জাইগোট গঠিত হয়। পরবর্তীতে জাইগোট অনেক অনেক বার বিভাজিত হয়, তৈরী হয় নানা ধরনের কোষের। একই ধরনের কোষগুলো একত্রিত হয়ে টিস্যু, টিস্যু মিলে নির্দিষ্ট অঙ্গ তৈরী করে। এভাবে এক পর্যায়ে পূর্ণ জীবদেহ গঠিত হয়।
সাধারণ রুবিকস কিউব মেলানোর জন্যই তো সূত্র লাগে, তাই না? তাহলে এত এত কোষ মিলে জীবদেহ গঠিত হয় সেখানে সূত্র লাগে না? অবশ্যই লাগে, এবং সেই সূত্র আমাদের জিনে কোডিং করা থাকে।
বিজ্ঞানীরা সুপার কম্পিউটারের মাধ্যমে এরকম কিছু ডিজাইন তৈরী করেছেন। যার নাম দেওয়া হয়েছে 'Evolutionary Algorithm' (ইভোলুশনারি এলগোরিদম এক ধরনের এ আই। সেটা এখানে কাজে লাগাতে পারে - কিন্তু এটাই ইভোলুশনারি এলগোরিদম একথা বললে ভুল হবে।)
পরবর্তীতে বিশেষ প্রজাতির আফ্রিকান ব্যাঙ Xenopus laevis এর ভ্রূণ থেকে ( ব্লাস্টুলা পর্যায়) স্টেম সেল নিয়ে একটি পরীক্ষা চালানো হয়। যদিও আগে কম্পিউটার সিমুলেশনে পরীক্ষা করা হয়েছিল।
একটি বিশেষ তরলে ( স্যালাইন জাতীয়) নির্দিষ্ট তাপমাত্রা মেইনটেইন করে সেখানে ব্যাঙ থেকে নেওয়া স্টেম সেলগুলা ছেড়ে দেওয়া হয়। স্টেম সেল গুলো নেওয়া হয়েছে ত্বক, হার্ট এবং অন্যান্য অংশ থেকে।
তো, এই বিশেষ তরলে সেলগুলো রাখার পরে প্রায় ৩০০০ সেল বিশিষ্ট পিন্ড গঠিত হয়, ৩ দিনের মাথায় পিন্ডের বহির্ভাগে সিলিয়া ( যা দিয়ে চলাচল করতে পারে) গঠিত হয়। এক পর্যায়ে এরা পূর্ণাঙ্গ জেনোবটে পরিণত হয়। যারা নিজেরা চলাচল করতে পারে, ধাক্কা দিতে পারে।
এই বৈশিষ্ট্য কি নতুন? না, ভ্রূণেও অনেকটা এরকমই ঘটে। তাহলে এর আসল বিশেষত্ব কিসে?
বিশেষত্ব হচ্ছে, এরা বাচ্চা জম্ম দিতে পারে। তবে আমরা বা অন্যান্য জীবরা যেভাবে জম্ম দেয় সেভাবে না। জেনোবট পরের ধনে মাতব্বরি করে।
একটি পূর্ণাঙ্গ জেনোবট স্টেম সেলের দ্রবণে ছেড়ে দিলে সেটি নিজের প্রতিরুপ সৃষ্টি করতে পারে। দ্রবণ থেকে স্টেম সেল নিয়ে, নিজের দেহ থেকে নয়।
জেনোবটের গঠন অনেকটা Pac-man শেইপের। একদিকে ❤️ এর উপরের দিকের মতো বাকানো অংশ থাকে। স্টেম সেল ঠেলতে এবং সংগ্রহ করে রাখতে এই অংশটা কাজে দেয়। এভাবে নির্দিষ্ট সময় পরে আগের জেনোবটগুলো দ্রবণ থেকে সেল নিয়ে নতুন জেনোবট গঠন করে ফেলে! অবশ্য এক জেনারেশন থেকে অন্য জেনারেশনে জেনোবটের আকার ছোট হয়ে আসে এবং অন্যান্য ত্রুটি দেখা দেয়। ফলে কয়েক জেনারেশন এর বেশি এই রেপ্লিকেশন বা রিপ্রোডাকশন যাই বলেন সেই ক্ষমতাটা হারিয়ে যায়।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ডিজাইন যত নিখুঁত হবে, তত জেনারেশন পর্যন্ত এই সক্ষমতা থাকবে।
আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, জেনোবট নিজেকেও সারিয়ে তুলতে পারে। কোনো অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হলে দ্রবণ থেকে প্রয়োজনীয় সেল নিয়ে তা ঠিক করে ফেলে।
জেনোবটের দৈহিক গঠনের কাজ করে ভ্রূণের ত্বক থেকে নেওয়া স্টেম সেল এবং চলাচলের জন্য মটর বা ইঞ্জিন হিসেবে কাজ করে। সিলিয়া গঠিত হয় অন্যান্য অংশের কোষ দিয়ে।
তো স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসবে, এই আবিষ্কারে আমাদের লাভ কী? বৈজ্ঞানিক গবেষণার তো কোন না কোন উদ্দেশ্য থাকে। যদিও এই গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল ' জীবনের উৎপত্তি বা এবায়োজেনেসিস' কিন্তু এরকম অভাবনীয় ফলাফলে এর অন্য ব্যবহারেরও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
এগুলো যেহেতু জীবন্ত রোবট এবং আকার অতি ক্ষুদ্র সুতরাং এগুলো আমাদের দেহের বিভিন্ন অংশে পাঠানো সম্ভব। এর ফলে টিউমার বা ক্যান্সারের চিকিৎসা করা যাবে।
আবার, নির্দিষ্ট ডিজাইনের মাধ্যমে তৈরী জেনোবটের মাধ্যমে কোনো তরল থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক বা অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থ দূর করা সম্ভব হবে!
দারুণ না?
জেনোবট কি একসময় মানুষদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে? এরকম প্রশ্নের উত্তরে এই গবেষণার প্রধান একজন গবেষক Kriegman বলেন, “It’s an extremely controllable and stoppable and safe system.”
প্রযুক্তির ছোয়ায় এগিয়ে যাক বিশ্ব, মানুষরা থাকুক নিরাপদ। এই কামনা রেখে আমার সংক্ষিপ্ত বকবকানি এখানেই শেষ করছি!
রেফারেন্স।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Xenobot
https://wyss.harvard.edu/news/team-builds-first-living-robots-that-can-reproduce/
https://www.pnas.org/doi/10.1073/pnas.2112672118
"'Xenobot' Living Robots Can Reproduce | The Scientist Magazine®" https://www.the-scientist.com/news-opinion/xenobot-living-robots-can-reproduce-69477
লেখা: ইমামুল হাসান